
দৈনিক জনকণ্ঠ
প্রশাসনের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত রাজধানী ঢাকায় হুহু করে বাড়ছে নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত অবৈধ অটোরিক্সা। চালাতে লাগে না কোন লাইসেন্স নিতে হয় না কোন অনুমোদন আর হয়না তেমন কোন পরিশ্রম।
ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা চালাতে শারীরিক তেমন পরিশ্রম নেই, ফলে শারীরিকভাবে অক্ষম প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন আয়ের উদ্দেশ্যে আবার অনেক গার্মেন্টস কর্মী বিভিন্ন দোকানের সেলসম্যান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী , ভাড়ায় চালিত রাইড শেয়ার করা মোটরসাইকেল চালকরাও অনেকে চলে এসেছেন এই পেশায়, পিছিয়ে নেই নারীরাও।
৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকার ভেতরে একটি নতুন অটো রিক্সা ক্রয় করা যায়। যা দিয়ে প্রতিদিন ১০০০ থেকে ২০০০ টাকা আয় করা সম্ভব। আবার অনেকে ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছেন। একটি অটো রিক্সা বাবদ প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা ভাড়া দিতে হয় গ্যারেজ মালিককে তারপরও একজন চালক প্রতিদিন ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা আয় করে ঘরে ফেরেন।
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে হয়েছেন অটোচালক।
মিরপুরের গার্মেন্টস কর্মী সৌরভের সাথে কথা হয় বলেন, "গার্মেন্টসে সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করতাম বেতন ওভারটাইম মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকা পেতাম। বেশ কিছুদিন শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকার কারণে চাকরি চলে যাওয়ায় বাউনিয়াবাদের একটি গ্যারেজ থেকে একটি অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। প্রথম দিনে আয় করি ১৩০০ টাকা। এরপরই চাকরির প্রতি অনীহা চলে আসে। তিন মাস অটো চালিয়ে সংসার খরচ বাদ দিয়ে ৩০ হাজার টাকা জমিয়ে একটি বেসরকারি এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা কিস্তি নিয়ে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে নিজেই একটি অটো রিক্সা কিনে ফেলি। মোহাম্মদপুরের বসিলা থেকে এরপর আরো তিনটা এনজিও'র থেকে লোন উঠিয়ে বেশ কয়েকটি অটোরিকশা কিনে ফেলি এখন আমার মোট ১১ টা অটো রিক্সা আছে।"
মিরপুর ১ নম্বরে নারী অটোচালক রুনা বেগমের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, 'দুই বছর আগে স্বামী ডিভোর্স দিয়ে অন্যত্র চলে গেছে দুই সন্তান নিয়ে খুবই কষ্টে দিন যাপন করতেন তিনি। পড়াশোনা না জানা থাকায় তেমন কোন চাকরি পাননি ও বাচ্চাদের জন্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করা খুবই কষ্টদায়ক ছিল। তাই বাধ্য হয়ে এ পেশায় এসেছেন তিনি। এখন অটোরিকশার আয় দিয়ে দুই সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন এবং নিজে একটি অটোরিকশা চালান ও আরেকটি ভাড়ায় দিয়েছেন। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, "অনেকেই অনেক ধরনের মন্তব্য করে কিন্তু আমি তো আর খারাপ কাম করতেছি না পর্দার ভিতর থেকে বোরখা পড়ে সৎ পথে আয় করে খাচ্ছি আর সরকার যেন আমাগো অটো রিক্সা বন্ধ না করে দেয়।"
একটি বেসরকারি ব্যাংকে নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি করতো রুবেল। ৮ হাজার টাকা বেতন পেতো। চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন অটোরিকশা চালান রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায়। প্রতিদিন ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা আয় করেন ও সপ্তাহে একদিন ছুটি কাটান। এ পেশায় কষ্ট কম ভালো ইনকাম তাই অটো চালান বলে জানান তিনি।
ধানমন্ডিতে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তিনি।দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় এক মাস পর পর ১০-১৫ দিন ঢাকায় এসে অটো রিক্সা চালান তিনি।পরিশ্রম কম ও দ্রুত সময় ভালো কিছু টাকা ইনকাম করে পরিবারকে সহায়তা করছেন ও নিজের পড়াশোনার খরচ যোগাচ্ছেন। অটোরিক্সা চালিয়ে শিক্ষার্থী বলেন, "পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই মুহূর্তে একটি স্থায়ী চাকরি করা সম্ভব না তাই এই কাজ করি।"
একটি সুপারশপে চাকরি করতেন শাহাদাত। সেখানে নয় হাজার টাকা বেতন পেতেন। সংসারে বাবা অসুস্থ ও চার ভাই বোনের সংসার হওয়ায় খুব অর্থ কষ্ট ছিলেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভাড়ায় চালিত একটি অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। চাকরি থেকে লাভজনক হওয়ায় চাকরিতে আর ফিরে যান নি তিনি। কয়েক মাস অটো চালিয়ে কিছু টাকা জমিয়ে নিজেই কিনে ফেলেছেন একটি অটোরিকশা। এখন পরিবার নিয়ে আগের থেকে অনেক ভালো আছেন ও শারীরিকভাবে তেমন কোন পরিশ্রম হয় না বলে জানান তিনি। তবে তিনি দিনে চালান না রাতে চালান বলেন, রাতে ভাড়া বেশি পাওয়া যায় ও সূর্যের তাপ থাকে না তাই কষ্ট আরো কম হয়।
রাজধানীর আগারগাঁও কথা হয় শরিফুলের সঙ্গে। আগে মোটরসাইকেলের রাইড শেয়ার করতেন এখন অটোরিকশা চালান। তিনি বলেন, 'রাইড শেয়ার করে আয়ের একটা অংশ দিয়ে দেওয়া লাগতো কোম্পানিকে এছাড়াও রাস্তায় নানা ধরনের ঝামেলা থাকতো হয়রানি হতে হত তাই মোটরসাইকেল বিক্রি করে দিয়ে এখন ব্যাটারি চালিত অটো রিক্সা চালান।' তিনি আরও বলেন, অটো রিক্সা বন্ধ করলে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে যাবে তাই এটার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার নিয়ন্ত্রণ করুক এটা যদি বন্ধ করে অনেক মানুষ বেকার হয়ে যাবে।
রাজধানীর বসিলায় নোমান অটো ওয়ার্কশপ নামে একটি দোকান খুলে বসেছেন তৈবুর রহমান। কিভাবে অটো রিক্সা তৈরি করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এর বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সব চায়না থেকে আসে চকবাজারে কিনতে পাওয়া যায়। আমরা শুধু ফিটিং করে তৈরি করি একটি অটোরিক্সা তৈরি করতে খরচ হয় ৭০ থেকে ৭২ হাজার টাকা। আর ৮০ হাজার ৮৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।" অটোরিকশা চাহিদা কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, "চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। চাকরির বেতন দিয়ে মানুষের চলে না। ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি ভালো না তাই অনেকেই চাকরি ও ছোটখাটো ব্যবসা বাদ দিয়ে এ পেশায় যুক্ত হচ্ছে।" এছাড়াও রাজধানীর মুগদা কেরানীগঞ্জ মোহাম্মদপুর মিরপুর টঙ্গী গাজীপুর সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে এই ধরনের অটোরিকশা তৈরির কারখানা।
ব্যাটারি চালিত অবৈধ অটোরিকশার জন্য রাজধানীতে লেগেই থাকে যানজট কারণ এই চালকরা কোন নিয়ম-নীতি মানেন না, যার প্রেক্ষিতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। তবে বিশিষ্টজনদের মত এটা এখন আর বন্ধ করা সম্ভব না। কঠোর আইন ও কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করে ব্যাটারিচালিত অটো রিকশাকে একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা উচিত, না হলে এই অবৈধ অটো রিক্সার জন্য সড়কে মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। আর যেহেতু এই পেশায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মানুষ যুক্ত হচ্ছে তাই এটা বন্ধ না করে সরকারের উচিত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে এদেরকে যতটুকু সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখা।
ইকবাল অভি