ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

দেশের চালচিত্র

নূরুর রহমান খান

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ১ আগস্ট ২০২৪

দেশের চালচিত্র

শেখ হাসিনা তৃতীয় শক্তির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় আসেননি

শেখ হাসিনা তৃতীয় শক্তির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় আসেননি। জনতা তাঁর ভরসা। যতদিন জনতার সমর্থন লাভ করবেন ততদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। কিন্তু বর্তমানে আমলাতন্ত্রের মস্তিষ্কপ্রসূত বেশকিছু কর্মকা- সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে

প্রায় বছর তিরিশেক পূর্বে প্রিয়ভাষী অধ্যাপক সরদার ফজলুর করিম স্যারের সঙ্গে দেখা হতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন?’ বললাম, জিজ্ঞেস করুন ‘কেন আছ?’ প্রাণখোলা হাসিমুখে বললেন, ‘চমৎকার বলেছেন। এবার আমি লিখব ‘কেন আছ’ নিয়ে।’ এক সুহৃদের প্রশ্ন ‘কেন লেখেন? কার জন্য লেখেন? কে পড়ে আর শোনে?’ হ্যাঁ লিখি, বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ বলে। কারও শোনা বা না শোনা আমার হাতে নেই।
’৬৬-এর ৬-দফা, ছাত্রদের ১১-দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ’৭০-এ আওয়ামী  লীগের ঐতিহাসিক বিজয় এবং বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জন- সবই অবলোকন করার সৌভাগ্য হয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পরপরই সরকাবিরোধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ১৯৭৫-এ জনাকয়েক পথভ্রষ্ট উর্দি পরিহিতের হাতে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হওয়ারও দুর্ভাগ্য হয়েছে।

কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত প্রত্যেক দেশের সেনাবাহিনী সে দেশের অহংকার। কিন্তু ততক্ষণই অহংকারের যতক্ষণ তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থেকে এবং সরকারের নির্দেশে দেশের সার্বিক কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত রাখে। ব্যত্যয় ঘটলেই জাতীয় জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে। ক্ষমতার মোহ তাদের অন্ধ করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সেনাশাসনের নিষ্পেষণে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ শতবর্ষ পিছিয়ে গেছে।

এ অপকর্মে জিয়া-এরশাদ-মঈন কেউ কম যাননি। জিয়া-এরশাদের আমলে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের সন্দেহে বিভিন্ন সেনানিবাসে প্রায় দু’হাজার জওয়ানকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয়। পারিপার্শ্বিকতা জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় এনেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যা তাঁর জন্য ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম কুশীলব হিসেবে তিনিও সন্দেহভাজন। এরশাদ বন্দুকের নলের মুখে বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। আরেকটি সুপরিকল্পিত অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করে মঈন ইউ আহমদ অলক্ষ্যে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হয়ে বসেন।

তার স্বল্পকালীন শাসনামলে সেনা কর্মকর্তাদের অবাধ লুটপাট চলে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক প্রতিবাদী শিক্ষককে চক্ষু বেঁধে নিয়ে নির্যাতন করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সেনাশাসন কিংবা সেনা সমর্থিত সরকারের শাসনামল বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়।
২. শেখ হাসিনা রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, কর্মদক্ষতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। ২০২৪ সালে মন্দের ভালো জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছে এবং আমরা নির্বিঘেœ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছি। যেসব দল ও ব্যক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। এখন ২০২৯ সাল পর্যন্ত পরবর্তী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের সম্মুখে কোনো বিকল্প নেই।
আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। দীর্ঘদিন একই দলের ক্ষমতায় থাকা দেশের জন্য যেমন মঙ্গলজনক, তেমনি সুবিধাবাদী, লোভী মুষ্টিমেয় নেতার হঠকারিতা ও দুর্নীতির কারণে অমঙ্গলকর এবং অপূরণীয় ক্ষতির কারণও হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল। উভয়েরই রাজনৈতিক জীবন পরিচ্ছন্ন, কালিমাবিহীন।

দলের কয়েকজন নেতা-কর্মীর দুর্নীতি ও হঠকারিতায় সিপিএম এখন জনবিচ্ছিন্ন। তাদের পায়ের তলায় মাটি নেই। এবার যুক্তরাজ্যে কনজারভেটিব পার্টির পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে বিরতিহীন ১৪ বছর ক্ষমতাসীন থাকাকে অনেকে নির্দেশ করেছেন। অবশ্য বক্তব্যটি বিতর্কিত। বাংলাদেশের রাজনীতির চালচিত্র ভিন্নতর। আওয়ামী লীগ, নৌকা আর শেখ হাসিনা সমার্থক। শেখ হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগ=০০। তাঁর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার মতো দলে কেউ নেই।

অপরদিকে বিরোধী দলগুলোর নেতিবাচক ভূমিকা এবং সরকার পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সাধারণ মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো গঠনমূলক পরিকল্পনা নেই। প্রধান বিরোধী দলের কা-ারি দ-প্রাপ্ত আসামি এবং প্রবাসে পলাতক বিলাসী জীবন যাপন করছেন। ক্ষমতার লোভে শেখ হাসিনাকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। করুণাময়ের অশেষ কৃপায় তিনি বেঁচে গেছেন।
শেখ হাসিনা তৃতীয় শক্তির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় আসেননি। জনতা তাঁর ভরসা। যতদিন জনতার সমর্থন লাভ করবেন ততদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। কিন্তু বর্তমানে আমলাতন্ত্রের মস্তিষ্কপ্রসূত বেশকিছু কর্মকা- সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। তার একটি ‘প্রত্যয় স্কিম’। এই স্কিম ঘোষণার ফলে দেশের সকল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।

ঘোষিত ‘স্কিম’ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সচল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি যে যৌক্তিক তা অনস্বীকার্য। ছাত্রদের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে ‘প্রত্যয় স্কিম’ প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের কর্মক্ষেত্রে ফিরে আশা উচিত। অনতিবিলম্বে ষড়যন্ত্রের এই স্কিম প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। পরবর্তী কর্মসূচি নেওয়ার পূর্বে শিক্ষকদের অপেক্ষা করতে হবে এখনো অঘোষিত ‘সেবক স্কিম’-এর রূপরেখা দেখার জন্য।

‘সেবক স্কিম’ দেখে শিক্ষকদের করণীয় ঠিক করতে হবে- যাতে এই স্কিম দেখে আবার আন্দোলনে যেতে না হয়। এটা সুস্পষ্ট, সরকার আমলাতন্ত্র নামক অক্টোপাসের খপ্পরে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর আমলে ড. এআর মল্লিক, আবদুল্লাহ আল্ মুতি শরফুদ্দিন, অধ্যাপক কবির চৌধুরী শিক্ষা সচিব ছিলেন। আমাদের দাবি শিক্ষা সচিব এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একজন যুগ্ম সচিব শিক্ষাবিদদের মধ্য থেকে নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়া পূর্বের ন্যায় পিএসসির চেয়ারম্যান শিক্ষক, আমলা এবং ক্যাডার সার্ভিস থেকে পর্যায়ক্রমে নিয়োগ দিতে হবে।

পিএসসির মৌখিক পরীক্ষায় পূর্বের ন্যায় একজন শিক্ষককে অবশ্যই অন্যতম বিশেষজ্ঞ হিসেবে রাখতে হবে। এখন বিশেষজ্ঞ হিসেবে সর্ববিদ্যা বিশারদ এলেমের জাহাজ সচিবদের প্রাধান্য লক্ষণীয়। অবশ্য অবরে-সবরে লজ্জানিবারণের জন্য ব্যতিক্রম ঘটানো হয়। ঘোষিত স্কিমের মূল লক্ষ্য কি সরকার পতনের ‘প্রত্যয়’? এক মোশতাক তার সাগরেদদের সহযোগিতায় জাতিকে পিতৃহীন করেছে, বাংলাদেশকে নিক্ষেপ করেছিল তমসার গভীরতম গহ্বরে। বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই দেশকে দৃঢ়তার সঙ্গে নতুন সূর্যের আলোয় আলোকিত করে বিশ্ব দরবারে সগৌরবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।

তবে শঙ্কার সঙ্গে দেখছি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাম-লীর মধ্যে ফাঁসিকাষ্ঠে দোদুল্যমান হয়ে স্বর্গারোহিত যুদ্ধাপরাধীর ভ্রাতা এবং একই সঙ্গে বাংলা ভাষাকে বিলুপ্ত করার দুরভিসন্ধি নিয়ে আরবী হরফে বাংলা প্রবর্তনের পুরোধার পুত্রও স্থান পেয়েছেন। সর্বক্ষণ এই ব্যক্তিই বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর ছায়াসঙ্গী হয়ে আছেন। সর্বদা একটা শঙ্কা প্রধানমন্ত্রী কতটুকু বিপদমুক্ত, তাঁর জীবন কতটুকু নিরাপদ? এক মোশতাকই দেশ ও জাতিকে বিপর্যস্ত করেছিল। এখন তার ছানাপোনারা প্রচ্ছন্ন থেকে যদি প্রশাসন ও সরকারের মধ্যে প্রাধান্য পায় তাহলে আরেকটি মহাপ্রলয় থেকে দেশকে বাঁচানো কঠিন হবে।

৩. এ মুহূর্তে চাকরির ক্ষেত্রে কোটাবিরোধী আন্দোলনে সমগ্র দেশ আলোড়িত। তার ঢেউ এখনো পূর্ণ মাত্রায় রয়েছে। সারাদেশে কার্ফু জারি করে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির সঙ্গে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। জনজীবন পর্যুদস্ত। দেশে যেন যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। শেষ পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ পূর্ণ বেঞ্চে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে দেশকে ধ্বংসের কিনারা থেকে উদ্ধার করেছেন। এক্ষেত্রে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্মরণীয়।

সরকার একটু সচেতন হলে উদ্ভূত পরিস্থিতি এড়ানো যেত। কিন্তু সরকারের ভূমিকা ছিল বিপরীতমুখী। কয়েকজন মন্ত্রী কোটাবিরোধীদের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিহীন, মারমুখী। একমাত্র নির্বোধ ও উন্মাদই এই আন্দোলন অযৌক্তিক মনে করতে পারেন। কোটাবিরোধীরা প্রথম দিকে কোটা সম্পূর্ণ বাতিল চাননি, চেয়েছিলেন সংস্কার। সরকারের একগুঁয়েমি, কয়েকজন মন্ত্রীর আপত্তিজনক মন্তব্য ও দু-একজন আওয়ামী লীগ নেতার হুমকি আন্দোলনকারীদের কঠোর অবস্থান গ্রহণে বাধ্য করেছে।

সরকার আলোচনার পথ পরিহার করে তাদের দমনের জন্য ছাত্রলীগের লাঠিয়াল বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। তারা প্রতিবাদী ছাত্র-ছাত্রীদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে। আক্রান্তরা পরবর্তী সময়ে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আক্রমণকারীদের পক্ষ নিয়ে পুলিশ মাঠে নামে। লাঠিচার্জ থেকে টিয়ার গ্যাস, গুলি সবই ব্যবহার করে। উত্তেজিত কোটাবিরোধীরা ইট পাটকেল নিক্ষেপ ও পথে ব্যারিকেড দিয়ে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জনসাধারণের সহানুভূতি সব সময় আক্রান্তের প্রতিই থাকে। ইতোমধ্যে লাঠিপেটা ও গুলিতে বহুলোক আহত ও নিহত হন।

কোটাবিরোধীদের প্রতি অমানবিক আচরণের ফলে দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এমনি মাহেন্দ্রক্ষণের প্রতীক্ষায় ছিল জামায়াত-বিএনপি গোষ্ঠী। সুযোগ বুঝে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় চরমোনাইয়ের সাগরেদ আর ধর্ষক মামুনুলের চ্যালারা। মির্জা ফখরুল হুঙ্কার ছাড়লেন সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত বিরামহীন আন্দোলনের মাধ্যমে দেশ অচল করে দেবেন। ঢাকাসহ সারাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হলো। সমাজবিরোধীরা এককাট্টা হয়ে পথে নামল। এদের সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী কিংবা ছাত্রদের কোনো সম্পর্ক নেই। মোটকথা নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিএনপি-জামায়াতচক্র মরিয়া হয়ে ওঠে।

এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য কয়েকজন মন্ত্রীর অপরিণামদর্শিতা এবং একজন দলীয় মোড়লের ভূমিকাও কম নয়। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে সুপরামর্শ দেননি। আরও স্পষ্ট করে বলতে হয় তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে ভুল পথে চালিত করেছেন। এ দুঃসময়ে বারবার বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম সুহৃদ ও সহচর তাজউদ্দীন আহমদের কথা মনে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কান কথায় গুরুত্ব দিয়ে দুর্দিনের বন্ধুকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তার খেসারত তাঁকে দিতে হয়েছে। 
প্রতিদিন বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রে ধ্বংসের ভয়াবহ চিত্র এবং সংবাদ দেখছি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, ডেটা সেন্টার, সেতু ভবন, স্বপ্নের মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, টেলিভিশন ভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো হামলার শিকার হয়েছে; সাবমেরিন ক্যাবল লাইন কেটে দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘিœত করেছে। নরসিংদীতে কারাগার ভেঙে আনসারুল ইসলামের সাজাপ্রাপ্ত ও জঙ্গিসহ ৮ শতাধিক কয়েদি নিয়ে গেছে। এগুলো পূর্ব পরিকল্পনা ব্যতীত তাৎক্ষণিকভাবে ঘটানো সম্ভব নয়। তখন কারারক্ষীদের ভূমিকা কি ছিল?

কেরানীগঞ্জসহ একাধিক স্থানে শিবির ও নাশকতাকারীদের আখড়ার সন্ধান পাওয়া গেছে। খোঁজ মিলেছে দুর্বৃত্তদের অর্থ জোগানদার দেশী-বিদেশী প্রভুদের। বহুদিন থেকে তারা সরকার পতনের পাঁয়তারা করছিল। ডিজিএফআই, এনএসআইসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর  কে দেবে? ১৯৭৫-এ এই সংস্থাগুলো থাকা সত্ত্বেও জাতির জনককে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে। 
হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিনজন পুলিশ ও একজন আনসার নিহত এবং সহস্রাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আহত হওয়ার সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু শতাধিক ছাত্র ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু ও অসংখ্য আহতের সংবাদ তো প্রকাশ করা হলো না। রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের নিরস্ত্র ছাত্রটিকে একা দাঁড়ানো অবস্থায় মাত্র কয়েকগজ দূর থেকে যে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে তাকে কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে? 
এত হতাহতের দায়িত্ব কে নেবেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, নাকি ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক? শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে সব দোষ প্রধানমন্ত্রীর ঘাড়ে চাপিয়ে তারা গায়ের চামড়া বাঁচাবার চেষ্টা করছেন। প্রধানমন্ত্রী, এসব চাটুকার বসন্তের কোকিলের গা থেকে দলীয় জার্সি খুলে নৌকা থেকে নামিয়ে দিনÑ দেশ রক্ষা পাবে, আমরা বাঁচব, আপনিও স্বস্তিতে থাকবেন। বর্তমান আওয়ামী লীগকে আমরা অপছন্দ করলেও ছাড়তে পারব না নিশ্চয়ই। আমরা চাই না আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে জামায়াত-বিএনপি তথা স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায় আসুক। আমরা পড়েছি ফাটা বাঁশের মধ্যিখানে। মধ্যযুগের কবি দৌলত উজির বাহরাম খান সম্ভবত এমনি পরিস্থিতিতে অনুরূপ অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন: 
নয়নে অঞ্জলি যেহ্ন পুত্র কুপণ্ডিত।
ত্যাজিতে লাগএ দুঃখ দেখিতে কুৎসিৎ ॥
তিরিশ-চল্লিশ বছর পূর্বে আমাদের দেশে নারীদের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন সর্বক্ষেত্রে নারীদের জন্য কোটা সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে আমাদের নারীরা যোগ্যতার মানদ-ে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা পুরুষের চেয়ে অগ্রসর। এজন্য আরেকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার সময় এসেছে। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সংসদের উপ-প্রধান, একাধিক মন্ত্রী, বিচারপতি, উপাচার্য, সচিব, বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের প্রধান নারী সে দেশে এক সময় সংসদে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্নতর।

এখন জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা রহিত করে নতুন আইন পাস করলে তা হবে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। সে সঙ্গে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল থেকে ১৫% আসনে নারীদের মনোনয়ন দান বাধ্যতামূলক করতে হবে। এর বাইরে যে কোনো দল জনপ্রিয়তার কারণে অধিক সংখ্যক নারীকে মনোনয়ন দিতে পারবে। শেখ হাসিনা, ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, রওশন এরশাদ, এমনকি আইনি বাধা না থাকলে খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। আশা করি বর্তমান সংসদ সদস্যরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। অবশ্য সুবিধাভোগীরা যে এর বিরোধিতা করবেন তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।     (আগামীকাল সমাপ্য)

লেখক : সাবেক অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

×