
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির উদ্যোগ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাড়াতে বেশকিছু দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি বা পিটিএ করার উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। এরই ধারাবাহিকতায় এবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) করার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আলোচনায় রাজি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই চুক্তি হলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে একটি সম্ভাবনাময় মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
এমন একটি চুক্তি কার্যকর হলে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবাহে নতুন গতি সঞ্চার হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন আরোপিত বাড়তি শুল্ক প্রত্যাহার বিষয়ে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যেখানে বাণিজ্য সচিবও ছিলেন। বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এফটিএ স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তাব করে ঢাকা। এতে সম্মতি দিয়ে বাংলাদেশের কাছে চুক্তির খসড়া চেয়েছেন ইউএসটিআর কর্মকর্তারা।
বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১২ মে একটি আট সদস্যের কমিটি গঠন করেছে, যার কাজ হচ্ছে প্রস্তাবিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) খসড়া তৈরি করা। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ)-কে প্রধান করে গঠিত কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে খসড়া প্রণয়ন করে বাণিজ্য সচিবের কাছে দাখিল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি ও বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে দেশের মোট রপ্তানির ১৭.০৯ শতাংশ, এবং তৈরি পোশাক রপ্তানির ১৮ শতাংশের বেশি যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট ওভেন পোশাকের প্রায় ২৬ শতাংশ, নিটওয়্যারের ১১.৭১ শতাংশ এবং হোম টেক্সটাইল পণ্যের ১৬.১২ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়।
তৈরি পোশাক খাতের (আরএমজি) খাতের ব্যবসায়ী নেতারা উল্লেখ করেন, এই খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ, যেমন ভিয়েতনাম ও ভারত ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) প্রস্তাব করেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে মাত্র ৭ শতাংশ শুল্কের সুবিধা পাচ্ছে ভিয়েতনাম, যেখানে বাংলাদেশকে ১৫ শতাংশেরও বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বড় খবর। প্রক্রিয়াটি দ্রুত করতে যুক্তরাষ্ট্র এরমধ্যেই চুক্তির একটি খসড়া চেয়েছে। তিনি বলেন, ‘ইতোপূর্বে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রকে এফটিএ স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তখন তারা এতে আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু এবার তারা রাজি হয়েছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় সংবাদ।
আমরা নেগোসিয়েশন (আলোচনা) শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি আরও জানান, প্রস্তাবিত এফটিএর খসড়া তৈরির জন্য আমরা একটি কমিটিও গঠন করেছি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে তাদের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ তুলা, স্ক্র্যাপ, সয়াবিন ও কৃষিপণ্য আমদানি করে, যার বেশিরভাগ হয় শুল্কমুক্ত, না হয় সামান্য শুল্কে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাই দেশটির সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষর হলে, বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণে খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।’ উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের আগে পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকখাত অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
প্রায় ১৫.৫০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে দেশটিতে। এই পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নেয় যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর, ট্রাম্পের প্রশাসন বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছে। ঢাকার অনুরোধের প্রেক্ষিতে যা বর্তমানে তিন মাসের জন্য স্থগিত রেখেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরে রাজি হলে তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য খুবই ভালো খবর। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মেধাস্বত্ব অধিকার, শ্রম মানদ-, পরিবেশগত বিধিমালা ও ব্যবসার সার্বিক পরিবেশ উন্নত করতে হবে।
এদিকে, গত অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭.৬০ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশটিতে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭.১৯ বিলিয়ন ডলার, যা এই সময়ে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ১৭.৮৭ শতাংশ। যার বিপরীতে, গত অর্থবছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ২৮ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এর পরিমাণ ২২ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানানান, বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে ১৩ মে একটি স্টেকহোল্ডার সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রস্তাবিত পাল্টা শুল্ক এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি, এফটিএ সইয়ের কৌশল ও প্রক্রিয়া নিয়েও আলোচনা হয়। এফটিএ স্বাক্ষর করে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার বিপরীতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায়ের প্রস্তাব করা হবে।