ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২১ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঔষধি গাছের চাষ ব্যবহার ও গুণাগুণ

গোরা বিশ্বাস

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২০ মে ২০২৫

ঔষধি গাছের চাষ ব্যবহার ও গুণাগুণ

ছবি সংগ্রহীত

 

 

সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা চির সবুজের এই বাংলাদেশ। এখানে রয়েছে লাখ লাখ প্রজাতির গাছপালা, লতাপাতা ও গুল্মাদি। বাংলার এই গাছপালা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখে না পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বাংলায় একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে গাছপালা চিনলে জরি, না চিনলে ভাত রান্নার খড়ি। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার গাছপালা, তার মধ্যে আমরা কয়টি চিনি বা জানি। পৃথিবীতে যত গাছপালা ও ভেষজ উদ্ভিদ রয়েছে তার সবই কোনো না কোনোভাবে মানবজাতির কল্যাণে আসছে। তাই এই গাছপালা নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করার দাবি রাখেলও এই সীমিত পরিসরে এর বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। এখানে মাত্র কয়েকটি ঔষধি গাছ ও ভেষজ উদ্ভিদ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। মোটা দাগে গাছপালাকে ফলদ বনজ ও ঔষধি এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রাকৃতিক চিকিৎসায় এই ঔষধি গাছপালার মধ্যে রয়েছে তুলসী, এ্যালোভেরা, নিম, নিশিন্দা, হরীতকী, আমলকি, বহেরা ইত্যাদি। প্রথমে এ্যালোভেরা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। এ্যালোভেরা প্রচলিত নাম ঘৃতকুমারী বা ঘৃতকাঞ্চন। আয়ুর্বেদিক নাম ঘৃতকমল বা তরুণী। বৈজ্ঞানিক নাম Aloe barbadensis miller, (A india royyle)। পরিচিত এই গাছ ২ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। পাতাগুলো লম্বা ও ধারালো কাঁটাযুক্ত। পাতার ভিতরে এক প্রকার মাংসবহুল রসালো পিচ্ছিল পদার্থ থাকে। যা উৎকট গন্ধযুক্ত ও স্বাদে তিতা। এই গাছটি আগের দিনে গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই সীমিত আকারে হলেও পাওয়া যেত। এখন ঔষধি গুণাগুণ সম্পন্ন হওয়ার কারণে এ্যালোভেরা বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। অনেকে এ্যালোভেরা চাষ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। এর ভিতর রাসায়নিক উপাদান হিসেবে রয়েছে ইছুডিন, ট্রাইকোনিক এসিড, গ্লাইকোসাইড, স্যাপেনিন, টারপিন ইত্যাদি বিদ্যমান। শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখতে নিয়মিতভাবে ঘৃতকুমারী বা এ্যালোভেরা গ্রহণ প্রাকৃতিক ঔষধের কাজ করে। অতি স্বল্প মূল্যের মধ্যে হাতের নাগালে ঔষধি এই ভেষজ উদ্ভিদের বিভিন্ন গুণের জন্য পাঁচ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে মানুষ সেবন করে আসছে। বেশকিছু গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে এ্যালোভেরার যেমন বিকল্প নেই, তেমনি এই প্রাকৃতিক উপাদানটিকে কাজে লাগিয়ে অনেক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে। প্রতিদিন এ্যালোভেরার রস বা জুস পান করলে ত্বক, চুল ও দেহকে পরিশুদ্ধ করে প্রাণবন্ত করে রাখে। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, এ্যালোভেরা জুস খাওয়া মাত্র সারা শরীরে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তের প্রভাব বেড়ে যায়, যে কারণে শরীরের প্রতিটি অঙ্গের পাশাপাশি হার্টের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রাও হ্রাস পায়। ফলে হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। এই উপাদানটি পাশে রাখলে শরীরের যেকোনো আঘাতজনিত ক্ষত সারতে সময় লাগে না। কারণ এ্যালোভেরা জুসে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমাটরি উপাদান রয়েছে যা শরীরে প্রবেশ করা মাত্র দেহের সকল হরমোন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক থাকে। প্যানক্রিয়াস সংক্রান্ত নানা রোগের চিকিৎসাতেও এই প্রাকৃতিক উপাদানটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। নিয়মিত এই প্রাকৃতিক উপাদনটি খেলে শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেলের ঘাটতি দূর হয়। সেই সঙ্গে আ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ঘাটতিও পূরণ হয়। এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হলো সেই উপাদান, যা আমাদের শরীরকে রোগমুক্ত রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ্যালোভেরা জেল যদি তুলসি, করলা অথবা আমলকির রসের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া যায় তাহলে আরও বেশি উপকার মিলে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে খেলে শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেহের প্রতিটি কোণায় জমে থাকা টক্সিক উপাদানগুলো বের করে দেয়। নিয়মিত এই প্রাকৃতিক ভেষজ উপাদানটি গ্রহণ করলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে ছোট বড় কোনো রোগই ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। সেই সঙ্গে সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে আসে। হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটাতে এই ভেষজ উপাদানটি শরীরে প্রবেশ করার পর পাচক রসের ক্ষরণ অনেকটা বাড়িয়ে দেয় যার কারণে কনস্টিপেশনের মতো সমস্যাও দূর হয়। এ কারণে এত গুণসম্পন্ন এই ভেষজ উদ্ভিদের বাণিজ্যিক চাষাবাদের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। আমাদের এই উর্বর মাটির দেশে বাড়িয়ে তোলা প্রয়োজন।
নিষিন্দা বহুল প্রচলিত একটি ঔষধি উদ্ভিদ। এই গাছটি সবাই না চিনলেও সকলেই এর নামের সঙ্গে পরিচিত। প্রচলিত নাম নিষিন্দা। ইউনানী নাম সম্বালু। আয়ুর্বেদিক নাম নিষিন্দা সিন্দুবার। ইংরেজি নাম Negundu nrinda tree. বৈজ্ঞানিক নাম Bitax nirinda linn. পরিবার- Verbenaceae.এটি ছোট আকারের সবুজ পাতা সমৃদ্ধ একটি গাছ। সাধারণত ৩ থেকে ৪ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। পাতাগুলো যৌগিক নিম পাতার মতো খাঁজকাটা এবং একই বৃন্তে ৫-৬টি করে পাতা থাকে। ফুলগুলো নিলাভ রঙের। বীজগুলো দেখতে অনেকটা গুল মরিচের মতো। বীজের রং কালো স্পট বর্ণের। সাধারণত শীতকালে এর ফল পাকে। বাংলাদেশে সর্বত্রই নিষিন্দা গাছ দেখা যায়। এতে রয়েছে প্রাকৃতিক উপাদান উদ্বেয়ী তেল এ্যালকয়েড, গ্লাইকোসাইড, জৈব এসিড, স্টেরয়েড ও এসিড বিদ্যমান। নিষিন্দা পাতার রস বাত-ব্যাথা, সর্দি-কাশি, কৃমিনাশক, মূত্রবর্ধক, আমাশয় এই সকল রোগে পাতাচূর্ণ পানিতে মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। আবার এর অতিরিক্ত ব্যবহারে মাথাব্যথাও দেখা দিতে পারে। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে নিম-নিষিন্দা যে দেশে রোগ বালাই হয় না সেদেশে। প্রাকৃতিক চিকিৎসায় অতি প্রাচীনকাল থেকেই নিষিন্দা ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে আমাদের দেশে এখনো নিষিন্দার চাষ শুরু হয়নি।
উদ্ভিদ জগতে অতিপরিচিত ও আলোচিত নাম তুলসি। ইউনানী নাম রায়হান। ইংরেজি নাম Holy basel, Sacred Basel, পরিবারের নাম labiatac। এই গাছ সাধারণত ৬-৭ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এর কান্ড বেশি মোটা নয়। তবে শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত একটি গোলাকার ঝাপালো গাছ। পাতাগুলো সরল কাঁটা কাঁটা বীজগুলো চেপ্টা মতো লাল রঙের হয়ে থাকে। তুলসি গাছ বৃষ্টি মৌসুম বা বর্ষাকালে বেশি দেখা যায়। এজন্য বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত তুলসি গাছ রোপণের উপযুক্ত সময়। আমাদের দেশে ৪ ধরনের তুলসি গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন- বাবুই তুলসি রাম তুলসি সাদা তুলসি কৃষ্ণ ও বন তুলসি। তুলসি গাছ বাংলাদেশের আনাচে কানাচে যে কোনো মাটিতেই জন্মে থাকে। এই গাছের বেশি রোদ দরকার হয় না। স্যাঁতসেঁতে মাটি ও ছায়ার মধ্যেও থাকতে পারে। ছোট আকৃতির এই গাছটি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে সনাতন ধর্মের মানুষের প্রতিটি বাড়িতেই কমপক্ষে একটি হলেও তুলসি গাছ থাকবেই। কারণ, তাদের ধর্ম বিশ্বাস তুলসি গাছের তলে স্বয়ং ঈশ্বর বাস করেন। এ কারণে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সনাতনীদের কাছে গাছটি অতি পবিত্র ও পূজনীয়। তুলসি গাছের ধর্মীয় দিক ছাড়াও রয়েছে ঔষধি গুণ। ঔষধি গুণসম্পন্ন তুলসি গাছ এখন শুধু হিন্দুদের বাড়িতেই নয় ঔষধি গাছ হিসেবে সকলেই তুলসি রোপণ করে থাকেন। এমনকি আলাদাভাবে দেশে এখন অনেকেই তুলসি বাগান করার কথাও ভাবছে। এর পাতায় রয়েছে ফিনুল সমৃদ্ধ প্রচুর পরিমাণে উদ্বেয়ী তেল। এছাড়াও এ্যালকোয়েড, গ্লাইকোসাইড, সাইট্রিক, স্যালিক, টারপেনিক এসিড বিদ্যমান থাকায় শিশুদের সর্দি, কাশি, হাপানী, চর্মরোগ ও কৃমিনাশ করতে জুড়ি নেই।  জানা যায় আগারগাওয়ে অবস্থিত সবুজ বাংলা নার্সারি থেকে করোনাকালীন সময়ে প্রায় দশ হাজার তুলসি গাছ বিক্রি হয়েছে। তুলসি পাতা জীবাণু ধ্বংস করতে সাহায্য করে বিধায় বাড়িতে তুলসি গাছ থাকলে বিষাক্ত পোকা-মাকড় ও মশা মাছির হাত থেকে রেহাই মিলে। অতএব পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছ-পালা, নদী-নালা ও বনাঞ্চলের যেমন প্রয়োজন রয়েছে তেমনি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সুস্থ সবল জাতি গঠনে প্রাকৃতিক চিকিৎসার জন্য ভেষজ উদ্ভিদ গাছপালার পরিমাণ বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : পরিবেশকর্মী

প্যানেল

×