
গ্রামের শান্তিপ্রিয় ও নিরীহ মানুষগুলো প্রায় বিভিন্ন কারণে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। যার মধ্যে জমি সংক্রান্ত বিরোধ অন্যতম। এদেশে প্রায় প্রতিটি গ্রামের মানুষ নিজেদের মধ্যে অথবা পাশের গ্রামের মানুষের সঙ্গে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ে। গ্রামগুলোতে কিছু বিরোধপূর্ণ জমি অথবা নিরীহ কৃষকদের জমি দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে গ্রামের প্রভাবশালীরা। কারও জমির দলিল আছে কিন্তু দখল নেই, কারও কাছে দখল আছে কিন্তু জমির দলিল নেই। তা ছাড়া কিছু অসাধু ব্যক্তি গ্রামের অশিক্ষিত মানুষগুলোর কাছে জমি বিক্রি করে টাকা নেয় কিন্তু দলিল না দিয়ে নানা রকম টালবাহানা করে। অনেকেই দলিল পরে দেওয়ার কথা বলে অথবা জাল দলিল দেয়। এসব অসাধু মানুষ একই জমি বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করে অথবা সরকারি বা জোরপূর্বক দখল করা জমি জাল দলিল দেখিয়ে অন্যের কাছে বিক্রি করে দেয়। পরে জমির প্রকৃত মালিক জমির মালিকানা দাবি করলে শুরু হয় বিরোধ। প্রতারণার শিকার হয়েছে জেনেও অনেকেই নিজের কষ্টে উপার্জিত টাকা দিয়ে কেনা জমি ছাড়তে চায় না, একরকম গায়ের জোর দেখিয়েই দখল টিকিয়ে রাখতে চায়।
তা ছাড়াও গ্রামের প্রভাবশালীরা গ্রামের অশিক্ষিত অসহায় কৃষকদের টার্গেট করে তাদের জমির জাল দলিল বানিয়েও দখল করার চেষ্টা করে। জমির প্রকৃত মালিক দখলে বাধা দিলে, সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেয় কৃষকের ওপর হামলা করতে। অনেক সময় তারা শুধু কৃষকের ওপর হামলা করেই ক্ষান্ত হয় না, বাড়িঘরেও ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। নিরপরাধ কৃষককে বাঁচাতে তার আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরা প্রতিরোধ করলে শুরু হয় সংঘর্ষ। প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যাওয়া সেই অসাধু ব্যক্তি নিজের পরিবার, অত্মীয়-স্বজনের কাছে হামলার মিথ্যা গল্প সাজিয়ে নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে এবং তাদের প্রতিশোধ নিতে উস্কানি দেয়। অনেকেই সেই ফাঁদে পা দিয়ে দলবল নিয়ে পুনরায় হামলা করে এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে যা আগুনের লেলিহান শিখার মতো পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। আর এভাবেই গ্রামের এক বংশ অপর বংশের সঙ্গে, এক গ্রাম অন্য গ্রামের সঙ্গে এবং এক জাতি অন্য জাতির সঙ্গে মারামারি খুনাখুনিতে লিপ্ত হয়। ধারালো অস্ত্র, চাপাতি, রামদা, লাঠি ও বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র হাতে একে অপরের প্রাণ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। অনেক সময় দুটি গ্রামের দুজন ব্যক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে গ্রাম দুটির সকল মানুষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এসব সংঘর্ষে প্রাণ যাচ্ছে শুধু সাধারণ মানুষের। আহত হচ্ছে নারী, পুরুষ এবং শিশুরা। সংঘাতের বিভীষিকা শিশুদের মনে ও মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব ফেলে। যে মানুষের বিরোধপূর্ণ জমিতে ন্যূনতম অংশীদারিত্ব থাকে না তারও বাড়িঘর আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বাড়িঘর হারানোর কষ্টের সঙ্গে আসে মামলা, পুলিশের ভয় এবং গ্রেপ্তার আতঙ্ক। নিজের পরিবারের আর্থিক ক্ষতি সামলে ওঠার আগেই মামলার কারণে জেল- জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়।
সিজিএস এর তথ্য মতে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশে মোট ২০ হাজার ৪৬৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছিল যার মধ্যে ১২১০টি খুন হয়েছিল জমি সংক্রান্ত বিরোধের কারণে। সংখ্যাটা বর্তমানে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর আওয়ামী নেতাদের দখলে থাকা জমিগুলো বৈধ মালিকেরা পুনরায় দখল করতে গিয়েও ব্যাপক সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। মারামারি ও সংঘাতের কারণে গ্রামের নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়, আহত হয়, ঘরবাড়ি পুড়ে। তার বিনিময়ে তারা কিছুই পায় না। পায় শুধু শারীরিক ক্ষতি, পঙ্গুত্ব, মামলা, আর্থিক ক্ষতি এবং নিজের পরিবারের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
জমির বৈধ দলিল থাকা সত্ত্বেও যারা জমির দখল নিতে পারে না অথবা সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবের মুখে দখল হারায়, তাদের মধ্যে অনেকেই সংঘাত ও সহিংসতার পথ ছেড়ে প্রশাসনের শরণাপন্ন হয় এবং আদালতে মামলা দায়ের করেন। ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩ সনের ৩৬ নং আইনের ৭ নং ধারা অনুযায়ী, সর্বশেষ খতিয়ান মালিক অথবা তার নিকট হতে উত্তরাধিকার সূত্রে বা হস্তান্তর বা দখলের উদ্দেশ্যে আইনানুগভাবে সম্পাদিত দলিল বা আদালতের মাধ্যমে মালিকানা না হয়েও কোনো ব্যক্তি উক্ত ভূমি স্বীয় দখলে এবং আইনানুগভাবে দখলে অধিকার প্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিকে আদালত বা কর্তৃপক্ষের আদেশ ব্যতীত তার ভূমি থেকে উচ্ছেদ করলে বা দখলে বাধা দিলে অনধিক ২ বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। কিন্তু মামলার নিষ্পত্তি হতে ও ন্যায়বিচার পেতে ব্যক্তির জীবনের আয়ু ফুরিয়ে যায়, মামলার হাল ধরে তার সন্তানেরা। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার কারণে আদালতের দ্বারে-দ্বারে ঘুরতে ঘুরতে শুধু জুতাই ক্ষয় হয় মানুষের। কিন্তু বিচারের রায় হয় না।
২০২৪ সালে ৬ মে জাতীয় সংসদে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছিলেন দেশের ৬৪ জেলায় দেওয়ানি মামলার সংখ্যা ১৫ লাখ ৯৬ হাজার ৪৪১টি। অধিক সংখ্যক মামলার জট থাকার কারণে বিচারিক প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। ন্যায়বিচার পেতে দীর্ঘ সময় লাগা, পদে পদে ভোগান্তি ও বছরের পর বছর পড়ে থাকতে থাকতে বড় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় পরিবারগুলো। আর এই দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া সংঘাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অসাধু ব্যক্তিগুলো জোরপূর্বক দখল করে নিরীহ মানুষদের এমন আদালতের দ্বারে-দ্বারে ঘুরিয়ে জমি ভোগ করতে থাকে।
জমির বিরোধের জেরে ঘটতে থাকা সহিংসতা, প্রাণহানি ও রক্তপাত এড়াতে দ্রুত দেওয়ানি মামলার নিষ্পত্তি যেমন প্রয়োজন তেমনি জনসচেতনতা বৃদ্ধিও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেশীর বিপদে সাহায্য করা মানেই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা নয়। জমি নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হলে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে। সংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দিলে পুলিশে খবর দেওয়া এবং যে কোনো সহিংস কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পুলিশের সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়া ও পুলিশের উদাসীনতায় এসব সংঘাত ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। পুলিশ ও প্রশাসনের দ্রুত এবং কার্যকর ভূমিকা পালন, সংঘাতপূর্ণ এলাকায় পুলিশ মোতায়েনসহ অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করলে এসব সংঘাত ও প্রাণহানি অনেকাংশেই এড়ানো সম্ভব।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ
প্যানেল