ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণবন্ত এক শিশু

সাধন চন্দ্র মজুমদার

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ১৭ অক্টোবর ২০২২

প্রাণবন্ত এক শিশু

জাতির পিতা শেখ মুজিব ও বেগম মুজিবের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্ম

আবেগ মথিত ভালোবাসার অনবদ্য একটি নাম শেখ রাসেল। ১৯৬৪ সালে ১৮ অক্টোবর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে ইতিহাসের মহানায়ক আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিব ও বেগম মুজিবের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্ম। শেখ মুজিব তখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। তবে তদানীন্তন পাকিস্তানের রাজনীতির অঙ্গনে কিংবদন্তি হয়ে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালটি ছিল ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ। আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শেখ মুজিব ফাতেমা জিন্নাহ্র পক্ষে কাজ করছিলেন। সর্বদলীয়ভাবে ফাতেমা জিন্নাহ্কে প্রার্থী করা হয়েছিল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে। শেখ রাসেল যেদিন জন্ম গ্রহণ করেন- সেদিন শেখ মুজিব নির্বাচনী প্রচার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। শিশু পুত্রের জন্ম সংবাদ শুনে তিনি নাম রাখেন শেখ রাসেল। নামটি রাখার পেছনে একটি কারণ ছিল। বিশ^খ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক, যুক্তিবিদ্, গণিতবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজকর্মী, সমাজ-সমালোচক এবং অহিংসবাদী মহান পুরুষ বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেলের অনুরাগী ছিলেন শেখ মুজিব।

তার স্বপ্ন ছিল কনিষ্ঠ পুত্র যেন বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো হয়ে ওঠেন। তাই বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারেই কনিষ্ঠ পুত্রের নাম রাখেন। বার্ট্রান্ড রাসেল ১৯০০ সালের শুরুতে ব্রিটিশদের আদর্শবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। তাকে বিশ্লেষণী দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করা হয়। এর অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তার শিষ্য ডিটগেনস্টেইন এবং পূর্বসূরি ফ্রেগে। বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন একজন প্রখ্যাত যুদ্ধবিরোধী মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। তিনি সা¤্রাজ্যবাদনীতিকে ঘৃণা করতেন।

রাসেল তাঁর অহিংস মতবাদ প্রচারের জন্য প্রথম বিশ^যুদ্ধের সময় জেলবন্দি হন। হিটলারের বিরুদ্ধেও প্রচারণা চালান তিনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকান ভূমিকারও সমালোচনা করেন। বার্ট্রান্ড রাসেলের জীবনাদর্শ অনুশীলন করে আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিব  পুত্রের নাম শেখ রাসেল রেখেছিলেন।
শেখ রাসেল কী হতে পারতেন তা আমাদের কারও জানা না থাকলেও একটা প্রত্যাশার অপমৃত্যু যে ঘটেছে সেটা বলা যেতেই পারে। শেখ পরিবারের সবচেয়ে আদরের ফুটফুটে হাসিমাখা শিশুটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে নিহত হন ঘাতকের বুলেটে। একটি সুন্দর গোলাপ বিকশিত হওয়ার আগেই বিনষ্ট হয়ে যায়। কী অপরাধ ছিল নিষ্পাপ শিশুটির? এ প্রশ্ন যখন মনে জাগে তখন সবার হৃদয় মন্দিরে করুণ বেদনার সুর বেজে ওঠে। কত স্বপ্ন ছিল তাকে ঘিরে।

রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় পিতার প্রত্যক্ষ স্নেহ থেকে ছিলেন বঞ্চিত শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ছিলেন ব্যস্ত। জেলখানা ছিল তার নিত্যসঙ্গী। বিভিন্ন সূত্রে তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু যখন জেলে থাকতেন তখন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব জেলখানায় নিয়ে যেতেন শেখ রাসেলকে পিতার সঙ্গে দেখা করাতে। পিতাকে জড়িয়ে ধরতে উদ্যত হতেন, রাসেল জেলখানা থেকে পিতাকে বাড়িতে যাওয়ার বায়না ধরত।

অবুঝ ওই শিশুকে বোঝানো হতো জেলখানা তার পিতার আরেকটি বাড়ি। এমনিভাবে এক নিষ্ঠুর রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে উঠছিলেন শেখ রাসেল। এরপর উত্তাল গণ-আন্দোলন। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা অর্জন। নানা ইতিহাস ঘিরে শেখ রাসেল বড় হতে থাকেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশের হাল ধরেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে পুনর্গঠনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন দেশে সফরের আমন্ত্রণ পাচ্ছেন। বেশিরভাগ সময়ই সফরসঙ্গী হিসেবে আদরের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলকে নিয়ে যেতেন বিদেশে। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর শিশু রাসেল সফর উপভোগ করতেন।

চাহনিতে তার বীরত্বের ছাপ। জন্মের পর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শেখ রাসেল দেখেছেন তার পিতার বাগ্মিতা। অগণিত নেতা-কর্মীর সংস্পর্শে শেখ রাসেল শিশু বয়সেই মানবিক পথের যাত্রী হিসেবে বেড়ে উঠছিলেন। রাজনীতির কিছু না বুঝলেও অনন্য উদ্দীপনা ছিল শিশু চরিত্রের লক্ষণীয় বিষয়। বাসায় খেলা করতেন আনন্দচিত্তে।
কে জানত অমানিশার অন্ধকার নেমে আসবে শিশু বয়সেই! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছরের মায়াবী মুখখানি হারিয়ে যায় বিশ্বজগৎ থেকে। নির্দয় ঘাতক দলের এতটুকু করুণা হয়নি। শিশু রাসেল বাঁচতে চেয়েছিলেন! ঘাতকরা ৩২ নম্বরে অবস্থানরত পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যার পর শেখ রাসেলকে সর্বশেষ শিকাড়ে পরিণত করে। প্রত্যক্ষদর্শী বঙ্গবন্ধুর এপিএস মোহিতুল ইসলামের বর্ণনানুযায়ী শেখ রাসেল বলেছিলেন, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? মুহিতুল কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘তোমাকে মারবে না ভাইয়া’। রাসেল মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল। তাকে মায়ের মৃতদেহের পাশেই ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে খুনিরা। কী নির্মম বীভৎসতা।
খুনীরা বাঁচতে দেয়নি শেখ রাসেলকে। কী অপরাধ ছিল রাসেলের? পরিবারের সব সদস্যের হত্যার দৃশ্য শিশু বয়সেই সে প্রত্যক্ষ করেছে। তারপরও সেকি ভাবতে পেরেছিল যে তাকেও চলে যেতে হবে পৃথিবী থেকে চিরতরে। মনুষত্ব, বিবেকবোধ কোথায় ছিল সেদিন? শেখ রাসেল আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার আত্মা অমর অক্ষয়। আত্মার স্পর্শ কী অনুভব করা যায়? আত্মাকে বাক্য দিয়ে ধরে রাখতে না পারলেও ঘুরে-ফিরে আসে তার অনন্ত মহিমা। আমরা শেখ রাসেলকে বাঁচাতে পারিনি এ অপরাধবোধেই শেখ রাসেল চিরজীবী হয়ে থাকবেন বাঙালির অন্তরে। প্রতিটি শিশুর অবয়বে শেখ রাসেল জীবন্ত প্রতীক।
 
লেখক : সংসদ সদস্য
খাদ্যমন্ত্রী

×