ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৮ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

প্রসঙ্গ ইসলাম

হজ ॥ ইতিহাসের পথ পরিক্রমায়

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ১৯:৩৭, ৮ মে ২০২৫

হজ ॥ ইতিহাসের পথ পরিক্রমায়

ঈদুুল ফিতরের বাঁকা চাঁদের মাস পবিত্র শাওয়াল। ৬ রোজার মাস শাওয়াল শেষ করে আমরা হজের প্রস্তুতি মাস জিলকদে উপনীত। শাওয়ালও হজের যাতায়াতের জন্য সুসংবাদপ্রাপ্ত মাস। শাওয়াল জিলকদ জিলহজ- আশহুরুল হুরুম বা সম্মানিত হারাম মাসের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র হজের গমনাগমনের জন্য আল্লাহ পাক এই মাসগুলো নির্ধারণ করেছেন এবং এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র ঘরের জিয়ারতকারীদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। চলছে জিলকদ, সামনে জিলহজ মাস। জিলহজ মানে হজের মাস। আরবি বা হিজরি সনের সমাপনী মাস এটি। এই মৌসুম আসলেই আবহমানকাল থেকে তাওহীদবাদী মানুষেরা পবিত্র হজ সম্পাদনের জন্য বিশ্বের চতুর্দিক থেকে পবিত্র মক্কা নগরীতে সমবেত হতে থাকেন। হজ মানবজাতির প্রাচীনতম ইবাদত ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ব মানব সম্মেলন। আল্লাহ তায়ালার ঘরের সংস্পর্শে এসে মানুষ মহামহিম স্রষ্টার সান্নিধ্য খুঁজে ফিরেন। মানুষ স্বভাব প্রেমিক। তাই বরাবরই সে এমন একটা অবলম্বন ও আশ্রয় পেতে চান, যার সান্নিধ্যে এসে সে তার প্রেমিক হৃদয়ের আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে শান্ত ও তৃপ্ত করতে পারেন। পার্থিব জীবনের কোলাহল ও জটিলতায় বিপর্যস্ত মানুষ নিজেকে তখন নিমগ্ন করে দিতে চান ব্যতিক্রমধর্মী ও দীর্ঘমেয়াদি কোনো উপাসনা কর্মকাণ্ডে। যা মুছে দেবে তার জীবনের বড় বড় অপরাধ ও পদস্খলন, জন্ম দিনের মতোই সে হয়ে উঠবেন নিষ্পাপ ও পবিত্র।
আবহমানকাল থেকে মানবমনের এ চাহিদা পূরণ করে আসছে ‘হজ’। আরবি ভাষায় ‘হজ’ শব্দের অর্থ- জিয়ারতের সংকল্প করা। যেহেতু খানায়ে-কাবা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে তাবৎ প্রেমিক-ভক্তগণ পৃথিবীর চারদিক হতে পঙ্গপালের মতো এসে পবিত্র মক্কা নগরীতে জমায়েত হন, তাই এর নাম রাখা হয়েছে হজ। কখন কিভাবে হজ সূচনা হয়েছিল এবং যুগে যুগে এ হজব্রত পালনের প্রকৃতি কেমন ছিল, সে ইতিহাস অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এবং শিক্ষাপ্রদ।
হজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুকন। পবিত্র স্থানসমূহ দর্শন এবং সে স্থানগুলোতে বিশেষ রীতিনীতি শিষ্টাচারের সঙ্গে অনুষ্ঠান পালনের প্রথা প্রাচীনকাল থেকে চালু রয়েছে।  সকল ধর্মের অনুসারীদের নিকট কোনো না কোনো স্থান রয়েছে যেগুলোকে তারা পবিত্র বলে মনে করে থাকেন। সেসব স্থানে গিয়ে তারা নিজ নিজ আকিদা ও বিশ্বাস অনুসারে ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহ পালন করে থাকেন। আহলে কিতাবের মাঝে ইহুদিদের মধ্যে পবিত্র স্থানসমূহের জিয়ারতের প্রথা পূর্বেও চালু ছিল। তারা বায়তুল মুকাদ্দাস কেন্দ্রিক বছরে তিন বার হাজির হয়ে এ অনুষ্ঠান পালন করত। খ্রিস্টানরা অনুরূপ অনুষ্ঠান পালন করত বায়তুল মুকাদ্দাস কেন্দ্রিক। সেই সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই বায়তুল মুকাদ্দাস তাদের তীর্থ উপাসনার শ্রেষ্ঠতম স্থানরূপে বিবেচিত। এভাবে হিন্দু-বৌদ্ধ ও অন্যান্য জাতির মাঝেও তীর্থ যাত্রার ইতিহাস রয়েছে।
ইতিহাস বলছে যে, দুনিয়ার প্রথম মানুষ আদি পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালামই সর্বপ্রথম নিষ্কলুষ হজ অনুষ্ঠানের শুভ-উদ্বোধন করেন। নবী আদমকে (আ.) যখন ধরাধামে প্রেরণ করা হয় এবং যখন তিনি মহান আল্লাহর দরবারে ফেরেস্তাদের প্রার্থনার শব্দ শুনতে না পাওয়ার অভিযোগ আনেন; আল্লাহ তাকে ‘বায়তুল্লাহ’ নির্মাণ করে এর তাওয়াফ করার হুকুম দেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন যে, ‘হজরত আদম হজ করেছেন এবং হজের সব অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছেন। তারপর আরজ করলেন- হে আল্লাহ প্রত্যেক সৎকর্মশীল ব্যক্তি প্রতিদান পায়; আমার প্রতিদান কি? আল্লাহ বললেন, হে আদম আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমার বংশধরদের মধ্যে যে এ ঘরে এসে গুণাহের জন্য তওবা করবে, আমি তাকেও ক্ষমা করে দেব।’-(বাইহাকী)
এরপর থেকে হজরত নূহ (আ.)-এর জমানার মহাপ্লাবনের সময় পর্যন্ত আদম সন্তানেরা পবিত্র কাবায় হজব্রত পালন করে। মহাপ্লাবনের সময় খানায়ে কাবাকে তুলে নেওয়া হলে মতান্তরে বিধ্বস্ত হলে এর পুনর্নির্মাণ ও পুনঃসংস্কারের উদ্দেশ্যে মনোনিবেশ করেন সাইয়্যিদেনা ইব্রাহীম (আ.) ও তার পুত্র ইসমাঈল (আ.)। তাদের যুগল প্রচেষ্টায় সুনিপুণভাবে তিলে তিলে গড়ে ওঠে ইসলামী জাহানের মহান প্রাণকেন্দ্র পূতপবিত্র ঘর খানায়ে কাবা। তারা দুজনেই আল্লাহ পাকের অপার অনুগ্রহ ও সাহায্য প্রার্থনা করে এর নির্মাণকাজে ব্রতী হন। দুই নবী সেদিন অশ্রুর বারি দিয়ে মরুর বালি সিক্ত করে তুলে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলেন: রাব্বানা তাকাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আনতাস সামিউল আলীম...। হে আল্লাহ তুমি আমাদের পক্ষ থেকে এ কাজ কবুল কর। নিঃসন্দেহে তুমি অতীব শ্রবণকারী মহাজ্ঞানী।’ সত্যিই আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করলেন। জগৎবাসীর জন্য এ ঘরকে মানবজাতির তীর্থ ও যুগকাল ধরে মহাসম্মেলনের স্থান বানিয়েছেন। এখন যেখান থেকে গগনবিদারী আওয়াজ উঠছে ..লাব্বাায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েকÑ হাজির! হে মহামহিম প্রভু। আমরা হাজির তোমার দরবারে।
উল্লেখ্য, ৮ম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর মুসলমানগণ প্রথম হজব্রত পালন করেন। ৯ম হিজরিতে হজরত রাসুলুল্লাহ বিশেষ কারণে হজে গমন করতে পারেননি। নবী করিম (দ.) আবু বকর সিদ্দিককে (রা.) ‘আমিরুল হজ’ নিয়োগ করেন। তিনি মুসলমানদের তিন শত কাফেলা নিয়ে হজের উদ্দেশ্যে রওনা হন। শেরে খোদা হজরত আলী ছিলেন এ কাফেলা নকীব। হজরত সা’দ, জাবের, আবু হুরায়রা (রা.) প্রমুখ ছিলেন মুয়াল্লিম। এ বছরেই সব শিরকি কার্যকলাপ দূরীভূত হয়। মুশরিকদের জন্য বায়তুল্লাহর হজ নিষিদ্ধ করা হয় এবং রাসুলুল্লাহর নির্দেশে সব উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। পরবর্তী বছর ১০ম হিজরি সনে আল্লাহর একত্ববাদের সর্বশেষ নিশানবরদার সেপাহসালার হুকুম আকরাম (দ.) লক্ষাধিক আল্লাহ প্রেমিক ভক্ত-অনুরক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে স্বীয় ‘বিদায় হজ’ সম্পাদন করেন।
শিরক-কুফরের কালিমামুক্ত হজরত ইব্রাহীম (আ.)-ইসমাঈল (আ.)-মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রবর্তিত পাক পবিত্র হজ পালনের মানসে সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হয়ে আজও প্রতিবছর লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান মক্কা নগরীতে লাব্বায়কা আল্লাহুমা লাব্বায়কার সুমধুর গুঞ্জন ধ্বনি ও মর্মস্পর্শী সুরে মরু আরবে বেহেস্তী সৌরব বিকিরণ করে থাকেন। কতই না সুন্দর সে আকুল করা-ব্যাকুল করা দৃশ্য
লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]

প্যানেল

×