আমরা যারা চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের কাছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল কোন অপরিচিত শব্দ নয়। আর এই করোনাকালে বিশেষ করে ভ্যাকসিনের কল্যাণে এই শব্দটির সঙ্গে এখন সাধারণ মানুষও কম-বেশি পরিচিত। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের একটা অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে একই রকম দুটি বিষয়ের মধ্যে তুলনা করে দেখা শ্রেয়তর কোনটি। আর এই যাচাই-বাছাইয়ে কোন রকম পক্ষপাতিত্ব যাতে না চলে আসে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে নানা রকম নিয়ম-কানুনের বালাই। গত ক’দিন আগে মার্কিন গণতন্ত্রের একেবারে যাকে বলে ‘কলিজা’, সেই ক্যাপিটল হিলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেখে হঠাৎ করে কেন যেন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কথাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
সদ্যই যুগপূর্তি হলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের টানা ক্ষমতায় থাকার। এই বারো বছরে পরীক্ষা কম দিতে হয়নি দলটিকে আর দলের সরকারকে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি থেকে শুরু করে আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারা আর বিশ্ব রেকর্ড ভঙ্গ করা টানা হরতাল- কী নয়? দফায়-দফায় মানুষের সমর্থনে ক্ষমতায় এসেও প্রমাণ দিতে হয়েছে গণতন্ত্রের প্রতি তাদের আনুগত্য। কি হাস্যকর কথা! কারণ শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেরই নয়, বরং বর্তমানে গোটা পৃথিবীতে অন্যতম প্রাচীন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আর পৃথিবীতে ক্ষমতাসীন দ্বিতীয় কোন রাষ্ট্র অথবা সরকার প্রধানের রাজনৈতিক বায়োডাটার দৈর্ঘ্য শেখ হাসিনার চেয়ে দীর্ঘ নয়।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্রের পরীক্ষা দিতে হয়েছে বিএনপির সাপেক্ষে, যাদের জন্মই সেনানিবাসে। আর এই পরীক্ষাগুলোর প্রিন্সিপাল আর কো-প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটররা বরাবরই ছিলেন পক্ষপাতদুষ্ট ‘সো কল্ড’ সুশীলরা। ফলে ট্রায়ালে উৎরাতে বারবারই বেগ পেতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। আমাদের চিকিৎসা শাস্ত্রের বিবেচনায় এসব ট্রায়াল সে সমস্ত কারণে কখনই যথার্থতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। আর সে জন্যই মার্কিন মূলকের সাম্প্রতিকতম ঘটনাটি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। নব্বই থেকে যদি শুরু করি তাহলেও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য মুক্তিযুদ্ধের পরের সাড়ে তিনটি বছর যোগ দিলেও পঁয়ত্রিশ পেরোয় না। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দু’শ’ বছরের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের তুলনাটাও বেমানান। অথচ সেখানটাতেই কি দারুণ সফলতায় উত্তীর্ণ আমরা। আর পাশাপাশি উত্তীর্ণ আমাদের বিরোধী দলও। কারণ, নির্বাচনে হেরে গিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে গিয়ে যা খুশি তাই করতে পারায় তাদের পারঙ্গমতাটা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমতুল্য তা নিয়ে নিশ্চয় কেউ দ্বিমত করবেন না। কাজেই আমাদের বিরোধী দল যখন ওদের সমানে-সমান আর গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা আর আনুগত্যের পঁয়ত্রিশ বছরের ঝঞ্ঝাবহুল ইতিহাস নিয়েও আমরা যখন হার মানাই মার্কিনীদের দু’শ’ বছরের গণতান্ত্রিক ইতিহাসকে, তখন এই অসম ট্রায়ালে আমরা যে শুধু উৎরেই যাইনি, বরং আমাদের সুপিরিওরিটিও যে পরিষ্কার, সেটা বলাই বাহুল্য।
আরেকটা ব্যাপারও পাশাপাশি আলোচনায় তুলে আনাটা জরুরী। ইদানিং কোভিড-১৯ সংক্রান্ত যে কোন টকশোতে দেশের মানুষের সচেতনতার অভাবকে দায়ী করাটা আমাদের অনেকটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অথচ আমরা ভুলে যাই যে, নির্বাচনে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জেতা গেলেও, কোভিডকে হারাতে চাই শতভাগ গরিষ্ঠতা। তাও শুধু এক দেশে নয় দেশে-দেশে, বরং বলা উচিত পৃথিবীর তাবত দেশে। আর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পুরো পৃথিবী তো দূরে থাক, পৃথিবীতে কখনই, কোন দেশেই, কোন বিষয়েই সব মানুষ একমত হতে পারেননি। কাজেই বাংলাদেশের বেলাতে তেমনটি ঘটবে, এমনটা প্রত্যাশা করাটাই অন্যায়। বরং আমাদের তো মনে হয় বাংলাদেশের মানুষ অনেক দিক থেকেই অনেক বেশি সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন, যা দিতে পারেননি ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নততম দেশগুলোর মানুষও। আমরা কম-বেশি মাস্ক পরছি এটি যেমন ঠিক, আরও বেশি-বেশি পরলে যে আরও ভাল হতো, তা নিয়েও দ্বিমত করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা তো অন্তত এটুকু গর্ব করে বলতে পারি যে, নিউইয়র্ক, লন্ডন বা বার্লিনের মতো ঢাকায় আমরা মাস্কবিরোধী কোন মিছিল-সমাবেশ দেখিনি। আর দেশের মানুষকে ভ্যাকসিন নেয়ায় উদ্বুদ্ধ করতেও আমাদের দেশে আর যাই হোক অন্তত ফতোয়া জারির প্রয়োজন পড়েনি।
আমাদের কারও কারও সমস্যা হচ্ছে টেবিলে রাখা গ্লাসটার খালি অর্ধেকটাই আমাদের চোখে পড়ে! গ্লাসটা যে অর্ধেক ভরা, সেটা আমরা কেন যেন বেমালুম ভুলে যাই। আর এই ভুলে যাওয়াতেই যত বিপত্তি। আমরা যদি আমাদের ভুলো বাঙালী খেতাবটা ঘোচাতে পারতাম, কেন যেন মনে হয় আমাদের অতীত আর ভবিষ্যত আরও অনেক বেশি সমুজ্জ্বল হতো।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ