ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

কেরির বড়ি: সহজ মৃত্যুর ফাঁদ, সমাজের নীরব আত্মহত্যা

সোহাইল আহমেদ

প্রকাশিত: ১১:৪৪, ৬ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৩:২৮, ৬ জুলাই ২০২৫

কেরির বড়ি: সহজ মৃত্যুর ফাঁদ, সমাজের নীরব আত্মহত্যা

সোহাইল আহমেদ

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি শব্দ এখন আতঙ্ক ও মৃত্যুর প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছে—‘কেরির বড়ি’। এটি কোনো ওষুধ নয়, কোনো পথ্য নয়, এটি মৃত্যু ডেকে আনার এক ভয়ানক অস্ত্র। নামটা সাধারণ হলেও এর পরিণতি মারাত্মক। গত দুই মাসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ১৫০ জন মানুষ এই বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার জন্য এমন একটি সহজ, সুলভ এবং দ্রুতঘটনকারী রাসায়নিক বড়ি দেশের বাজারে কীভাবে এত সহজলভ্য হলো—তা নিয়ে আজ প্রশ্ন উঠতেই হবে।

‘কেরির বড়ি’ নামটি স্থানীয় বা প্রচলিত নাম। সাধারণভাবে এটি হলো একটি কীটনাশকজাতীয় রাসায়নিক বড়ি, যা মূলত কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়। তবে এটি সহজে সেবনযোগ্য এবং শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া শুরু করে। এটি পাকস্থলীতে গিয়ে বিষক্রিয়া ছড়ায়, রক্তে অক্সিজেন পরিবহন ব্যাহত করে, হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসে দ্রুত ক্ষতি করে মৃত্যু ডেকে আনে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বড়িগুলোতে সাধারণত অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড, জিংক ফসফাইড বা অন্যান্য মারাত্মক রাসায়নিক থাকে, যা বিষক্রিয়ায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মানুষকে মেরে ফেলতে পারে। এটি এতই মারাত্মক যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই রোগী মারা যায়। চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসার সুযোগ থাকলেও এই বিষের প্রতিকার সীমিত, ফলে আত্মহত্যার জন্য এটি যেন এক ‘গ্যারান্টিযুক্ত মৃত্যু’ হয়ে উঠেছে।

আত্মহত্যার প্রবণতা ও বড়ির সহজলভ্যতা: বাংলাদেশে আত্মহত্যা একটি নীরব মহামারির রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর প্রায় ১০,০০০ এর বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। কিন্তু এর অনেকটাই আনরিপোর্টেড। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রেম, পারিবারিক কলহ, অর্থনৈতিক সংকট বা সম্মানহানির ভয় থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। আর এই প্রবণতায় সহজলভ্য ওষুধ বা বিষাক্ত উপকরণ এক অনুঘটকের কাজ করছে।

কেরির বড়ির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো—এটি যেকোনো সাধারণ দোকানেই পাওয়া যায়। কিছু কৃষি সরঞ্জাম বিক্রেতা তো এটিকে এমনভাবে বিক্রি করে যেন এটি সামান্য পেটের ব্যথার বড়ি! এই অনিয়ন্ত্রিত বিক্রি ও ব্যবহারের কারণেই কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে প্রৌঢ়রাও রাগে, অভিমানে কিংবা হতাশায় পড়ে তা সেবন করে মৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছেন।

সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক কলেজছাত্রী প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। ময়মনসিংহে এক গৃহবধূ স্বামীর নির্যাতনে কেরির বড়ি খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। বগুড়ায় এক কৃষক ঋণের দায়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন এই বড়ির মাধ্যমে। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে, এই বিষাক্ত বড়ি এখন সমাজে একটি অবাধ আত্মহননের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

এই সমস্যাটি শুধু বিষাক্ত বড়ির সহজলভ্যতার নয়—এটি আমাদের সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক মূল্যবোধ ও রাষ্ট্রীয় অবহেলার প্রতিচ্ছবি। একজন মানুষ যখন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে চরম অসহায়। সে চায় সহানুভূতি, সাহায্য, কিন্তু সেটা না পেয়ে সহজমৃত্যুর পথ খোঁজে। আর কেরির বড়ির মতো সহজলভ্য বিষ তাকে সেই পথ সহজ করে দেয়।

সমাধানের পথ কোথায়?

বিক্রি নিয়ন্ত্রণ ও আইন প্রয়োগ: এই বিষাক্ত বড়িগুলোর বিক্রয় প্রক্রিয়ায় কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। শুধু নিবন্ধিত কৃষক বা কৃষি প্রতিষ্ঠানের কাছে নির্দিষ্ট প্রয়োজনে ও সরকার অনুমোদিত লাইসেন্স থাকলে বিক্রি করা যাবে এমন বিধান করা জরুরি। যারা নিয়ম ভঙ্গ করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ: ইউনিয়ন পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং চালু করতে হবে। স্কুল, কলেজ, মসজিদ-মন্দির এমনকি ওয়ার্ড পর‌্যায়েও  মনোসামাজিক সহায়তা কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে মনোবিজ্ঞানী ও ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা একযোগে কাজে লাগাতে হবে।

মিডিয়া ও সামাজিক প্রচারণা: কেরির বড়ি বা আত্মহত্যার পদ্ধতি সংবাদে প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম, কমিউনিটি সভা ও ধর্মীয় মঞ্চে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ শুরু করতে হবে।

পরিবার ও সমাজের ভূমিকা: যারা আত্মহত্যার পথে যাচ্ছে, তারা পরিবারের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি সহানুভূতি প্রত্যাশা করে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রতিবেশীদের দায়িত্ব হলো, আত্মহত্যার ইঙ্গিত পাওয়া মাত্রই সহানুভূতি, ভালোবাসা ও সাহচর্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

শেষ কথা: কেরির বড়ি এখন আর শুধু একধরনের বিষ নয়—এটি আমাদের সমাজব্যবস্থার ব্যর্থতা, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব এবং একটি নীতিহীন বাজার ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। জীবন কোনো কিশোরীর অভিমান, কোনো কৃষকের দুশ্চিন্তা, কিংবা গৃহবধূর অপমানে শেষ হয়ে যেতে পারে না। প্রতিটি জীবন মূল্যবান। প্রতিটি আত্মহত্যা রোধযোগ্য।

আমরা যদি এই বিষাক্ত বড়ির বিক্রি বন্ধ করতে পারি, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে পারি, এবং মানুষের কষ্টে পাশে দাঁড়াতে পারি—তাহলে শুধু কেরির বড়িই নয়, আত্মহত্যার এই পথও বন্ধ হয়ে যাবে।


লেখক: সোহাইল আহমেদ
গণমাধ্যমকর্মী, কলামিস্ট, শিক্ষক ও সংগঠক।
 

তাসমিম

×