
(গতকালের পর)
মিয়ানমারের এথনিক বা জাতিগত বিভক্তি মারাত্মক। মূল এথনিক গোষ্ঠী বা সংখ্যাগুরু হলো বর্মী বামার ৬৮ শতাংশ। আর ১৪টি সংখ্যালঘু এথনিক গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম হলো শান ৯ শতাংশ, কারেন ৭ শতাংশ, রাখাইন ৪ শতাংশ, চীন ২.৫ শতাংশ, মন ২ শতাংশ, কায়াহ ১.৮৩ শতাংশ এবং কাচিন ১.৫ শতাংশ। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সকলেই ২০২১ সাল থেকে বর্মী বামারদের জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। এসব সংখ্যালঘু জাতি গোষ্ঠীর অধিকাংশই দেশটির পশ্চিম-উত্তর ও পূর্বাঞ্চল তথা বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও লাওস সীমান্ত অঞ্চলে সরকারি সামরিক জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে লিপ্ত থাকে। এক সময় তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স (থ্রি বিএইচএ)। এদের মধ্যে জনবল, সামরিক শক্তি ও কৌশলের দিক থেকে সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন হচ্ছে আরাকান আর্মি (এএ)। বাকি দুটি হচ্ছে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মি ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি। ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স অপারেশন ১০২৭ কোড নামে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত সামরিক অভিযান পরিচালনা করে এবং ব্যাপক সাফল্য লাভ করে। এ সম্পর্কে গত ২০২৪ সালের ২৭ জানুয়ারি সংবাদ মাধ্যম এশিয়া টাইমসে ডেভিড স্কট লেখেন, ‘চায়না সাকসেস, ওয়েস্টার্ন ফেইলুর ইন রিভোলিউশনারি মিয়ানমার’ অর্থাৎ ‘বিপ্লবরত মিয়ানমারে চীনের সফলতা আর পশ্চিমাদের ব্যর্থতা’ শিরোনামে আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, গত তিন বছর ধরে একটা আকুতি ছিল মিয়ানমারের প্রতিরোধ আন্দোলনে বাইরে থেকে অস্ত্র দরকার। এ থেকে একটা ভুল আশা ছড়িয়েছিল যে, থাইল্যান্ডের মাধ্যমে ইউক্রেনের মতো মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবতা হলো মিয়ানমারের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নীরবে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে চীন। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের ওপর চীনের কৌশলগত সমর্থন না থাকলে অপারেশন ১০২৭ সফল হতো না।’
সুতরাং মিয়ানমারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিসরে সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় চীন। মিয়ানমারের ওপর চীনের প্রভাবকে স্পষ্টভাবে আলাদা করা যায়। ২০২৪ সালের আগ পর্যন্ত চীন মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও সরকারি জান্তা বাহিনীর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলছিল। দুপক্ষকেই ডেকে নিয়ে আলোচনার মধ্যে রাখছিল এবং উভয়পক্ষকেই একে অপরের ওপর চূড়ান্ত প্রাধান্য বিস্তার করার বিরুদ্ধে সীমারেখা টেনে দিচ্ছিল। মিয়ানমারের কোনো পক্ষই যেন মার্কিন প্রভাববলয়ের মধ্যে ঢুকতে না পারে এজন্যই চীন এমন ভারসাম্যমূলক কৌশল অবলম্বন করে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন চীন বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর শক্তির পাল্লা ভারি করতে সহযোগিতা করছে এবং তাদের মাধ্যমে চীনা স্বার্থরক্ষা করার গ্যারান্টি আদায় করছে। তবে এরপরও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ার সুযোগ কম। কেননা তাদের শেষ আশ্রয়স্থলই হলো চীন। সুতরাং আরাকান অধিকতর স্বায়ত্তশাসন লাভ করবে কি না কিংবা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা লাভ করবে কি না এবং রোহিঙ্গারা আরাকানে ফিরবে কি নাÑ এসব ইস্যুতে চীন হবে সবচেয়ে বড় নির্ধারক। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে সরকারি জান্তা বাহিনী হেরে যাচ্ছে কি না, দেশটি চীনের প্রভাব থেকে মুক্তি পেয়ে পশ্চিমের প্রভাববলয়ে ঢুকে পড়ছে কি না এবং মিয়ানমার বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে কি না- এসব বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনো আসেনি। আরাকান (রাখাইন) স্বাধীন হতে চাইলে তার জন্য অবশ্যই বৃহৎ শক্তিশালী দেশের প্রত্যক্ষ সমর্থন প্রয়োজন হবে। বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে চীনের বিরুদ্ধে রাশিয়া যাবে না। চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সামরিক সক্ষমতা ও সাহস ভারতেরও নেই। বাকি থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। কিন্তু এরা মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ না হওয়ায় তাদের ভর করতে হবে তৃতীয় একটি সীমান্তবর্তী দেশের ওপর। কিন্তু সেই তৃতীয় সীমান্তবর্তী দেশটি মিয়ানমার ইস্যুতে খুব সহজেই চীনের বিরুদ্ধে যেতে চাইবে না। আরাকানের স্বাধীনতা লাভের এটাই হলো সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ১৯৮৮ সালের পর থেকে মিয়ানমার যখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একেবারে কোণঠাসা হয়েছিল তখন চীনই ছিল মিয়ানমারের বেঁচে রাখার একমাত্র অবলম্বন। তাই মিয়ানমার জাতিসংঘের চাপ কিংবা মার্কিনি ও পশ্চিম ইউরোপের চোখ রাঙানি, অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা কোনোটাতেই পরোয়া করেনি। ফলে মিয়ানমারের ওপর সব আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ ব্যর্থ হয়েছে।
মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী দেশের ক্ষমতা গ্রহণকালে তাদের ভারতও সহযোগিতা করেছে। বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্রও বিক্রি করেছে। যদিও এতে উল্টো ভারতেরই ক্ষতি হয়েছে। নতুন অস্ত্রে বলীয়ান জান্তা সরকারের নিপীড়নে মিয়ানমারের চীন স্টেট থেকে হাজার হাজার কুকি-চিন নৃগোষ্ঠীর লোকজন ভারতের মনিপুর ও মিজোরাম রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে অনুপ্রবেশ করে। মনিপুর রাজ্যে সাম্প্রতিককালের অস্থিরতার জন্য ভারত এসব কুকি-চিনকে দায়ী করছে। ভারত অভিযোগ করে থাকে যে, মিয়ানমারের ভূখণ্ড থেকে মানব পাচার ও মাদকের চোরাকারবার মনিপুর পরিস্থিতিকে আরও অগ্নিগর্ভ করে তুলছে। কুকি-চিনরা মনিপুরের জায়গা-জমি দখল করে সেখানে আফিম চাষ করছে। এ নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের সৃষ্টি হয়েছে শীতল সম্পর্ক। উল্লেখ্য, ভারতের মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্যে আগে থেকেই অনেক স্বগোত্রীয় কুকি-চিন নৃগোষ্ঠীর লোকের বসবাস। এখন এদের সঙ্গে গৃহযুদ্ধকবলিত মিয়ানমার থেকে নতুন করে এসে যুক্ত হচ্ছেন কুকি-চিনরা। ফলে ভারত এখন মিয়ানমার সীমান্তে ১৬৪৩ কিলোমিটারজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ কাজ শুরু করেছে।
সুতরাং রাখাইনে নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি বা নতুন ব্যবস্থার উদ্ভব কিংবা মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতÑ এই তিন পক্ষ কীভাবে গ্রহণ করবে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। মিয়ানমার নিয়ে চীনের নিশ্চয়ই একটা নিজস্ব পরিকল্পনা আছে। বাহ্যিকভাবে দেখা যাচ্ছে, চীন মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী উভয়কে সহায়তা অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে, আবার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আলোচনার টেবিলেও বসাচ্ছে। চীন যদি মিয়ানমারের কোনো এক পক্ষকে একতরফাভাবে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয় তাহলে অন্য পক্ষ যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ভারতের পক্ষে চলে যেতে পারে। বিশেষ করে চীন যদি এই মুহূর্তে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে এখানকার সামরিক জান্তা রাশিয়ার বলয়ে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করবে। কেননা সাম্প্রতিককালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রাশিয়ার সাথে সুগভীর সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
এদিকে ভারতও মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে এবং অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যদিও তা চীনের তুলনায় অনেক কম। এখন পর্যন্ত ভারত মিয়ানমারে প্রায় ৭৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যার বেশিরভাগ অংশ তেল ও গ্যাস খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। ভারতের অন্যতম কৌশলগত প্রকল্প হলো ‘কালাদান মাল্টি-মডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প’। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের মিজোরাম রাজ্য থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সিত্তে সমুদ্রবন্দর হয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছানো যাবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত বোন রাজ্য বঙ্গোপসাগরে সরাসরি প্রবেশ করতে চায়। ফলে রাখাইনের সিত্তে সমুদ্রবন্দর ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিগণিত হবে। তবে ভারতকে শেষ পর্যন্ত চীন নির্মিত মিয়ানমারের সেই কাইয়াকফু গভীর সমুদ্রবন্দরকেই ব্যবহার করতে হবে। সুতরাং এসব সমীকরণের কারণে রাখাইনে কোনো ধরনের রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিবর্তন ভারতের জন্য বড় ধরনের নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। ভারত মিয়ানমারে বিনিয়োগ ও সে দেশের ভূমি এবং বন্দর ব্যবহারের সুযোগ হারাতে চাইবে না। স্বাধীন আরাকান (রাখাইন) রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে ভারত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-কক্সবাজারকে এড়িয়ে বিকল্প পথ হিসেবে মিয়ানমারের রাখাইনের ওপর দিয়ে তার পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে সরাসরি বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের যে পরিকল্পনা করেছে তা ভেস্তে যাবে। এছাড়া স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে মিয়ানমারের চীন রাজ্যের কুকি-চিন নৃগোষ্ঠীর জনগণ রাখাইনদের মতোই স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে পারে। তারা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরাম, মনিপুর ও মিয়ানমারের চীন প্রদেশ নিয়ে আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লড়াই শুরু করতে পারে। তাই ভারত চাইবে না মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক।
এখন তাহলে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশ কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে? প্রথমত রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কিংবা রাখাইন রাজ্যে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ সীমিত। কেননা বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে একটি কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্যে নিজেকে শামিল করে নিয়েছে। তাছাড়া মিয়ানমারের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং গৃহবিবাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে চীন। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ নিজে কিংবা অপর কোনো বৃহৎ শক্তির সহায়তায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে গেলে তা চীনের বাধায় ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে রূপ লাভ করবে। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের একটি প্রাথমিক ও মানবিক প্রচেষ্টা হলো কক্সবাজার ও রাখাইনের মধ্যে করিডর প্রতিষ্ঠা করা, যাতে রাখাইনের যুদ্ধপীড়িত জনগণকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া যায় এবং সেখান থেকে প্রাণ বাঁচাতে নতুন করে আর কেউ যেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ না করে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করতে হলে উভয় দেশের সম্মতি ও বোঝাপড়া প্রয়োজন। মিয়ানমার নিশ্চয়ই কোনো মানবিক করিডর দিতে রাজি থাকবে না। এমতাবস্থায় জোরপূর্বক মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা দুরূহ এবং অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তবে মিয়ানমারকে পাশ কাটিয়ে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে যদি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশকে একসঙ্গে একই ছাতার নিচে আনা যায়। বস্তুত বাংলাদেশ এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে আছে যে, মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়কেই হাতে রাখতে হবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এ বিষয়ে একমত হওয়া অনেক দূরের বিষয়। আর চীনের সম্মতি ব্যতিরেকে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় বাংলাদেশ মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তাতে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হাসিনা পরবর্তী যুগে বাংলাদেশ ভারতকে পরোয়া না করে সবেমাত্র স্বাধীনভাবে চীনের সঙ্গে খোলামেলা সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে রয়েছে। চীনের অনেক শিল্প-কলকারখানা এদেশে স্থানান্তরের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। এমতাবস্থায় মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে সেই সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তবে বাংলাদেশ মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে অনুমোদন করানোর উদ্যোগ নিতে পারে। অবশ্য সেক্ষেত্রে যে কোনো একটি দেশের ভেটো প্রয়োগে সে উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে। বিশেষ করে রাশিয়া কোনো অবস্থাতেই চাইবে না যে, করিডর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মিয়ানমার নাজুক অবস্থায় পড়ে যাক। তাই মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা বাস্তব রূপ দান করা সহজ কাজ নয়।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশের জন্য সর্বোত্তম উপায় হলো কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা। অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশের ভূকৌশলগত হাতিয়ার হলো বঙ্গোপসাগর। একে পুঁজি করেই বাংলাদেশ চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে দেনদরবার করতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হতে পারে। এটা স্পষ্ট যে, রোহিঙ্গারা মুসলিম হওয়ার কারণেই তাদের ওপর পরিচালিত হয় গণহত্যা। এ বিষয়টি ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ অপরাপর মুসলিম দেশ জানে এবং তারা অতীতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। তাছাড়া মালয়েশিয়াতেও অনেক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোক আশ্রয় নিয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ ওআইসিকে যেমন সক্রিয় করতে পারে, তেমনি আসিয়ানের সদস্যপদ লাভের পর সেখানেও ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে। উল্লেখ্য, মিয়ানমার আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্র। তাই মিয়ানমারকে চাপে রাখতে হলে বাংলাদেশের জন্য আসিয়ানের সদস্যপদ লাভ করা ভীষণ জরুরি।
রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান তাদের নিজ দেশে নিরাপদে ও স্থায়ীভাবে ফেরত পাঠানো এবং সেখানে তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি আদায় করার ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে তাদের ভিনদেশী বাঙালি জাতি বলে আর কখনই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ না থাকে। এটা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আরও অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো উত্তম পন্থা এ মুহূর্তে সামনে নেই। মনে রাখতে হবে সুযোগের অপেক্ষা করাও একটি কার্যকরী কৌশল। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ অবসানে কিংবা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রশ্নে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস হবার সম্ভাবনা খুব কম। কেননা মিয়ানমারের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার রয়েছে ঘনিষ্ঠ মিত্রতা। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। বিগত বছরগুলোতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বসহ অন্য অনেক দেশের সমর্থন পেয়েছে। এ প্রচেষ্টা আরও জোরদার করার সুযোগ রয়েছে।
তাই ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশকে আত্মরক্ষামূলক নীতি অবলম্বন করে চলতে হবে, যেখানে কূটনীতিই হবে প্রধান কৌশল। তবে আক্রান্ত হলে সর্বশক্তিতে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণেরও প্রস্তুতি থাকবে। এ কথা ঠিক যে, বর্তমানে মিয়ানমারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতি, বাংলাদেশে হাসিনার পতন পরবর্তী যুগে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বর্তমান নাজুক রাজনৈতিক পরিস্থিতি- এসব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবাসনের দরকষাকষিতে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের সামনে আরও সুবর্ণ সুযোগ অপেক্ষা করছে। কেননা এক সময় মিয়ানমারের পরিস্থিতি চীনেরও নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যাবে। মিয়ানমারের শতাধিক নৃগোষ্ঠীর লোক বহুকাল ধরে পরস্পর বৈরিতায় লিপ্ত। তাই এক সময় মিয়ানমারকে কয়েকটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করার বিষয়ে প্রচেষ্টা চালাতে পারে। আর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বাস্তব রূপ লাভ করবে। (সমাপ্ত)
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
প্যানেল