
একটি ভবন নির্মাণ করতে যেমন মজবুত পিলার প্রয়োজন হয় তেমনি একটি প্রকৃত মানুষ, আদর্শ জাতি গঠন এবং দেশ বিনির্মাণের জন্য কিছু বিশেষ গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ প্রয়োজন। সুস্থ প্যারেন্টিং হলো সেই বিশেষ গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ গঠনের পূর্বশর্ত। প্যারেন্টিং হলো শিশুর জন্ম থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের পরিচর্যা। একটি শিশু শুধু একটি পরিবারেরই অংশ নয় বরং একটি সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই শিশু যখন পরিবারে বেড়ে ওঠে তখন তার মূল্যবোধ গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে প্যারেন্টিং। কথায় আছে ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।’ পরিবার থেকে শিশু যে শিক্ষা, আদর্শ, রুচিবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠে সেভাবেই গঠিত হয় তার মূল্যবোধ। শিশুর যদি সুস্থ মানসিক বিকাশ না ঘটে তাহলে একসময় তারা বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষের পরিণত হয়ে যায়। যার দ্বারা আমাদের ভবিষ্যৎ সুন্দর নয় বরং সুন্দর ভবিষ্যৎ ভেঙে গিয়ে এক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়। তাই শিশুর প্যারেন্টিংয়ের ক্ষেত্রে তার নৈতিক মূল্যবোধের দিকে নজর রাখা অভিভাবকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
শিশুর প্যারেন্টিং তার ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকে নয় বরং আগে থেকেই শুরু করা উচিত। শিশুর শারীরিক বিকাশের জন্য গর্ভধারণের আগে মায়ের শারীরিক সুস্থতার দিকে নজর দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে সঙ্গে মানসিক সুস্থতা দিকেও নজর রাখতে হবে। মায়ের মানসিকতার ওপর শিশুর মানসিক সুস্থতা নির্ভর করে থাকে। মায়ের ইতিবাচক আবেগ শিশুর মধ্যে সুস্থতা আনে ঠিক একইভাবে নেতিবাচক আবেগ শিশুর মধ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি করে। গর্ভাবস্থায় শিশুরা প্রায় ২০-২৭ সপ্তাহের মধ্যে শব্দ শুনতে পায়। তাই গর্ভাবস্থায় মায়ের ইতিবাচক মনোভাব ও কাজের মধ্যে থাকার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি মায়ের মানসিক সুস্থতার দিকে নজর দিয়ে সুস্থ পরিবেশ তেরি করে দেওয়া উচিত।
শিশুকে ছোট থেকেই সুস্থ ও কর্মঠ করে গড়ে তোলা উচিত। যার ফলে শিশু শারীরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে গড়ে উঠতে পারে। সুষম খাদ্য তালিকা এবং শরীর চর্চা রোগ-প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলে অল্পতেই শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অভিভাবকদের অনেকেই সন্তানদের শারীরিক যত্ন নিলেও মানসিকভাবে যত্ন নেওয়ার বিষয় তেমন গুরুত্ব দেন না। সুস্থ মানসিক চর্চার অভাবেই দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে কিশোর গ্যাঙ, মাদকাসক্ত, ধর্ষক, চোর এবং ছিনতাইকারীর সংখ্যা।
শিশুকে সহনশীল হওয়া ও ধৈর্যধারণ করতে শেখানো উচিত। ধৈর্যধারণ মানুষের জীবনের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা যা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে শেখায়। দুঃখ বা বিপদ প্রতিটি মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যারা বিপদের সময় ধৈর্যধারণ করে মহান আল্লাহর ওপর আস্থা রেখে বিপদ মোকাবিলায় অগ্রসর হয় তারাই জীবনে সফল হতে পারে। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে জীবনের এই অবিচ্ছেদ্য অংশ মেনে নেওয়া তো দূরের কথা বরং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়লে তা সমাধান বা মোকাবিলার চেষ্টা না করে তারা এর জন্য অন্যকে দায়ী করে এর প্রতিশোধ পরায়ণতায় দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যে কোনো বিষয়ে খুব সহজেই তারা হতাশ ও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। আবেগ নিয়ন্ত্রণে অক্ষম হয়ে পরে এবং তাদের মধ্যে রাগ, জেদ, অস্থিরতার বিরাজ করে। আর এই প্রক্রিয়া সচারাচর চলতে চলতে বর্তমান এটি খুবই স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধৈর্যধারণের অভাবে অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে মানুষ ভুল করে ফেলে। তাই প্যারেন্টিংয়ের ক্ষেত্রে শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য এসব বিষয়ের দিকে নজর রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সন্তানকে অভাব শেখানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু পরিবারের কাছে কোনো জিনিস আবদার করার সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যায়, যা স্বাভাবিকভাবে একটি শিশুকে অভাব এবং কষ্ট থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য যে পরিশ্রম, কষ্ট বা সাধনার প্রয়োজন হয়, হয়তো তারা এই সাধারণ জ্ঞান থেকেই বঞ্চিত হয়ে পড়ে। ফলে খুব সহজেই তারা মানুষের মধ্যে শ্রেণিবিভেদ তৈরি করতে পারে। তারা অন্যের কষ্টের প্রতি সংবেদনশীল হতে পারে না। ফলস্বরূপ খুব সহজে অকৃতজ্ঞ হয়ে উঠতে পারে। এছাড়াও তারা অর্থের মূল্য বুঝতে পারে না এবং তাদের মধ্যে অপচয় প্রবণতা বেশি দেখা যায়, যা একটি পরিবার, সমাজ বা দেশের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
প্যারেন্টিংয়ের ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা। ধর্মীয় নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের শিক্ষা শিশুদের জীবনে চলার পথে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে। কিন্তু বর্তমান সমাজে বিষয়টির গুরুত্ব যেন ক্রমেই কমে আসছে। শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিটি আচরণের দিকে খেয়াল রাখা উচিত। বিশেষ করে বর্তমান জেনারেশনে শিশুদের মধ্যে জিদের নজির বেশি লক্ষণীয়। তারা যেকোনো বিষয়ে গো ধরে বসে থাকলে, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে এই বলে তাদের অভ্যাসটিকে গুরুত্ব দেয় না। এছাড়াও বড়দের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে, বাসায় মেহমান বা অপরিচিত মানুষ আসলে তাদের সালাম দেওয়া এবং তাদের সঙ্গে সুন্দর করে কথা বলা এ বিষয়গুলো দিন দিন লোপ পাচ্ছে। বর্তমানে শিশুর বিনোদনের মাধ্যম খেলাধুলা নয় বরং মোবাইল ফোন। মোবাইলে বিভিন্ন ধরনের টিকটক, রিলস এসব দেখা তাদের স্বাভাবিক অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই মোবাইলসহ বিভিন্ন আধুনিক ডিভাইসের পরিবর্তে তাদের খেলাধুলার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এতে শিশু শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকবে।
আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা ও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশে শিক্ষিত, সচেতন ও জ্ঞানবান সমাজ গঠন সময়ের দাবি। নতুন প্রজন্ম যেন তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিক উন্নয়ন করতে পারে সেভাবে তাদের সঠিক দিকনির্দেশনায় গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি দেশে নতুন ধারা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে এবং একটি সুস্থ, দক্ষ, দায়িত্বশীল, সৎ ও নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন জাতি গড়ে তোলতে স্মার্ট প্যারেন্টিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
প্যানেল