
সুন্দরবন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন এবং বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের একটি অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ। এই বন এর জীববৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং চিত্রা হরিণের জন্য। সুন্দরবনের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করতে হরিণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অবৈধ শিকার, বন-দস্যুতা এবং সচেতনতার অভাবের কারণে বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে নিরীহ প্রাণীটির। হরিণ শিকার সুন্দরবনের প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ অবস্থায়, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় হরিণ শিকার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত পৃথক অভিযান চালিয়ে ৬৪১ কেজি হরিণের মাংস, একটি জবাই করা হরিণ, একটি মৃত হরিণ, হরিণের দুটি চামড়া, দুটি মাথা, আটটি পা উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ সময় তারা শিকারি ও পাচারকারীদের ব্যবহার করা চারটি ট্রলার, পাঁচটি নৌকা, ১৬০টি ফাঁদ, একটি মাইক্রোবাস, সাতটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে। সেইসঙ্গে ২২ জনকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় ২৫টি মামলাও দায়ের করা হয়। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বনরক্ষীদের অভিযানে পাচারের সময় যে পরিমাণ হরিণ জব্দ হয় তা কালোবাজারির তুলনায় অপ্রতুল। অভিযানে হাতে গোনা দুই একটি চোরাচালান জব্দ করা হলেও চোরাকারবারিকে বেশির ভাগ সময় আটক করতে ব্যর্থ হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
চিত্রা হরিণ সুন্দরবনের এক অন্যতম সৌন্দর্যের প্রতীক। এদের সৌন্দর্য এবং সহজাত আচরণ পর্যটকদের মন জয় করে নেয়। শুধু পর্যটন নয়, এ হরিণ বনের বাস্তুতন্ত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা ঘাস এবং অন্যান্য উদ্ভিদ খেয়ে বন পরিষ্কার রাখে এবং কিছু উদ্ভিদের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে বন পুনর্জন্মে সাহায্য করে। হরিণ কমে গেলে বন পরিষ্কার রাখার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে এবং অন্য প্রাণীদের জন্য বসবাসের পরিবেশ কঠিন হয়ে পড়ে। তাই হরিণের অবাধ শিকার একটি পরিবেশগত বিপর্যয়ের সূচনা করতে পারে।
হরিণ শিকারে সুন্দরবনের খাদ্যচক্রও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাঘ সুন্দরবনের একটি বড় শিকারি প্রাণী। এরা খাদ্যের জন্য মূলত হরিণের ওপর নির্ভর করে। হরিণের সংখ্যা কমে গেলে বাঘের খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিতে পারে এবং তারা খাবারের সন্ধানে বন থেকে বের হয়ে লোকালয়ে চলে আসতে পারে। এতে লোকালয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেইসঙ্গে মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে। অপরদিকে বাঘের ওপর প্রতিশোধমূলক আক্রমণের ঘটনা বৃদ্ধি পাবে। হরিণ শিকারের মাধ্যমে আমরা শুধু হরিণকেই হত্যা করছি না, বরং সুন্দরবনের সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে এক ভয়াবহ হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছি। পর্যটন খাতেও হরিণ একটি গুরুত্বপূর্ণ। চিত্রা হরিণ দেখতে বহু দেশী-বিদেশী পর্যটক সুন্দরবনে আসে। হরিণ না থাকলে এই পর্যটনের আকর্ষণ অনেকে কমে যাবে এবং এর ফলে আর্থিক ক্ষতি হবে। তাই হরিণ সংরক্ষণ শুধু পরিবেশের জন্য নয়, আমাদের অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
অবৈধ শিকারিদের দৌরাত্ম্য সুন্দরবনের এক মারাত্মক সমস্যা। বন বিভাগের পর্যাপ্ত জনবল ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার অভাবের কারণে শিকারিরা সহজেই বনে ঢুকে পড়ে এবং ফাঁদ পেতে হরিণ ধরে নেয়। এদের অনেকেই সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য, যারা চামড়া, মাংস এবং হরিণের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কালোবাজারে বিক্রি করে থাকে। এই চক্রকে আইনের আওতায় না আনলে হরিণ শিকার বন্ধ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই প্রয়োজন কঠোর নজরদারি, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা।
এদিকে সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলের স্থানীয়রা জীবিকা নির্বাহ করে। কেউ কেউ মধু আহরণ, মাছ শিকার, লাকড়ি কুড়ানোসহ ভালো পথ বেছে নিলেও অনেকেই হরিণ শিকার ও দস্যুতার মতো অপরাধের পথ বেছে নেয়। সুন্দরবনের পাশের গ্রামগুলোর মানুষ অনেকেই জীবিকার জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল। যদি সরকার বা বেসরকারি সংস্থা তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না দেয় তাহলে তারা বাধ্য হয়ে হরিণ শিকারের মতো অবৈধ পথে যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা, যাতে স্থানীয় মানুষের জন্য টেকসই জীবিকা সৃষ্টি করা যায় এবং তারাও যেন বন সংরক্ষণের অংশীদার হতে পারে।
হরিণ শিকার রোধে সর্বপ্রথম জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। অনেক সময় মানুষ জানে না যে হরিণ শিকার শুধু একটি অপরাধই নয়, এটি একটি জাতীয় সম্পদের উপর আঘাত। স্কুল, কলেজ এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করা গেলে স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া এবং তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে হরিণ ও পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা যেতে পারে।
সরকারকেও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং যারা হরিণ শিকার করে বা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু আইন থাকলেই চলবে না, আইন প্রয়োগে স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতাও থাকতে হবে। বন বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং নৌযান সরবরাহ করে তাদের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
হরিণ শিকার বন্ধে বনরক্ষী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর নজর দিতে হবে। ড্রোন, স্যাটেলাইট নজরদারি, ট্র্যাপ ক্যামেরা এবং জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে শিকারিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যায়। এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে হরিণের চলাফেরা, সংখ্যাগত হিসাব এবং শিকার সংক্রান্ত তৎপরতা বিশ্লেষণ করে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হবে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে সফলতা এসেছে। হরিণ সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তাও গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংস্থা, যেমন ডডঋ, ওটঈঘ ইত্যাদি সুন্দরবন রক্ষায় নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। এসব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক অনুদান, প্রযুক্তি এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে হরিণ সংরক্ষণকে আরও শক্তিশালী করা যেতে পারে।
পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রতি শিশুদের আগ্রহ ও সচেতনতা গড়ে তুলতে শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হলে শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে। এই শিক্ষার মাধ্যমে তারা পরিবেশবান্ধব জীবনধারায় অভ্যস্ত হবে এবং হরিণ সংরক্ষণের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবে। শিক্ষার্থীদের প্রকৃতিবান্ধব করে গড়ে তুললে তারা নিজেরা যেমন সচেতন হবে, তেমনি সমাজেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে এভাবে হরিণ সংরক্ষণের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবেÑ যা আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পথে একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তুলবে। এছাড়া অবৈধ শিকার রোধে একটি সামাজিক সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। যাতে সকল শ্রেণির মানুষ এতে সম্পৃক্ত হতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ সংরক্ষণ কর্মী ও গণমাধ্যম কর্মীদেরও এই কর্মসূচির অংশ করা যেতে পারে। যাতে তারা সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন।
হরিণ সংরক্ষণ শুধু সরকার বা পরিবেশবাদীদের একক দায়িত্ব নয়– এটি আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রতিটি সচেতন নাগরিকেরই ভূমিকা রয়েছে। যদি আমরা প্রত্যেকে নিজের অবস্থান থেকে বন রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করি তবে একদিন হরিণ শিকার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা সম্ভব হবে। এর জন্য প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন এবং প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা। হরিণ কেবল একটি বন্যপ্রাণী নয়, এটি সুন্দরবনের সৌন্দর্যের জীবন্ত প্রতীক। এদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে সুন্দরবনের অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই হরিণ সংরক্ষণ মানেই সুন্দরবনকে রক্ষা করাÑ যা একটি সুন্দর, সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যতের পূর্বশর্ত।
লেখক : সাংবাদিক
প্যানেল