
প্রাথমিকের খুদে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির অর্থ বাড়েনি
প্রাথমিকের খুদে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির অর্থ বাড়েনি। কিন্তু কমেছে উপবৃত্তিভোগীর সংখ্যা। মাত্র চার বছরে উপবৃত্তিভোগী শিক্ষার্থী কমেছে ১১ লাখ। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপবৃত্তির টাকার পরিমাণ এখন শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করছে না। যে কারণে সরকারি প্রাথমিক থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। এর ফলেই প্রতিবছর এই সংখ্যা কমতে থাকছে। এ ছাড়াও প্রাথমিকে পড়ুয়া অন্তত ১০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্মনিবন্ধন নেই বলে জানিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এর ফলে লাখো শিক্ষার্থী উপবৃত্তির জন্য আবেদন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপবৃত্তি শাখা বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথম জুন মাসে উপবৃত্তি শিক্ষার্থীর চাহিদা ছিল ৯৭ লাখ। এরপর জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তা কমে আসে ৯৫ লাখে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে এই চাহিদা ছিল ৯৩ লাখ। পরে তা কমে দাঁড়ায় ৯১ লাখে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুন পর্যন্ত উপবৃত্তি দেওয়া হয় ৮৯ লাখ শিক্ষার্থীকে।
কিন্তু বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সেটি কমে দাঁড়ায় ৮৭ লাখে। এরপর ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জুন পর্যন্ত উপবৃত্তি দেওয়া হয়েছে মাত্র ৮৬ লাখ শিক্ষার্থীকে। অর্থাৎ কয়েক বছরেই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী উপবৃত্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র বলছে, শুধুমাত্র উপবৃত্তিভোগী কমেছে বিষয়টি এমন নয়। এর বাইরে আরও ১০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে যারা জন্মনিবন্ধন জটিলতায় ভুগছে। ফলে উপবৃত্তির জন্য আবেদনের যোগ্যতা হারিয়েছে। এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দ্রুত সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংস্কারে গঠিত পরামর্শক কমিটির প্রধান ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, উপবৃত্তিভোগী কমছে মানে সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীও বাড়ছে না। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, এই উপবৃত্তি আসলে সেভাবে কাজে আসছে না। শিক্ষার্থীদের মাসিক এই অর্থ কি কাজে আসছে কমিশন তার যথার্থতাও খুঁজে পায়নি। বরং দেখা যাচ্ছে এই উপবৃত্তি দেওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের নানামুখী কাজ বেড়েছে।
তাদের পাঠদানে বিঘœ ঘটছে। এর চেয়ে প্রকৃত হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের বাছাই করে তাদের শিক্ষা উপকরণ এবং বৃত্তির হার বাড়ানো গেলে প্রাথমিক শিক্ষায় সুফল পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়াও মিড ডে মিল ও শিক্ষা উপকরণও ভাল কাজে আসবে। এ ছাড়াও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এই অর্থ দেওয়ায় সঠিক উপকারভোগী ঠিকমতো অর্থ না পাওয়া ও দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।
জন্মনিবন্ধন না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একটু উদ্যোগী হলেই খুব সহজেই এই বিষয়ে সমাধান সম্ভব। কিন্তু তাদের সদিচ্ছা কতটুকু রয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন।
সবশেষ চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের তথ্য এসেছে, তাতে সারাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটি তিন লাখের কিছু বেশি। তাদের মধ্যে উপবৃত্তির চাহিদা রয়েছে ৯৩ লাখ শিক্ষার্থীর। যদিও নানা কারণে এর মধ্য থেকে অনেকে বাদ পড়তে পারে। অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রতি অর্থবছরে দুই ধাপে (ছয় মাস পরপর) উপবৃত্তির টাকা পরিশোধ করা হয়।
জুলাই-ডিসেম্বর প্রথম ধাপ এবং জানুয়ারি-জুন দ্বিতীয় ধাপ। সবশেষ জানুয়ারিতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ধাপের উপবৃত্তি পরিশোধ করা হয়। তাতে সরকারের খরচ হয়েছে প্রায় ৭১৪ কোটি টাকা। এ ধাপে উপবৃত্তির টাকা পেয়েছে ৮৬ লাখের কিছু বেশি শিক্ষার্থী।
বর্তমানে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন হারে উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছে। নতুন করে উপবৃত্তির হার বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের উপবৃত্তি শাখার তথ্যমতে, বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিকের একজন শিক্ষার্থী মাসিক ৭৫ টাকা হারে উপবৃত্তির টাকা পায়।
প্রাথমিকে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১৫০ টাকা এবং যেসব স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে চালু রয়েছে, সেখানে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টমের শিক্ষার্থীরা ২০০ টাকা হারে মাসিক উপবৃত্তি পায়। বছরে দুইবার (ছয় মাস পরপর) মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নগদের মাধ্যমে এ উপবৃত্তির টাকা দেওয়া হয়। এই সময়ে উপবৃত্তির অর্থ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদের বিষয়েও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অডিট করছে।
উপবৃত্তি শাখার কর্মকর্তা (শিক্ষা অফিসার) মো. জিয়াউল কবির সুমন জানান, নতুন প্রস্তাবে সবার জন্য সমান হারে উপবৃত্তি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাব অনুমোদন হলে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিকের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা মাসিক ৩০০ টাকা হারে (ছয় মাসে ১৮০০ টাকা) উপবৃত্তির টাকা পাবে। তবে এর সম্ভাবনা নিয়ে খোদ দপ্তরের কর্মকর্তারাই আশাবাদী নন।
প্রাথমিক শিক্ষা, ঝরে পড়া নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। রাশেদা কে চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, উপবৃত্তি এখন শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করে স্কুলে টানতে পারছে না। প্রাথমিক থেকে যে শিক্ষার্থী ঝরে যাচ্ছে এই শিক্ষার্থী কোথায় যাচ্ছে এটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেন।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, চা বাগানে একজন শিক্ষার্থী প্রাথমিক শেষ করে নি¤œ মাধ্যমিকে ভর্তি হতে ১৩ হাজার টাকা অর্থ ব্যয় করতে হয়। যার দুটো সন্তান রয়েছে তার অবস্থা চিন্তা করা যায় না। মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের টানতে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি বলেও তিনি মনে করেন। তার মতে, প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকের সন্তানরাই সেই স্কুলে পড়ে না।
প্রাথমিক অধিদপ্তরের যেসব কর্মকর্তা আছেন তাদের সন্তান কোথায় পড়েন? এমন বৈষম্যের মাধ্যমে একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত মজবুত করা কখনো সম্ভব নয়।
জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আসছে। আমরা শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়াতে চাই। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে চাই। প্রাথমিক স্তরে তাদের শক্ত ভিত তৈরি করে দিতে চাই। সেজন্য উপবৃত্তির টাকার পরিমাণটা বাড়ানো নিয়ে কাজ চলছে। আশা করি, শিগগির সেটা সম্ভব হবে।