ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

জুমার নামাজের তাৎপর্য

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২

জুমার নামাজের তাৎপর্য

জুমার নামাজের তাৎপর্য

মুহাম্মদ ইবনে সিরিন (রহ:) বলেন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর হিজরতের পূর্বে এবং জুমার নামাজ ফরজ হওয়ার আগে মদিনা শরীফের লোকেরা মুসলমানদের একত্রিত করার ব্যবস্থা করেন এবং তারাই এই দিনকে জুমার দিন বলে নামকরণ করেন। এর প্রেক্ষাপট হলো এই যে, একবার মদিনার আনসারী সাহাবীগণ পরস্পর এ কথা বলাবলি করলেন যে, খ্রীস্টান ও ইহুদীরা নিজেদের একত্রিত হওয়ার জন্য একটি দিন সাব্যস্ত করে নিয়েছে।
সুতরাং আমাদেরও এমন একটি দিন সাব্যস্ত করা আবশ্যক যে, এ দিনে আমরা সালাত আদায় করব, জিকির করব এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব। পরামর্শক্রমে জুমার দিনকে তারা এ কাজের জন্য সাব্যস্ত করেন। এর পূর্বে এ দিনকে ‘ইয়াওমুল আরূবাহ’ বলা হতো।

এরপর একদা আনসারী সাহাবাগণ হযরত আসয়াদ ইবনে যুরারাহ (রাদি:)-এর নিকট একত্রিত হলে তিনি তাদের নিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন এবং একে জুমার দিন বলে নামকরণ করেন। এরপর তিনি তাদের জন্য বকরি জবেহ করেন এবং সকলেই তা থেকে আহার করেন। তাফসিরে মাআরিফুল কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে, আরবে কাব ইবনে লুয়াই সর্বপ্রথম এর নাম ইয়াওমুল জুমা রাখেন। এদিনে কুরাইশদের সমাবেশ হতো এবং কাব ইবনে লুয়াই ভাষণ দিতেন। এটা রাসূল (স.)-এর আবির্ভাবের পাঁচশত ষাট বছর পূর্বের ঘটনা। কাব ইবনে লুয়াই ছিলেন রাসূল (স.)-এর পূর্ব পুরুষদের অন্যতম।

মহান কুরআন ব্যাখ্যাতে হযরত ইবনে কাসির বর্ণনা করছেন, মদিনা শরীফে নবীজি (স.) যখন জুমার নামাজ ও খুতবা দিতেন, তা সুসমাপ্ত হওয়ার আগেই কিছুসংখ্যক মুসল্লি সিরিয়া থেকে আসা দেহইয়া ইবনে খালফ কালবির বাণিজ্যিক কাফেলা দেখে সস্তায় কেনাকাটার জন্য মসজিদ থেকে বেরিয়ে যান। তাদের বারণ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা সূরা জুমা নাযিল করলেন।
ইরশাদ হচ্ছে- হে ঈমানদারগণ! যখন জুমার নামাজ আদায় করার জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ত্বরা কর এবং ব্যবসা-বাণিজ্য স্থগিত কর, এটি তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা গভীরভাবে উপলব্ধি কর।’
কারও কারও মতে ইয়াওমুল জুমা’ অর্থ একত্রিত হওয়ার দিন। যেহেতু হযরত আদম (আঃ) ও হযরত হাওয়া (আঃ) দুনিয়ায় এ দিনেই একত্রিত হয়েছিলেন। তাই এ দিনকে ‘ইয়াওমুল জুমা’ বলা হয়।
আবার কেউ কেউ বলেছেন, যেহেতু এ দিনের মাঝে অনেক কল্যাণ জমা করা হয়েছে, তাই এই দিনকে ইয়াওমুল জুমা বলা হয়। জুমার দিনের ফযিলতের কথা অনেক হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। কয়েকটি হাদিস নি¤েœ উল্লেখ করা হলো-
হযরত রাসূলে কারীম (স.) বলেছেন- সর্বোত্তম দিন হলো জুমার দিন। এদিনে হযরত আদমকে (আঃ) সৃষ্টি করা হয়েছে। এদিনে তাঁকে জান্নাতে দাখিল করা হয়েছে, এদিনে হযরত আদমকে (আঃ) জান্নাত থেকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে এবং এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। -(মুসলিম শরীফ ১ম খ-)।
জিন এবং ইনসান ব্যতীত সকল প্রাণীকুল শুক্রবার দিন সুবহি সাদিক থেকে নিয়ে সূর্যোদয় পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে অপেক্ষমাণ থাকে। এ শুক্রবার দিন এমন একটি সময় আছে, যে সময় কোন মুসলিম বান্দা নামাজ আদায়রত অবস্থায় আল্লাহর কাছে যে কোন জিনিসের প্রার্থনা করবে, আল্লাহ তাকে তা দান করবেন।
জুমার দিনে কিছু সুন্নাত ও মুস্তাহাব কাজ রয়েছে। যেমন- (১) গোসল করা। (২) মিসওয়াক করা। (৩) সুগন্ধি ব্যবহার করা। (৪) উত্তম কাপড় পরিধান করা। (৫) জুমার নামাজের জন্য সকাল সকাল যাওয়া। (৬) ধীরস্থির গাম্ভীর্যের সঙ্গে হেঁটে নামাজের দিকে যাওয়া।(৭) ইমামের কাছে বসা। (৮) জুমার দিনে এবং রাতে রাসূলুল্লাহর (স.) ওপর বেশি বেশি দরূদ পাঠ করা। (৯) দোয়া কবুলের বিশেষ মুহূর্তটি পাওয়ার জন্য অধিক পরিমাণে দোয়া করা। (১০) জুমার দিনে গোসলের পূর্বে হাত-পায়ের নখ কাটা। (১১) জুমার নামাজে রাসূলুল্লাহ (স.) সূরা জুমা এবং সূরা মুনাফিকুন অথবা সূরা আ’লা এবং সূরা গশিয়া পড়তেন। (১২) জুমার দিন নামাজের পূর্বে অথবা পরে সূরা কাহ্ফ তিলাওয়াত করা খুবই সওয়াবের কাজ।
জুমার নামাজ ফরজে আইন এ কথা কুরআন, হাদিস ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। জুমার নামাজ অস্বীকারকারী কাফির এবং ওজর ব্যতীত কেউ যদি তা তরক করে, তবে সে হবে ফাসিক।
হযরত সালমান ফারসী (রাদিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন- যে ব্যক্তি জুমার দিন যথাযথভাবে গোসল ও পবিত্রতা অর্জন করে এবং নিজের কেশরাজিতে তৈল মেখে অথবা সুগন্ধি ব্যবহার করে নামাজের জন্য মসজিদের উদ্দেশে রওনা হয় এবং মসজিদে এসে দুই ব্যক্তির মাঝে ফাঁক করে না, তারপর যে পরিমাণ নফল নামাজ তার অংশে নির্ধারিত তা আদায় করে, এরপর ইমাম সাহেবের খুৎবা পাঠ করার সময় চুপ করে বসে খুৎবা শ্রবণ করে, আল্লাহ তায়ালা তার বিগত জুমা থেকে বর্তমান জুমা পর্যন্ত যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেবেন।- (বুখারী)।
সপ্তাহের এ মহাপবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দিবসটি আমাদের সংস্কৃতিতে উপেক্ষিত। আমরা এর বরকত হাসিলে সারাদিন আন্তরিক থাকি না। বরং পরিবেশ আমাদের প্রচণ্ড জুমাবিমুখ করে তুলছে। বর্তমান সমাজে জুমার দিন মানেই যেন রাত-দিন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াতে সিনেমার আসর, বিভিন্ন স্থানে বিনোদনের প্রোগ্রামে যাওয়ার দিন হয়ে গেছে।

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]

×