ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রোহিঙ্গা সংকট ॥ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাব্য সমাধান

মো. আরিফ উল্লাহ

প্রকাশিত: ২০:০৮, ২০ মে ২০২৫

রোহিঙ্গা সংকট ॥ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাব্য সমাধান

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে এই মুহূর্তে নির্দিষ্ট করে তেমন কিছু বলা যাচ্ছে না। বিভিন্ন কারণে এখনো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি এবং জান্তা বাহিনীর মধ্যাকার সংঘাত বা দ্বন্দ্ব এখনো শেষ হয়নি। যতক্ষণ না পর্যন্ত জান্তা বাহিনী আরাকান আর্মির মধ্যে কোনো স্থায়ী সমাধান হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যাবাসনের কোনো সম্ভাবনা অনুমান করা যাচ্ছে না। কিন্তু প্রেক্ষাপটে সরকারের উচিত মিয়ানমার সরকার এবং জান্তা বাহিনীর সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যাহত না হয়।

এক্ষেত্রে আরাকান আর্মিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন, কেননা ইতোমধ্যে রাখাইন প্রদেশ আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে জনমত তৈরি করতে হবে, বিশেষ করে চীন রাশিয়ার দিকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তুত থাকা খুব প্রয়োজন। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যেই আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর ভবিষ্য নির্ধারণ হবে।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত টেকসই এবং নিরাপদ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি ইউএনএইচসিআর, আইওএমসহ অন্য আরও অন্তত ১১৩টি সংস্থা কাজ করে চলেছে। অন্যদিকে রাখাইন রাজ্যে নিরাপদ জোন তৈরির লক্ষে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবুও প্রত্যাবাসন না হওয়ার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের অনিচ্ছা: রোহিঙ্গারা চায় মিয়ানমার সরকার যেন তাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা বসতভিটার নিশ্চয়তা দেয়, তাদের যাতে তারা আর কখনো পূর্বের মতো আবারও অত্যাচারিত হয়ে নিজ জন্মভূমি ছাড়তে না হয়। অন্যদিকে রোহিঙ্গা তরুণরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না, তারা তৃতীয় কোনো দেশে স্থায়ীভাবে থাকতে চায়। এই কারণে তারা প্রায়ই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌপথে অন্য দেশে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে।

মিয়ানমার সরকারের মিথ্যা আশ্বাস: মিয়ানমার যখনই আন্তর্জাতিক কোনো চাপে পড়েছে তখনই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা বলেছে কিন্তু কখনোই রাখাইনে প্রত্যাবাসনের জন্য পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। অন্যদিকে যাচাই-বাছাইয়ের নামে বারবার কালক্ষেপণ করেছে।

দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগে সীমাবদ্ধতা: প্রত্যাবাসন বিষয়ক আলোচনা বাংলাদেশ মিয়ানমারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আন্তর্জাতিক কোনো পক্ষ বা জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্তি রাখা হয়নি যার ফলে মিয়ানমার এই সুযোগ নিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে আরো ধীর গতির করেছে।  

আইনি প্রতিবন্ধকতা: মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন ১৯৮২ বা Burma Citizenship Law ১৯৮২ এর নং ধারা অনুসারে মিয়ানমার তার জনগণকে ৩টি শ্রেণিতে ভাগ করে নাগরিকত্ব দিয়েছে। যেখানে ১৯৪৮ সালের আগে থেকে বসবাসরত মানুষকে পূর্ণ নাগরিকত্ব বা National Races বলা হয়েছে। মিয়ানমার সরকার এই শ্রেণির জন্য ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী নিয়ে একটি তালিকা করে। কিন্তু এই তালিকায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্যদিকে ১৯৪৮ সালের নাগরিকত্ব আইনের অধীনে যারা নাগরিক হতে আবেদন করেছিল তাদেরসহযোগী নাগরিকত্ববা Associate Citizenship বলা হচ্ছে। শেষ স্থরে যারা বিদেশি কিন্তু ১০ বছর বা তার বেশি সময় বৈধভাবে বসবাস করছে তাদেরকে প্রাকৃতিকীকৃত নাগরিকত্ব বা Naturalized Citizenship হিসেবে নাগরিকত্ব দেয়া হয়।

রোহিঙ্গারা ১৯৪৮ সালের আগে থেকে বসবাস করলেও তাদেরকে কোথাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বরং তাদের থেকে পূর্বপুরুষের কাগজপত্র নিয়ে নেয় তাদেরকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে তাদের নাগরিকত্ব হরণ করা হয়।

জনসাধারণের নীরবতা: রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সকল স্তরের মানুষদের নীরব থাকতে দেখা যায়। শুধু কক্সবাজার জেলার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে এই আওয়াজ তুলতে দেখা যায়।

আরাকান আর্মির মতবাদ: আরাকান আর্মির নিকট থেকে রোহিঙ্গারা ইতিবাচক সাড়া আশা করেছিল। কিন্তু আরাকান আর্মি যে মতবাদে বিশ্বাস করে তা কখনো রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান নয়। তারা মনে করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশী মুসলিম শরণার্থী। অন্য দিকে তাদের দাবি বাংলাদেশ যেন রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো কে সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয় করে। 

সম্ভাব্য সমাধান সুপারিশ: বাংলাদেশ একটি টেকসই প্রত্যাবাসন চায়, যাতে এই সংকটের একটি চিরস্থায়ী সমাপ্তি ঘটে। পূনরায় যেন এমন মানবিক বিপর্যয় না ঘটে।

সমস্যা থেকে কিছু সম্ভাব্য সমাধান সুপারিশ তুলে ধরা হলো-

বহুপক্ষীয় সমাধান: প্রত্যাবাসন নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পরিবর্তে বহুপক্ষীয় সমাধান খুঁজতে হবে। সুতরাং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে রাশিয়া, চীন অন্যান্য আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশের সমন্বয়ে। যদিও ভারত, চীন রাশিয়া মানবতার চেয়ে আর্থনৈতিক স্বার্থে একটু বেশি মনোযোগী এবং ইতোমধ্যে তারা বিশাল অংকের বিনিয়োগ মিয়ানমারে করেছে। তবুও তাদের সমর্থন আদায়ের জন্য কাজ করতে হবে।

সেইফ জোনতৈরি: মিয়ানমার কোথায়, কিভাবে, কোন কোন সুবিধা প্রদান করবে, এর স্থিতিশীলতা কতটা নিশ্চিত, চুক্তি ভঙ্গ করলে এর প্রতিকার কী হবে- এসকল বিষয়ে আগাম অবহিত করবে। এর পর চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।

আন্তর্জাতিক সমর্থন: আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ ছাড়া মিয়ানমার কখনোই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। তাই ক্রমাগত রোহিঙ্গা ইস্যুতে পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন পেতে লবিং করতে হবে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের নিজের অধিকারে জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আওয়াজ তুলতে হবে।

আইনগত বাধা নিরসন: মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন ১৯৮২ বা Burma Citizenship Law ১৯৮২ এর যুক্তিসংগত সংশোধনী নিশ্চিত করা যেখানে রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্ব বসবাসের মর্যাদা ফিরে পায়।।

কফি আনান কমিশনের প্রস্তাব: জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪, ৭৫ ৭৬তম অধিবেশন, রাখাইন রাজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা কমিশণ তথা কফি আনান কমিশনের ৮৮টি সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে।

আন্তর্জাতিকীকরণ: বাংলাদেশ যদি এই ইস্যু সমাধানের জন্য একটি আন্তর্জাতিক জোট বা অন্তর্জাতিক কোন প্ল্যাটফর্মে জোরদারভাবে তুলে ধরতে পারে তাহলে এই সমস্যা দ্রুত সমাধানের পথ দেখবে। যেমন যে সকল মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়ার মতো পরাশক্তি দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায়।

বাংলাদেশে কি পরিমাণ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে এর সঠিক তথ্য সরকার কিংবা জাতিসংঘ কারও কাছেই নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এদের বিচরণ রয়েছে। বাংলাদেশরিফিউজি কনভেনশন১৯৫১ তে স্বাক্ষর না করেও এতো বিশাল একটি জাতিকে আশ্রয় দেয়া যেমন মহ কাজ ঠিক তেমনি নিজ দেশের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করাও একটি বড় হুমকির বিষয়। ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। হুমকির মুখে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প জননিরাপত্তা। চীন রাশিয়ার মতো দেশগুলো বিষয়গুলো অনুধাবন করবে এবং মিয়ানমার সরকারকে চাপ প্রয়োগ করবে বলে এই প্রত্যাশা সকলের। রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাবে, তাদের মানবাধিকারের সব অধিকার সুন্দরভাবে ভোগ করবে যা বাংলাদেশ মিয়ানমার উভয় দেশের জন্য কল্যাণকর।

 

লেখক : গবেষক উন্নয়নকর্মী

প্যানেল

×