
প্রকৃতি এখন বেসামাল আচরণ শুরু করেছে। নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়া, বায়ুদূষণ, জলাশয় ভরাট, গাছপালা নির্বিচারে কেটে ফেলার কারণে দিন দিন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগের চেয়ে দেড় থেকে ২ ডিগ্রি তাপ বেড়ে গেছে। তাতেই বজ্রপাতসহ ভয়াবহ দুর্যোগ চারদিক দিয়ে আমাদের ঘিরে ধরছে। গত মঙ্গলবার কয়েকটি জেলায় একই দিনে বজ্রপাতে ১৮ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। বজ্রপাত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে রাষ্ট্র বিবেচনা করলেও অন্যান্য ঝড়ের মতো তার প্রস্তুতি চোখে পড়ছে না। যাও প্রস্তুতি রয়েছে তাও অনিয়মের কারণে সে প্রকল্পগুলো আর বজ্রপাত রোধে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেনি। এখন হাওড়ে ব্যাপক ভাবে ধান কাটা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ীতে এক সঙ্গে তিনজন কৃষক বজ্রঝড়ে মারা গেছে। দেশে ইতোমধ্যে ৭০ জনের মতো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বেশি হতাহত হচ্ছে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং সুনামগঞ্জ হাওড়াঞ্চলের কৃষক। তবে দেশের অন্যান্য স্থানেও মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আমাদের দেশের কৃষক শ্রেণির লোকই সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের শিকার হচ্ছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর ৭০ ভাগই হলো কৃষক, তারপর রয়েছে জেলে এবং রাখাল। পথচারী এবং স্কুল ছাত্র-ছাত্রীরাও এখন বজ্রপাতের ভয়াবহ শিকার হচ্ছেন। কৃষকদের ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই তাদের জমিতে কাজ করতে হয়। কৃষি জমির বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কোনো ধরনের বসতি না থাকায় তারা মূলত বজ্রঝড়ের সময় সম্পূর্ণরূপে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। এ সময় আশপাশে বড় বড় গাছই হলো তাদের আশ্রয়। হাছের নিচে সচেতনতার অভাবেই আশ্রয় নেয়ার কারণেই তারা বজ্রপাতের শিকার হচ্ছেন। অপরদিকে গরু চড়াতে যেয়ে রাখালরাও এ ভয়াবহতার মুখোমুখি হচ্ছেন। তবে স্কুল ফেরত অনেক ছাত্র-ছাত্রীরাও প্রাণ হারাচ্ছেন বজ্রঝড়ে। প্রকৃতি চলে তার আপন নিয়মে। মানুষ তার প্রয়োজনে প্রাকৃতিক পরিবেশের গাছপালা নির্বিচারে কর্তন করে চলেছে। একটি দেশের আয়তনের ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু আমাদের দেশে বনের পরিমাণ অর্ধেকও নেই। আছে মাত্র ১০ শতাংশ। তাই আমাদের জলবায়ু এখন অনিয়ম গতিধারায় চলছে। তাতে ঋতুর পরিবর্তন ঘটে চলেছে অবিরামভাবে। সমুদ্রের আদ্র জলবায়ু এবং উত্তরাঞ্চলের শুষ্ক বায়ু একত্রে মিলিত হলেই ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক জলবায়ুর কারণে বজ্রপাত সৃষ্টি হচ্ছে। বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। তবে প্রতি বছর বিশ্বে ২৪ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে থাকে এতে। চলতি বছর আমাদের দেশে ৩০ জনের মতো লোকের প্রাণহানি ঘটেছে বজ্রপাতে।
২০১৫ সালের বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে তখনকার সরকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। তার মধ্যে ৪০ লাখ তালগাছ লাগানোর কথা ছিল। সে প্রকল্পে বজ্রঝড় রোধ করা যায়নি। পরে ২০১৮ সালে আবহাওয়া অধিদপ্তর ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে লাইট্রেনিং ডিডেকশন সেন্সর প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তাতে অনিয়ম ঘটায় এ প্রকল্পও কোনো কাজে আসেনি। পরবর্তীতে সরকার ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেন। প্রকল্পটি হলো বজ্রনিরোধ দণ্ড বসানো। এ দণ্ডও অনিয়মের বেড়াজালে পড়ে যায়। উঁচু দণ্ড থেকে গাছের উচ্চতা বড় হওয়ায় তা কোনো কাজে আসেনি। বলা হয়েছিল গাছের চেয়ে দণ্ড বড় হবে।
প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ ঠেকাতে রাষ্ট্র প্রকল্প গ্রহণ করলেও তা লুটেরা খেয়ে ফেলছে। যেমন দেশে ব্যাপকভাবে তালগাছ রোপণ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে তালগাছের বীজ থেকে আর গাছের মুখ দেখা যায়নি লুটেরাদের দুর্নীতির কারণে। তারা ভাগবাটোয়ারা করে সব খেয়ে সাবাড় করেছেন এ প্রকল্পের সব বরাদ্দ। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে আমাদের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা দিন দিন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার সে তাপ শোষণ করার মতো প্রচুর গাছপালা-নদী-খালবিলও আমাদের নেই। প্রতিনিয়তই নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। খাল বিল ড্রেজার দিয়ে ভরাট করে চলেছে মানুষ। তাই তাপপ্রবাহ দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে ধরণী এখন বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছি আমরা। তাতেই এ ভয়াবহ বজ্রঝড়ের মহাবিপর্যয় তৈরি হচ্ছে। এতেই এখন আমাদের হাওড়বাসীর মরণ ডেকে আনছে।
অলিউর রহমান ফিরোজ
মিরপাড়া, মুন্সীগঞ্জ
প্যানেল