ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি

কাজি সুমাইয়া

প্রকাশিত: ২০:০৬, ৮ মে ২০২৫

শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি

শ্রমিক বলতে বোঝানো হয় সেইসব পরিশ্রমী মানুষদের, যারা নিজেদের শারীরিক বা মানসিক শ্রম দিয়ে কোনো পণ্য উৎপাদন, নির্মাণ, পরিবহন, পরিষেবা কিংবা বিভিন্ন সেবামূলক খাতে কাজ করেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তারা কৃষি ক্ষেত্র থেকে শুরু করে তৈরি পোশাক শিল্প, নির্মাণ, কলকারখানা, পরিবহন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, এমনকি ঘরোয়া পরিবেশেও নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। শ্রমিকদের অবদানের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে দেশের অবকাঠামো, প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে, রপ্তানি খাত শক্তিশালী হয়েছে এবং বেকারত্ব কিছুটা হলেও কমেছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান আজ বিশ্বে অন্যতম। ইউরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে যে হাজার কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি হয়, তার মূল ভিত্তি আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণি। হাজার হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক প্রতিদিন কাজ করেন এই খাতে, যাদের ঘামে এবং নিষ্ঠায় দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এই শ্রমিকরা কি তাদের যথার্থ অধিকার পাচ্ছেন? তারা যে শ্রম দিচ্ছেন, তার বিনিময়ে কি সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারছেন?
বর্তমানে দেশের বহু কারখানা ও প্রতিষ্ঠান এমন বাস্তবতার মধ্যে শ্রমিকদের রেখে দিয়েছে, যা এক ধরনের মানসিক ও শারীরিক শোষণের সমান। অনেক প্রতিষ্ঠানে দৈনিক ৮ ঘণ্টার কাজের নিয়ম থাকলেও শ্রমিকদের ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করা হয়। ওভারটাইম কাজ করিয়ে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। অনেক সময় মাসের বেতন মাস শেষে দেওয়া হয় না, এমনকি দুই-তিন মাস পর্যন্ত আটকে রাখা হয়। এতে শ্রমিকদের পরিবারে নেমে আসে অনিশ্চয়তা, দারিদ্র্য এবং চরম মানসিক চাপ। একটি বড় সমস্যা হলো নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব। অনেক কারখানায় পর্যাপ্ত আলো-বাতাস নেই, নেই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা। আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত উপকরণ না থাকায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে অনেক প্রাণহানি ঘটে। বিশুদ্ধ পানি, শৌচাগার, বিশ্রামের ব্যবস্থা, নারী কর্মীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি, নিরাপত্তাÑ এসব মৌলিক মানবিক সুবিধাও অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।আরও একটি চর্চা লক্ষ্য করা যায় যখন কোনো শ্রমিক অসুস্থ হন বা পারিবারিক কারণে ছুটি নিতে চান, তখন তার বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয় বা ছুটি বাতিল করা হয়। এতে শ্রমিকরা বাধ্য হন অসুস্থ অবস্থাতেও কাজ করতে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক শ্রমিক বার্ধক্যে পৌঁছে গিয়ে কর্মক্ষমতা হারালে তারা আর্থিক সংকটে পড়েন। কারণ কোনো পেনশন স্কিম বা ভবিষ্যতের নিরাপত্তা তাদের জন্য নেই।শ্রমিকদের অধিকার বলতে বোঝানো হয় সেইসব মৌলিক সুবিধা ও নীতিগত সুরক্ষা, যা একজন শ্রমিককে সুনিশ্চিত জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলোÑ ন্যূনতম মজুরি, নির্ধারিত সময়ে কাজ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা, চিকিৎসা সুবিধা, আবাসন, পরিবহন, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, পেনশন ও বয়োজ্যেষ্ঠ শ্রমিকদের জন্য পুনর্বাসন। সরকার ইতোমধ্যে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করেছে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই তার বাস্তবায়ন প্রশ্নবিদ্ধ। একটি পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণে যথেষ্ট মজুরি নির্ধারণ করা এবং সেটি বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি রাখা অত্যন্ত জরুরি।দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের নিয়ম বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ওভারটাইম থাকলে তার জন্য অতিরিক্ত পারিশ্রমিক নির্ধারিত হারে দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই। কারখানার নারী শ্রমিকদের জন্য আলাদা বিশ্রামাগার, শিশু দিবা যত্নকেন্দ্র, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ও নিরাপত্তা থাকা আবশ্যক। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার জন্য পেনশন স্কিম চালু করা উচিত। যাতে কর্মজীবন শেষে কোনো শ্রমিক দারিদ্র্য বা অনিশ্চয়তার মধ্যে না পড়েন। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যৌথভাবে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও নেওয়া যেতে পারে। শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা কেবল মানবিক নয়, বরং রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাদের প্রতি দায়িত্বশীল না হলে অর্থনীতি টিকবে না, শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। মালিকপক্ষ এবং সরকার উভয়কেই এ বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে। মালিকপক্ষ যেন কোনোভাবেই শ্রমিকদের শোষণ না করে, বরং তাদের প্রকৃত মূল্যায়ন করে এমন নীতিমালা নিশ্চিত করা জরুরি। শ্রমিকরাও দেশ ও শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাদের প্রতি সম্মান দেখানো মানেই জাতির ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা। জাতীয়ভাবে শ্রমিক দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আমরা যতই শ্রদ্ধা জানাই না কেন, বাস্তবিক অধিকার নিশ্চিত না হলে তা কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, শ্রমিকরা যদি একদিন কাজ বন্ধ করে দেন, তাহলে দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে যাবে। উৎপাদন বন্ধ হবে, রপ্তানি থেমে যাবে, এমনকি সাধারণ নাগরিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই শ্রমিকদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া ও তাদের ন্যায্য চাহিদাগুলো পূরণ করাই দেশের টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি।
একটি দেশের উন্নয়নের পেছনে যদি শ্রমিকদের শ্রম থাকে, তবে তাদের অধিকার নিশ্চিত করাটাই সেই উন্নয়নকে টিকিয়ে রাখার প্রথম শর্ত। শুধু পোশাক শিল্প নয়, সকল খাতে কর্মরত শ্রমিকদের প্রতি মানবিকতা, ন্যায়বিচার ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ এখন সময়ের দাবি। মালিকপক্ষ, সরকার ও সমাজ সবার সম্মিলিত উদ্যোগেই একটি ন্যায্য, মানবিক ও টেকসই শ্রমনীতি গড়ে তোলা সম্ভব। শ্রমিকের শ্রমেই দেশের সমৃদ্ধি। আর সেই সমৃদ্ধিকে টিকিয়ে রাখতে হলে আজই শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

 লেখক : শিক্ষার্থী, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা

[email protected]

প্যানেল

×