
আমার ছেলেবেলার কথা। তখন আমি পিরোজপুরে থাকি। ১৯৫৯ সাল। তখন আমাদের পিরোজপুরের বাড়িতে একজন পরিচারিকা কাজ করতেন। আমরা তাঁকে মঈনুদ্দিনের মা বলে সম্বোধন করতাম। তাঁর বাড়ি পিরোজপুরের রায়েরকাঠি যাওয়ার কিছুটা আগে। পরিচারিকা খুব মিশুক এবং কাজের ফাঁকে নানারকম বিষয়ে কথা বলতেন আমাদের সঙ্গে। তিনি পেঁয়াজ-মরিচ ভর্তা খুব ভালো করে বানাতেন। একবার কয়েকদিন ছুটি কাটাবার প্রসঙ্গ উঠলে আমার আম্মা তাঁকে তারিখ জানাতে বললে উঁনি বাংলা মাস উল্লেখ করে তারিখ জানালেন। সত্যি বলতে আমাদের কারওরই কাজের নিরিখে বাংলা তারিখ মনে রাখার প্রয়োজন ছিল না, তাই তাঁকে আম্মা বলেছিলেন যে বাংলা নয়, ইংলিশে কত তারিখ সেটা জানাতে। এর উত্তরে জানিয়েছিলেন যে, তিনি ইংলিশ ক্যালেন্ডারের তারিখ বোঝেন না, সব সময়ে বাংলা তারিখ ও মাস বুঝে সমস্ত কাজকর্ম করেছেন। এমনকি যেসব ধার তিনি নানা জায়গা থেকে নিয়েছেন, সেগুলোও বাংলা তারিখ অনুযায়ী মনে রেখে সঠিক সময়ে ফেরত দিয়ে দেন। সেই সময়ে আরও দেখেছি, গ্রামের অধিকাংশ মানুষই বাংলায় তারিখ মনে রেখে কাজ করতেন। কারণ বেশির ভাগই কৃষিজীবী আর নানারকম ঋতুকালীন শস্য চাষের জন্য বাংলা মাস জেনে কাজ করাটা তাদের মধ্যে রীতি হয়ে গিয়েছিল এবং তাতেই তারা অভ্যস্ত। কিন্তু আজ? কৃষকরাও বাংলা সাল ভুলে গিয়ে ইংরেজি তারিখের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
আসলে আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমাদের উচিত বাংলা ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা। কিন্তু তা আজ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সবার মধ্যে ধারণা হয়ে গিয়েছে যে বাংলা বিষয়টারই গুরুত্ব নেই। সে ভাষা হোক, সংস্কৃতি হোক আর তারিখ হোক। যে বৃত্তটাকে আমরা চিনি, বাস্তবের বৃত্তটা তার থেকে অনেক বড়। অথচ একদিন সাধারণ মানুষেরাই বাংলার গুরুত্বকে প্রতিটি পরিসরে বজায় রেখেছিলেন। শৈশবে দেখা সেই পরিচারিকার মতো এ জমানায় একজন কাজের বুয়াও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি বাংলা তারিখের খোঁজ রাখেন। পরিচারিকা তথা কাজের বুয়ারা হয়ে গেছেন ইংরেজি তারিখের ওপর মনোযোগী ও নির্ভরশীল। তাই বলি, আজ খাঁটি বাঙালি কোথায়?
লিয়াকত হোসেন খোকন
রূপনগর, ঢাক
প্যানেল