
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রায় সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে কাশ্মীর অঞ্চল উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র দুটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর ভূখণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। রাষ্ট্র দুটিই অঞ্চলটির পুরোটা নিজেদের দাবি করলেও নিয়ন্ত্রণ করে আংশিক। চীনও অঞ্চলটির কিছু অংশে শাসন পরিচালনা করে। অঞ্চলটি বিশে^র অন্যতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সামরিকায়িত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সম্প্রতি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর গত ২২ এপ্রিল বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ জন নিহত হওয়ায় পুনরায় অঞ্চলটি আলোচনায় এসেছে। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর ভূমি মালিকানা নিয়ে জনগণের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার নতুন যে জমি আইন চালু করেছে, তাতে স্থানীয়দের জন্য নির্ধারিত জমির অধিকার বাতিল করে বহিরাগত বিনিয়োগকারীদের জমি কিনতে উসাহিত করে। এটিকে কাজে লাগিয়ে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট নামের সংগঠন। সংগঠনটি হামলার দায় স্বীকার করেছে। এ ঘটনার পর পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ এনেছে ভারত। তবে পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তাদের জড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা অমূলক এবং ভারতের যে কোনো প্রতিক্রিয়ার জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছে পাকিস্তান। এ হামলার জেরে সীমান্তের একদিকে যেমন সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দাবি জোরালো হয়েছে, ঠিক অন্যপ্রান্তে সমুচিত জবাব দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প গৃহীত হয়েছে। এ ঘটনায় ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করেছে। পাকিস্তান সিন্ধু চুক্তি স্থগিতের ভারতীয় সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে সতর্ক করেছে, পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত পানির প্রবাহ থামানো বা অন্যদিকে সেই পানিপ্রবাহ ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা যুদ্ধের কাজ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে। পাকিস্তানও ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, বিশেষ করে ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসার পাল্টা হুমকি দিয়েছে। সিমলা চুক্তিটি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করেছে। এ চুক্তি অনুযায়ী, বিতর্কিত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা পরিচালিত হয়। এ ছাড়া চুক্তিটিতে দুই দেশের মধ্যে বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তিতে প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে। এ চুক্তি স্থগিত করার জন্য পাকিস্তানের প্রদত্ত হুমকি সম্ভাব্য গুরুতর উত্তেজনারই ইঙ্গিত বহন করে। এমনকি উভয় দেশ একে অপরের নাগরিকদের বহিষ্কার করেছে এবং কূটনৈতিক মিশনের সংখ্যাও কমিয়ে দিয়েছে। দ্য ডন পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সামুদ্রিক সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে পাকিস্তান নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো অবিলম্বে কার্যকর করছে। ভারতীয় পতাকাবাহী কোনো জাহাজ পাকিস্তানি বন্দরে প্রবেশ করতে পারবে না, পাকিস্তানি পতাকাবাহী কোনো জাহাজ ভারতীয় বন্দর সফর করবে না এবং বিশেষ কোনো ছাড় প্রয়োজন হলে তা পৃথকভাবে পর্যালোচনা করা হবে। এর আগে এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বরা হয়েছিল, পাকিস্তান থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সব ধরনের আমদানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত সরকার। এছাড়া ভারতের বন্দরে পাকিস্তানি কোনো জাহাজ ভিড়তে পারবে না বলেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতি সামরিক সংঘাতের রূপ পরিগ্রহ করতে পারেÑ এমন আশঙ্কার মধ্যেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ গত ৫ মে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছে। এতে পেহেলগাম হামলার পর ভারতের প্রতিক্রিয়া এবং সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৈঠকে তারা আঞ্চলিক পরিস্থিতি এবং ভারতের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো তুলে ধরবে। এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট সঠিক চিত্র উপস্থাপনের একটি অংশ বলে ইসলামাবাদ দাবি করছে। বৈঠক শেষে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব খালেদ মোহাম্মদ খিয়ারি পরিস্থিতিকে উত্তেজনাপূর্ণ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং বলেন, বৈঠকে দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ সমাধান ও সংলাপের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে ভারতীয় মিডিয়া এএনআই বলেছে, পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি বৈঠকে গুরুতরভাবে উত্থাপন করা হয়। এমন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ আন্তর্জাতিক মহল দেশ দুটিকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ দুই দেশকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে, যেন সমস্যাগুলো অর্থবহ পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায়। ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে আসছে। সে দাবিকে কেন্দ্র করে দেশ দুটির মধ্যে একাধিক যুদ্ধ, সশস্ত্র বিদ্রোহ ও কূটনৈতিক টানাপোড়েনের ঘটনা ঘটেছে। পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, নয়াদিল্লি যদি ওই হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা থাকাকে ধরে নেয় বা অনুমান করে, তবে ভারতের তরফে সামরিক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। কারণ ভারতের জন্য এমন প্রতিক্রিয়া দেখানোর সবচেয়ে বড় সুবিধাটা হবে রাজনৈতিক। প্রতিক্রিয়া দেখানোর আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, ভারত যদি সফলভাবে হামলাকারীদের নিশানা বানাতে পারে, তবে তা তার প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে ও ভারতবিরোধী হুমকি হ্রাস করবে। তবে অসুবিধা হচ্ছে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ গুরুতর সংকট এবং এমনকি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করবে।
এদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতের পর বাগলিহার বাঁধের মাধ্যমে পাকিস্তানে চেনাব নদীর পানিপ্রবাহ ভারত কমিয়ে দিয়েছে। কিশানগঙ্গা বাঁধের মাধ্যমেও ঝিলম নদীর পানিপ্রবহ একইভাবে নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করছে ভারত। সিন্ধু পানি চুক্তির মাধ্যমেই সিন্ধু অববাহিকার অভিন্ন নদ-নদীর পানি দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করা হয়ে থাকে। চেনাব নদীর জম্মু অংশের ওপর নির্মিত বাগলিহার জলবিদ্যুৎ বাঁধ এবং উত্তর কাশ্মীরে ঝিলম নদীর ওপর নির্মিত কিশানগঙ্গা বাঁধ ভারতকে পানি ছাড়ার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। বাগলিহার বাঁধ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলে আসছে। পাকিস্তান এ বিষয়ে বিশ^ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছিল। কিশানগঙ্গা বাঁধ নিয়েও আইনি এবং কূটনৈতিক জটিলতা রয়েছে। উল্লেখ্য যে, ১৯৬০ সালে পানির ন্যায্য বণ্টন নিয়ে বিশ^ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু পানিচুক্তি হয়েছিল। চুক্তির শর্তানুযায়ী, সিন্ধু অববাহিকার পূর্বাঞ্চলীয় ৩টি নদী ইরাবতী, বিপাশা ও শতদ্রুর পানি ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলের ৩টি নদ-নদী সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাবের অধিকাংশ পানি পাকিস্তানকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। সিন্ধুর পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত জানার পর পাকিস্তান প্রতিক্রিয়ায় বলেছিল, এই চুক্তি লঙ্ঘন করে পানিপ্রবাহ সরিয়ে দেওয়া বা আটকে দেওয়াকে যুদ্ধের শামিল হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হামলার সঙ্গে জড়িতদের কল্পনাতীত শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা করেছেন। তিনি এরই মধ্যে দেশটির সামরিক বাহিনীকে অভিযান পরিচালনার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং শুধু অপরাধীদের বিরুদ্ধে নয়, ভারতীয় মাটিতে জঘন্য কর্মকাণ্ডের পেছনে থাকা মূল পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির বলেছেন, ‘কোনো অস্পষ্টতা নেই। ভারতের যে কোনো সামরিক দুঃসাহসের দৃঢ়, দ্রুত ও কঠোর জবাব দেওয়া হবে। পাকিস্তান আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় আমাদের প্রস্তুতি এবং সংকল্প অত্যন্ত দৃঢ়।’ আর পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, বিশ^ নেতারা সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাচ্ছেন। সরকার এবং জাতির পক্ষ থেকে আমি স্পষ্ট করেছি, পাকিস্তান প্রথমে কোনো ধরনের উত্তেজনা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেবে না, যুদ্ধ শুরু করবে না। কিন্তু যদি ভারতীয় পক্ষ থেকে এমন কিছু হয়, আমরা অত্যন্ত শক্তি সঙ্গে জবাব দেব।
ভারত-পাকিস্তান সংঘাত এখন কোনো আঞ্চলিক বিষয় নয়। কারণ, দেশ দুটিই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। পারমাণবিক অস্ত্র যেমনি একদিকে বিপজ্জনক, ঠিক তেমনি অন্যদিকে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলকও। সেক্ষেত্রে ভারতের যেকোনো প্রতিক্রিয়া হবে সম্ভবত নির্দিষ্ট ও লক্ষ্যভিত্তিক। অন্যদিকে পাকিস্তানও পাল্টা জবাব দিতে এবং পরে উত্তেজনা মেটাতে চাইতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়াকে বৈশি^ক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে। এই অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি হলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগ এবং বৈশি^ক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিÑদুটিই ব্যাহত হবে। যুক্তরাষ্ট্র কাশ্মীর ইস্যুতে ভুল কোনো কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে, তা দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই; বৈশি^ক পরিসরেও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে বিপন্ন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্রামি ব্রুস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ঘটনাপ্রবাহ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তবে কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তানের সীমান্ত বিতর্কের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষ নিচ্ছে না। কারণ, এই জটিল সংকট সামাল দিতে সংবেদনশীল ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি বলে মনে করেন। ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে যে, সন্ত্রাসবাদ ও আঞ্চলিক হুমকির মুখে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পাশে থাকবে। তবে হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের গৃহীত পদক্ষেপ যেন পুরো অঞ্চলে বড় কোনো ধরনের সংঘাতে রূপ না নেয়Ñযুক্তরাষ্ট্র এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় না এই হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় আরও বড় কোনো সংঘাত ছড়িয়ে পড়ুক। যুক্তরাষ্ট্র চায় পাকিস্তান এই হামলার জন্য দায়ীদের ধরতে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করুক। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিরসনে রাশিয়া সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ফোনালাপের মাধ্যমে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দারকে এ প্রস্তাব দেন। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, গত ২২ এপ্রিল সংঘটিত হামলার জেরে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে ভারত ও পাকিস্তান যদি আগ্রহী হয়, তাহলে রাশিয়া সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে। এর আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে আলাপকালেও দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার বিরোধ মেটানোর আহ্বান জানান রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, জম্মু-কাশ্মীরে হামলার পরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার দিকে তারা নজর রাখছে। পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে গত কয়েক দশক ধরেই প্রতিরক্ষা এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবেও চীনের প্রতি পাকিস্তানের নির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী তথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসাক দারের সঙ্গে কথ বলার সময়ে ওয়াং ই জানিয়েছিলেন, দ্রুত নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিকে চীন সমর্থন করে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, এই সংঘাত পাকিস্তান বা ভারত কারও পক্ষেই যেমন ভালো নয়, তেমনই আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যও ক্ষতিকর। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, চীন এই অঞ্চলের এমন একটা বড় দেশ, যার সঙ্গে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সঙ্গেই বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। ভারত যেমন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সীমান্ত অঞ্চলে উত্তেজনা তৈরির জন্য অভিযোগ তুলে থাকে, পাকিস্তানও তেমনই বালুচিস্তানের ঘটনাবলীর জন্য ভারতকে দোষী বলে দায়ী করে থাকে। কিন্তু এই অঞ্চলে শান্তি বজায় থাকলেই চীনের স্বার্থ পূর্ণ হবে। চীনের প্রয়োজন নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিরাপদে রাখা।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার চলমান উত্তেজনার মধ্যে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় ট্যাংক, কামান, গোলা নিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ণমাত্রায় সামরিক মহড়া চালিয়েছে। এরই মধ্যে ৪৫০ কিলোমিটার পাল্লার একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে পাকিস্তান। ‘আব্দালি উইপন সিস্টেম’ নামের এই ক্ষেপণাস্ত্রটি সিন্ধু মহড়ার অংশ হিসেবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বলে ইসলামাবাদ জানিয়েছে। এ সকল ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েনের পাশাপাশি সামরিক প্রস্তুতিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই মধ্যে পাকিস্তানের এই ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এদিকে সংকট নিরসনে ভারতকে রাজি করাতে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বৈঠক করেছেন। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি, সীমান্ত সংঘর্ষ এবং পারস্পরিক নিষেধাজ্ঞা দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক রাজনীতি বিশ্লেষক ক্রিস্টোফার ক্ল্যারিও বলেন, ভারত-পাকিস্তানের যেকোনো সংকটে সবচেয়ে গুরুতর ঝুঁকিগুলোর একটি, উভয় দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। এ বাস্তবতা প্রতিটি সিদ্ধান্তের ওপর দীর্ঘ প্রভাব ফেলে, তা শুধু সামরিক কৌশলেই নয়; বরং রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রেও।
ফরেন অ্যাফেয়ার্স ফোরামের ‘ভারত-পাকিস্তান পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতকে সামরিক অভিযানের জন্য প্রতিদিন ৬৭০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে। সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ হবে ১৭.৮ বিলিয়ন ডলার। এক মাসের একটা যুদ্ধে ভারতকে যে ব্যয় করতে হবে, সেটা দেশটির জিডিপির ২০ শতাংশের সমান। প্রথম মাসের সংঘাতেই ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ ভারত থেকে ভিন্ন দেশে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর পাকিস্তান এরই মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে ভুগছে। আইএমএফের ঋণের ওপর দেশটিকে নির্ভর করতে হচ্ছে। যুদ্ধ বাধলে অতি-উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অত্যাবশ্যক পণ্যের ঘাটতিতে ভুগতে হবে পাকিস্তানকে। জ¦ালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। এই সংঘাত বিশ^ অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও মন্থর করে দিতে পারে। যুদ্ধ পরিবেশেরও বিপর্যয় ডেকে আনবে। ২০৩০ সালের মধ্যে পাকিস্তান ৬০ শতাংশ মিশ্র জ¦ালানি ব্যবহারের যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে এবং ভারত কার্বন নিঃসরণ কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সেখান থেকে সরে আসতে হবে। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো পক্ষই দেয়ালে পিঠ না ঠেকা পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা ভাববে না। তবে সীমিত সংঘাত অতর্কিতে বড় সংঘাতে রূপ নিতে পারে। এমন সম্ভাব্য পরিণতি ও বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করে, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকরী ভূমিকা পালনের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল