
ছবি:সংগৃহীত
চরম জনবল-সংকটে থেমে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের উপকূণীয় বরগুনার তালতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসাসেবা। দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার শেষ আস্থা ও ভরসার স্থল এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে মাত্র ৪ জন চিকিৎসক দিয়ে চলছে সেবা প্রদান। এখানে মোট ৪১টি চিকিৎসকের পদ রয়েছে, কিন্তু বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ৪ জন। এছাড়া অন্যান্য পদগুলিতে রয়েছে শূন্যতা, যার কারণে সেবা দিতে অক্ষম হয়ে পড়েছে হাসপাতালটি।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালে ২০ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মিত হয়। পরে ২০১৮ সালে ৭ জন চিকিৎসক ও ৫ জন নার্স নিয়ে চিকিৎসাসেবা শুরু হয়। ২০২২ সালে হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়, তবে কাগজে-কলমে শয্যা বাড়লেও প্রয়োজনীয় জনবল এবং চিকিৎসা সেবার খরচ অনেক বেশি হয়ে গেছে। বর্তমানে ৪১টি চিকিৎসক এবং ৬৪টি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদ শূন্য রয়েছে, অন্যদিকে নার্সের পদও শূন্য রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের বহির্বিভাগে দীর্ঘ লাইন, যেখানে সর্দি-জ্বর, ডায়রিয়া, গর্ভাবস্থা বা শিশুর অসুস্থতা নিয়ে রোগীরা এসেছেন। অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ, যারা একমাত্র ভরসা হিসেবে এই হাসপাতালটিকে নির্ভর করেন। কিন্তু রোগীদের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ না থাকায় অনেকেই বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যেতে বাধ্য হন। জরুরি ওষুধের অভাবে রোগীরা বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। জরুরি বিভাগের পরীক্ষাগুলোও করতে হচ্ছে বেসরকারি ক্লিনিক থেকে।
এছাড়া হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুলেন্সটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে, ফলে অ্যাম্বুলেন্স সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। বিদ্যুৎ চলে গেলে হাসপাতালের জেনারেটর থাকলেও তেলের অভাবে তা চালানো সম্ভব হয় না, ফলে হাসপাতালটি অন্ধকারে চলে যায়। ওয়ার্ডগুলোর পরিবেশ অত্যন্ত নোংরা, পানির সংকটও রয়েছে, এবং টয়লেটগুলোতে যাওয়ার অবস্থা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর।
স্থানীয় সজিব, ছিদ্দিক ও মামুন বলেন, “আমাদের গ্রামের প্রায় সবাই এই তালতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষজনের জন্য এটি একমাত্র চিকিৎসার ভরসাস্থল। কিন্তু এখানে এত কম চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী থাকার কারণে সেবা অনেক সময় পাওয়া যাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো করানো হয় না, তাই আমাদের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা বড় হাসপাতালে যেতে হয়, যা আমাদের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা।”
তারা আরও বলেন, “অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় জরুরি অবস্থায় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। হাসপাতালের অবকাঠামো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়, তাছাড়া বিদ্যুৎ সংকটের কারণে চিকিৎসা কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হয়। এসব কারণে রোগী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। আমরা স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি যেন দ্রুত এই সংকট নিরসনের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়।”
নিশানবাড়িয়া থেকে সেবা নিতে আসা কারিমা বেগম বলেন, "কিছুদিন আগে আমার ছোট ভাইয়ের হাত ভাঙা নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ায় বেশি টাকায় গাড়ি ভাড়া করে বরিশালে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম।"
তালতলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মনিরুল ইসলাম বলেন, “হাসপাতালে জনবল সংকটের কারণে চিকিৎসাসেবা ঠিকভাবে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যাতে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া যায়।” তিনি আরও বলেন, “সম্প্রতি অপারেশন থিয়েটার ও প্যাথলজি বিভাগ চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে, কিন্তু জনবল সংকট থাকায় তা চালু করা সম্ভব হয়নি।”
বরগুনা সিভিল সার্জন কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ বলেন, “জনবল সংকট নিরসনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। আশা করি, দ্রুত সংকট নিরসন হবে।”
মারিয়া