ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি সমবায় ও খাদ্য নিরাপত্তা

ড. জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ৪ নভেম্বর ২০২২

কৃষি সমবায় ও খাদ্য নিরাপত্তা

.

পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গে প্রতিবছর গড়ে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৫ থেকে ২০ লাখ টন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে এদেশে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয় কৃষির উৎপাদন। ফলে ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ লাখ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ত্রিশ শতাংশ। এ ঘাটতি মেটাতে হয়েছে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির মাধ্যমে। সেটা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট অত্যন্ত পীড়াদায়ক। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘খাদ্যের জন্য অন্যের উপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে।

আমরা কেন অন্যের কাছে ভিক্ষা চাইব। আমাদের উর্বর জমি, আমাদের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজের সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করব।’ সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষি বিপ্লবের আহ্বান জানান। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে তিনি কৃষি বিপ্লবের বিকাশের কথা স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘দেশের কৃষিবিপ্লব সাধনের জন্য কৃষকদের কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না’।
এ বিপ্লবে দেশের কৃষকদের  উদ্বুদ্ধ করার  জন্য তিনি তাদের সংগঠিত করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। বিকশিত করার চেষ্টা করেন কৃষি সমবায়। গড়ে তোলার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন গ্রাম ভিক্তিক বহুমুখী সমবায়। প্রথমে তিনি সমবায়কে দেশের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেন। অনুচ্ছেদ ১৩ (খ) মোতাবেক সমবায়কে স্বীকৃতি দেন মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে। বঙ্গবন্ধু দেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটি করে সমবায় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এর সদস্য হতো গ্রামের সব মানুষ। তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যৌথ কৃষি খামার। সরকার তাতে ঋণ দেবে, উপকরণ সহায়তা দেবে, সেচের ব্যবস্থা করে দেবে।

তাতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়বে। এর সুফল পাবে জমির মালিক, শ্রম প্রদানকারী ভূমিহীন কৃষক ও সরকার। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি যে, পাঁচ বছরের প্ল্যানে, প্রত্যেকটি গ্রামে কম্পলসারি কো-অপারেটিভ হবে। বাংলাদেশে ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেক মানুষ, যে মানুষ কাজ করতে পারে তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে।’  এরূপ সমবায়ের মাধ্যমে তিনি গ্রামীণ ধনী দরিদ্রের বৈষম্য পরিহার করতে চেয়েছেন। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করতে চেয়েছেন। বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায় সংগত মূল্য প্রদানের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন অন্তর্ভুক্তিমূলক গ্রামীণ উন্নয়ন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কিছু দেশদ্রোহী সদস্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর গ্রামভিত্তিক বহুমুখী সমবায়ের রূপরেখা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু সমবায় আন্দোলন থেমে থাকেনি। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেরণায় সমবায় কর্মসূচি পুনরায় গতি লাভ করে। বর্তমানে এ দেশে ২৯ প্রকারের সমবায় সমিতি রয়েছে। মোট সমিতির সংখ্যা ১,৯৭,০৬৫টি। তাতে অংশগ্রহণকারী সদস্যসংখ্যা ১,১৭,৪২,৬৭৪ জন। এদের একটি বড় অংশ কৃষি সমবায়ের সঙ্গে জড়িত। তারা কৃষিপণ্যের উৎপাদন করছে, মধ্যস্বত্বভোগীদের নাগপাশ এড়িয়ে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করছে। সমবায়ের মাধ্যমে তারা উন্নত বীজ, সার, সেচ ও কৃষিযন্ত্রের ব্যবস্থা করছে।

এক্ষেত্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। তিনিই দেশের কৃষকদের সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে অধিক উৎপাদন ও লাভজনক বিপণনে উৎসাহিত করেছেন। স্বাধীনতার ৫১ বছরে দেশে সমবায় সমিতির সংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ৩.০৯ শতাংশ হারে এবং সদস্যসংখ্যা ২.৮২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমানত ও কার্যকরী মূলধনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৬.৭০ এবং ৯.৭১ শতাংশ। বর্তমানে সমবায় খাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে ৯,৬৩,৮৯২ জনের। এক বিশাল কর্মযজ্ঞ সূচিত হয়েছে দেশের সমবায় খাতে। গত ৫১ বছরে দেশে কৃষির উৎপাদন প্রায় ৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে দুধ, ডিম, মাংস ও মাছের উৎপাদন। বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্যে প্রায় স্বয়ম্ভর। ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রতি হেক্টরে ১ টন থেকে ৩ টনে। উচ্চফলনশীল জাত সম্প্রসারিত হয়েছে শতকরা প্রায় ৯০ শতাংশ জমিতে। সেচ এলাকা বিস্তার লাভ করেছে ৭৪ শতাংশ ফসলি এলাকায়। এতে সমবায়ের প্রভাব রয়েছে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের কৃষির উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়াতে হবে। বিভিন্ন কৃষিপণ্যের আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনার মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এর জন্য সমবায় আন্দোলনকে আরও জোরদার করা দরকার।
জ্বালানি তেলের সংকট, মূল্যস্ফীতি, দীর্ঘ খরা ও অপ্রতুল খাদ্য সরবরাহ বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত সমস্যা। অবস্থাদৃষ্টে ধারণা করা যায়, বিশ্বের অর্থনীতি ক্রমেই সংকটের দিকে এগোচ্ছে। নিকট দূর ভবিষ্যতে একটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছে অনেকে। গত ১০ অক্টোবর ওয়াশিংটনে শুরু হওয়া বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভায় এ শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। আবার গত ১১ অক্টোবর প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে একটি মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি। আর্থিক প্রবৃদ্ধির হার নেমে যেতে পারে ২ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০২২ সালের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির পতন, দ্বিতীয়ার্ধে ইউরো এলাকায় সংকোচন এবং চীনে মন্দা এই প্রবৃদ্ধি হ্রাসের প্রধান কারণ। এর আগে গত ২০-২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তা ছাড়া বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থাও আগামীতে একটি মন্দা ও খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দিয়ে আসন্ন দুর্ভিক্ষের জন্য সবাইকে সতর্ক হতে বলেছে।

বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, গত অর্ধশতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দা অতিক্রম করছে বিশ্ব অর্থনীতি। আগামী বছর তা আরও ঘনীভূত হতে পারে। ক্রমবর্ধমান খাদ্য, জ্বালানি ও আর্থিক সংকট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে আরও উসকে দিতে পারে। বৃদ্ধি পেতে পারে ক্ষুধা, কর্মহীনতা ও দারিদ্র্য। এর মধ্যে সবচেয়ে শঙ্কা তৈরি করছে খাদ্য সংকট।
স্মরণকালের দীর্ঘ খরায় মাঠের ফসল পুড়েছে। অন্যদিকে বন্যার কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষির উৎপাদন। বর্তমানে যে দেশগুলো গভীর অর্থনৈতিক ও খাদ্য সংকটে আছে, এদের মধ্যে ইথিওপিয়া, নাইজিরিয়া, হাইতি, মালি, কেনিয়া, সোমালিয়া, জিম্বাবুয়ে, পাকিস্তান, সুদান, ইয়েমেন, সিরিয়া ও শ্রীলঙ্কা অন্যতম। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদনে এই দেশগুলোর জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিস্থিতি সামলানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া কোরিয়া, লাউস, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, লেবানন, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক ও আফগানিস্তানে অদূর ভবিষ্যতে খাদ্য সংকট ঘনীভূত হতে পারে। এ সময় সারা বিশ্বে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৃদ্ধি পেতে পারে খাদ্য সংকট ও পুষ্টিহীনতা। সাম্প্রতিক করোনা মহামারী, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে সারা বিশ্বে প্রায় ৮২ কোটি মানুষ দারুণ অপুষ্টিতে ভুগছে।

প্রতিদিন ক্ষুধা নিয়ে ঘুমায় বিশ্বের প্রায় সাড়ে ৩৪ কোটি মানুষ। এদের মধ্যে প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষের বসবাস উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। এসব পুষ্টিহীন ও দরিদ্র মানুষের শতকরা ৮০ ভাগই বাস করে পল্লী অঞ্চলে। কৃষি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভর করেই তারা বেঁচে থাকে। তাদের নিয়ে এমন একটি টেকসই বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার, যেখানে সবারই পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্যে প্রতিনিয়ত অভিগম্যতা থাকবে। এর জন্য কৃষি-খাদ্যব্যবস্থাকে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের সঙ্গে সমন্বিত করে এগিয়ে নিতে হবে। তাতে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে ভালো পরিবেশ ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে কৃষিপণ্যের। তবুও এ দেশে খাদ্য ঘাটতি আছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অনুসারে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশের পর্যায়ে উন্নীত হবে। তখন এ দেশে কোনো ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থাকবে না। এ লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে হলে আরও বাড়াতে হবে কৃষির উৎপাদন। ২০৩০ সালে আমাদের চালের চাহিদা হবে ৩৯ মিলিয়ন টন এবং ২০৫০ সালে হবে ৪৩ মিলিয়ন টন। গমের চাহিদা ২০৩০ সালে হবে প্রায় সাড়ে ছয় মিলিয়ন টন এবং ২০৫০ সালে হবে আট মিলিয়ন টন। ভুট্টার চাহিদা দাঁড়াবে যথাক্রমে সাড়ে আট মিলিয়ন এবং ১৭ মিলিয়ন টন।

মোট খাদ্যশস্যের চাহিদা ২০৩০ সালে হবে ৫৪ মিলিয়ন টন এবং ২০৫০ সালে হবে প্রায় ৬৮ মিলিয়ন টন। এই বিপুল খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য আমাদের দ্রুতগতিতে উৎপাদন বাড়িয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে ডাল, তেলবীজ, শাকসবজি, আলু ও ফলমূলের উৎপাদন। দেশের ক্রমবর্ধমান কৃষিপণ্য যেমন মাছ, মাংস, দুধ ও ডিমের উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়াতে হবে।
বর্তমানে আমরা চাল, আলু, মাংস, ডিম ও মাছের ক্ষেত্রে প্রায় স্বয়ম্ভর। অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনেও আমাদের স্বয়ম্ভরতা অর্জন করতে হবে। এর জন্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ধারণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে বণ্টনব্যবস্থাকে সুষম, সুলভ ও সহজপ্রাপ্য করতে হবে। দরিদ্র ও পুষ্টিহীনদের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তার জন্য গ্রহণ করতে হবে বিশেষ কর্মসূচি। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি করতে হবে। খাদ্য সহায়তাও বাড়াতে হবে। কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থাপনা এমন হতে হবে. যাতে কেউ পশ্চাতে না থাকে।
বর্তমান সরকার খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে দরিদ্রের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিও জোরদার করেছে। কৃষিতে দেয়া হচ্ছে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও ভর্তুকি। আগামী দিনগুলোতে দেশের সব নাগরিকের জন্য খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, এমনটি আশা করা খুবই সমীচীন। বর্তমানে বাংলাদেশে খাদ্য সংকট নেই। খাদ্য মজুদের পরিমাণও সন্তোষজনক। তবে খাদ্য ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের মূল্য পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। সরকারি হিসাবে গত সেপ্টেম্বরে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। তার আগের মাসে অর্থাৎ গত আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার ছিল আরও বেশি, ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। গত ১০ বছরের মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। বৈশ্বিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও মন্দার প্রভাব এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। সামনে খরা, বন্যা, যুদ্ধ ও জাতিগত কোন্দালের কারণে কৃষির উৎপাদন বিঘ্নিত হতে পারে। ভেঙ্গে পড়তে পারে খাদ্য সরবরাহ চেন।

তাতে খাদ্য সংকট ঘনীভূত হতে পারে। তাতে সারা বিশ্বে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৃদ্ধি পেতে পারে খাদ্য সংকট ও পুষ্টিহীনতা। দেখা দিতে পারে দুর্ভিক্ষ। এমন এক পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী দিনের সম্ভাব্য মহামন্দা ও দুর্ভিক্ষের জন্য সবাইকে সতর্ক করেছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে তিনি বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের দেশের বাড়িতে খবর পাঠাতে বলেছেন, যেন এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা না হয়। এর আগেও তিনি বিভিন্ন ভাষণে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি ও জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। গত ১২ অক্টোবরের ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার’ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণেও তিনি এ বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেছেন। এটি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, আন্তরিক অভিপ্রায়। কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন সম্ভব।
বর্তমান বিশে^র মানুষ এক উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার অভিযাত্রী। এখানে পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রধান অবলম্বন সমবায়। আমাদের দেশের সমবায় চিন্তকদের অবশ্যই ক্ষুদ্র কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের স্বার্থে কাজ করতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন নিশ্চিত করার একটি কৌশল হচ্ছে সমবায়। এটি শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, মানবিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের নির্ভরযোগ্য একটি অবলম্বনও। এটি সততা প্রতিষ্ঠা এবং মনন ও মানসিকতা পরিবর্তনের উত্তম পন্থা। সমবায় সুপ্রতিষ্ঠিত হলেই সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রান্তিক জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করা যাবে। এর জন্য দেশে সমবায় আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায় ‘দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে সমবায় একটি পরীক্ষিত কৌশল।’ কৃষকদের সংগঠিত শক্তিই বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির গতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। নিশ্চিত করতে পারে খাদ্য নিরাপত্তা।
বর্তমানে বাংলাদেশে যে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপন্ন হচ্ছে তাতে সমবায়ী কৃষকদের বড় অবদান রয়েছে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। তার জন্য দেশের খাদ্য ও কৃষি পণ্যের উৎপাদন বছরে গড়ে সাড়ে ৪ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে বাড়িয়ে যেতে হবে। দেশের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ ক্ষুদ্র চাষিদের পক্ষে এত দ্রুত উৎপাদন বাড়িয়ে যাওয়া খুবই দুষ্কর। এর জন্য দরকার তাদের সংগঠিত করা। আর্থিক ও সামাজিকভাবে তাদের ক্ষমতায়ন করা। সমবায়ের মাধ্যমেই তা সম্ভব হতে পারে। এ লক্ষ্যে সমবায় আন্দোলনকে আরও গতিশীল করা দরকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা বাড়ানো দরকার দেশের সমবায়ী কৃষকদের জন্য। তাতে কৃষি সমবায়ের ভিত্তি আরও দৃঢ় হবে। সমৃদ্ধশালী হবে দেশের অর্থনীতি।

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট

×