ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

পবিত্র মহরমের মাহাত্ম্য

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:১১, ৫ জুলাই ২০২৫

পবিত্র মহরমের মাহাত্ম্য

পবিত্র মহরমকে আলোকপাত করতে গেলে ইসলামের ইতিহাসের মূল পর্বে বিভিন্ন ঘটনাবলির যথাযথ বর্ণনা প্রাসঙ্গিক মরু প্রান্তর আরবে হজরত মুহম্মদ (স.)-এর আলোকিত শুভাগমন বিশ্ব ইতিহাসের নবতর ধারা। রসুলে কমির হজরত মুহম্মদ (স.)-এর জীবন কাহিনী যেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন আরবের নবদ্যুতির ধারা পাশাপাশি ধর্ম হিসেবে ইসলামের জয়ধ্বনিও এক অভাবনীয় শৌর্য। আরবের চরম নৈরাজ্যের যুগসন্ধিক্ষণে  রসুলে করিম (স.) এর আবির্ভাব ও শ্রেষ্ঠধর্ম ইসলামের গৌরাবান্বিত অধ্যায় আজও জগতের আলোয় বিচ্ছুরিত হচ্ছে। বিবি ফাতেমা (রা.) ছিলেন রসুলুল্লাহর কন্যা। সে সময় ইসলাম ধর্মের প্রচার কত পাহাড় সমপ্রাচীরে ঘেরা ছিল পৌত্তলিকতার চরম দুঃসময়ে। ইসলাম ধর্মের সূচনা লগ্নে রসুলুুল্লাহর কয়েক সাহাবি মুসলমান হিসেবে প্রথম ইসলাম ধর্মের পতাকায় এক সুতায় মিলিত হন। হজরত মোয়াবিয়া (রা.)ও ছিলেন প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণে রসুলুল্লাহর সাহাবিদের অন্যতম। তারই পুত্র এজিদ কারবালার অসহনীয় নিষ্ঠুর ঘটনার যথার্য খলনায়ক বলে ইসলামের ইতিহাসের করুণ আখ্যান। আমরা হিজরির প্রথম মাস মহরমের পবিত্রতায় স্মরণ করছি কারবালা প্রান্তরের নির্মম ঘটনার। বাস্তব কাহিনীর প্রারম্ভে উল্লেখ করছি বিদ্রোহী কবি নজরুলের ‘মহরম’ কবিতায় সূচনা লাইন-
নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া
আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া। 
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে, 
সেই কাঁদনে আশু আনে সীমারেরও ছোরাতে।
সত্যিই এক নির্মম দুর্ঘটনার ঐতিহাসিক কাহিনী সম্ভার। বাংলা সাহিত্য আর বর্ণনায় কারবালা মরু প্রান্তরের করুণ ঘটনা প্রবাহ আজও শোকাবহ স্মরণে-বরণে মুসলমানরা পালন করে  থাকেন। বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান লেখক, চিন্তাবিদ, কথাসাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেনই কারবালায় ঘটে যাওয়ার দৃশ্যপট প্রথম আলোচনায় আনেন তার বিখ্যাত রচনা ‘বিষাদ সিন্ধুর’ মধ্যে। যা আজও  বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের জন্য এক অবিস্মরণীয় মহাকাব্য বলা যায়। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনেরা বলছেন ‘বিষাদ সিন্ধু’ এক অনন্য মহাকাব্যিক উপন্যাস। যা জনপ্রিয়তায় এক অতুলনীয় সম্পদ। চাঁদের হিসেবে হিজরি সনের ’৬১ সালে এমন মর্মস্পর্শী কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া ইসলামের ইতিহাসের আর এক দুঃসহ বাতাবরণের রক্তক্ষয়ী অভিযান। এখানে ‘বিষাদ সিন্ধু’ আলোচ্য বিষয় নয় বরং বাস্তব কাহিনীর যথাযথ ঘটন-অঘটনকে নির্মোহ চিত্তে তুলে ধরাই মূল বিবেচ্য। আমরা জানি হজরত আলী (রা.) ও মা বিবি ফাতেমা (রা.) রসুলুল্লাহর অতি প্রিয়তমা কন্যার সঙ্গে বিবাহ বন্ধন ইসলামের ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল এক আখ্যান। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে পবিত্র মক্কা শরীফের কাবা ঘরে নতুন ও শ্রেষ্ঠতম ধর্ম ইসলামের জয়ধ্বনি মুসলিম দুনিয়ায় এক অভাবনীয় শৌর্য-বীর্যের ঘটনা পর্যন্ত আমরা জানি পবিত্র মক্কায় ইসলাম ধর্মের ঘটনা পর্যন্ত। আমরা জানি পবিত্র মক্কায় ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন অত সহজসাধ্য ছিলই না। রসুলুল্লাহর আজীবন নূরানী গতি প্রবাহ সে সময়ের এক অসাধারণ দ্যুতিময় ইতিহাস। কখনো মিথ্যা কথা বলতেন না তাই ‘আল আমিন’ নামে অভিষিক্ত হতেও সময় লাগেনি। আর কন্যা বিবি ফাতেমা (রা.) ছিলেন নবীজির স্নেহাস্পদ অমূল্য রতন। যে সময়ে কন্যা সন্তান প্রসব করলেই জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। তেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন মরু প্রান্তরে মহানবী (সা.)-এর  শুভাগমন বিশ্ব ইতিহাসের আলোকিত অভ্যুদয়। বিবাহের আলী (রা.) ও বিবি ফাতেমা (রা.)-এর শুভ বিবাহের পরবর্তী সময়ও মারামারি, হানাহানির অবসান না হওয়াও বিশে^র শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলামের কিছু দুর্ভোগ তো বটেই। ইসলামের ইতিহাসে বদরের যুদ্ধ, উহুদের যুদ্ধ, হুদায়বিয়ার সন্ধি সবই যাত্রাপথের দুঃসাহসিক আখ্যান তো বলাই যায়। রসুলুল্লাহ (সা.) বিবি ফাতেমা (রা.)-এর দুই সন্তান হাছান-হোসেনকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। কিংবদন্তিতে আছে দৌহিত্রদ্বয়ের গলায় বারবার চুম্বন করতেন নবীজি। তেমন চুম্বনের পরম দোয়া, রহমত, হাছান-হোসেনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নাকি ধারণ- লালন করেছেন বলে ইতিহাসে বর্ণিত আছে। তার পরেও ইসলামের ইতিহাস সাংঘর্ষিক রক্তাক্ত ঘটনাবলির ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যায়। পবিত্র ধর্ম কখনো কলুষিত হয়নি বলে পরবর্তী সাহাবাগণ ধারণা দেন। কিন্তু বারবার মুসলমান জাতিকে বিভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট করা হলেও পবিত্র ইসলাম আপন মাহাত্ম্যে চিরঞ্জীব সুধায় আজও অনুসারীদের ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। মরুভূমির কারবালা প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে যে সংঘটিত ঘটনা ইতিহাসের ক্ষত চিহ্ন হয়ে আছে তার নির্মম প্রতিহিংসায় জীবন দিতে হয়েছে নবীজির প্রিয়তম দৌহিত্রদ্বয়ের। নির্মম নিষ্ঠুরতার কঠিন বেষ্টনীর মধ্যে সংহার মূর্তির হৃদয় বিদারক ঘটনালেখ্য। যা আজও মুসলমানদের জন্য এক শোকাবহ করুণ আলেখ্য। মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় প্রিয়তম দৌহিত্ররা সব সময় তার স্নেহাতিশর্যের ছোয়া পাওয়াটাই শুধু নয় নামাজের সময় সিজদায়ও রসুল (সা.)-এর পিঠে উঠে যেতেন। নিজের থেকে কখনো প্রিয়তমদের নামাতেন না। তাদের খুশিমতো নেমে যাওয়ার পরই নবীজিী সিজদা থেকে মাথা তুলতেন। রসুলুল্লাহ (সা.) দৌহিত্রদ্বয়ের মৃত্যুশোক সহ্য করতে হয়নি পরম করুণমায়ের অসীম কৃপায়। পবিত্র আশুরা কিংবা মহরমের দশ তারিখ আসলেই বিশ^জুড়ে মুসলমানদের মাতম ওঠে ‘হায় হোসেন’, ‘হায় হাছান বলে’। ঘটনা পরম্পরায় কত হিজরি সন পার হয়ে গেল আজও নিষ্ঠুরতম ঘাতক এজিদকে তুলনা করা হয় সহিংস নির্মম কাহিনীর নায়ক হিসেবে। ইতিহাসে বর্ণিত আছে এজিদ ইমাম হোসেনের বুকের ওপর বসে গলায় ছোরা বসিয়ে বিচ্ছেদ করতে গেলেও ব্যর্থ হয়। কারণ রসুলুল্লাহ (সা.) পবিত্র চুম্বনের ছোঁয়া ভেদ করে এজিদের ধারালো ছোরাও নাকি বিন্দু বিসর্গ আঁচ বসাতে পারেনি। ইমাম হোসেনকে উপুড় হতে হয়েছিল। গলা নয় ঘাড়ের ওপর  ছোরা চালাতে হয়। ইতিহাস বিধৃত বাস্তবোচিত ঘটনায় নবীজির প্রিয় দৌহিত্রকে এভাবেই শেষ নিশ^াস ত্যাগ করতে হয়। সে সময় নাকি কারবালার মরু প্রান্তর ‘হায় হোসেন’, ‘হায় হাছানে’র নাম বিদীর্ণ হয়ে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে যায়। সত্যিই ইসলামের ইতিহাসের নিদারুণ শোকাভিভূত হওয়ার করুণ অমানবিক হত্যাকাণ্ড। যা আজও মুসলমানদের শোকে মুহ্যমান করে তোলে। শেষ সময়ে কারবালার মরুপ্রান্তর শুধু হায় হোসেন করাই নয় তার চেয়েও বেশি সামান্য পানির জন্যও বিদীর্ণ হাহাকার উঠেছিল। সাংঘর্ষিক এমন দুর্যোগ- দুর্ভোগ এখনো পবিত্র ইসলাম ধর্মের চরম অশান্তির দাবানল। নিষ্ঠুরতার নিদর্শন হিসেবে ঘাতক সীমারের নাম পবিত্র ধর্মের অনুসারীরা ভুলতে পারে না। আর কবি-সাহিত্যিক সৃজন বোদ্ধাদেরও কম্পমান, আলোড়িত অনুভবে স্মরণ-বরণে নিষ্ঠুর ইতিহাসকে বয়ে বেড়ানো হতে নিষ্কৃতি নেই। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মধ্যগগনেও সপ্তম শতকের এমন দুর্ধর্ষ ঘটনার রেশ মুসলমানদের শোকে পাথর করে দেয়। 

 

প্যানেল

×