ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৭ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

চিন্তা দিয়ে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণে চীনের বিপ্লব

শেখ আফনান বিরাহীম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ২১:৫১, ৬ জুলাই ২০২৫

চিন্তা দিয়ে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণে চীনের বিপ্লব

ছবি: সংগৃহীত

চীন বর্তমানে মস্তিষ্ক কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই) প্রযুক্তিতে বৈশ্বিক নেতৃত্বের পথে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে সাংহাইয়ে এক যুগান্তকারী মানবিক ট্রায়ালে সম্পূর্ণরূপে সংযোজিত একটি চিপ একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই অস্ত্রোপচারটি পরিচালনা করেন সেন্টার ফর এক্সিলেন্স ইন ব্রেন সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স, যা ফুদান বিশ্ববিদ্যালয় ও হুয়াশান হাসপাতালের সহযোগিতায় সম্পন্ন হয়।

উচ্চ ভোল্টেজ দুর্ঘটনার কারণে চলাচলে অক্ষম সেই ব্যক্তি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কেবল চিন্তার মাধ্যমে রেসিং গেম ও দাবা খেলা শুরু করেন। তিনি জানান, এটি এমন ছিল যেন তিনি একটি টাচপ্যাড ব্যবহার করছেন। একটি স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি।

চীন শুধুমাত্র ইনভেসিভ ইমপ্লান্টে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তারা মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের সংযোগ পুনঃস্থাপনে ‘নিউরাল বাইপাস’ নামে এক প্রকার প্রযুক্তিও ব্যবহার করছে। ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত এক পৃথক গবেষণায় চারজন স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত রোগীর শরীরে বিশেষ ইলেকট্রোড প্রতিস্থাপন করা হয়, ফলে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তারা আংশিক অঙ্গচালনা ফিরে পান। এটি চিকিৎসাশাস্ত্রে এক বৃহৎ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এই উদ্ভাবনের পেছনে রয়েছে চীনা সরকারের সুসংগঠিত নীতিগত সহায়তা। ন্যাশনাল মেডিকেল প্রোডাক্টস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিসিআই প্রযুক্তির উন্নয়নে একটি নিয়ন্ত্রিত কাঠামো তৈরি করেছে, যার মধ্যে নমনীয় ও বায়ো-কম্প্যাটিবল ইলেকট্রোড তৈরির নির্দেশনা রয়েছে। সাংহাই সরকার ২০২৫–২০৩০ সাল পর্যন্ত একটি ভবিষ্যতমুখী অ্যাকশন প্ল্যান চালু করেছে, যা বিসিআই শিল্পকে পূর্ণাঙ্গ বিকাশে সহায়তা করবে। হুবেই প্রদেশ বিসিআই চিকিৎসাসেবার প্রথম মূল্যনির্ধারণ মডেল প্রণয়ন করেছে, যা জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার আওতায় প্রযুক্তিটিকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষণ।

গবেষণা ও বিনিয়োগের গতিও সমান তালে এগোচ্ছে। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে চীন ইতোমধ্যে ১৮টির বেশি ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু করেছে, যা আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশি। Jieti Medical ও BrainCo-এর মতো সংস্থাগুলো কোটি কোটি ইউয়ান বিনিয়োগ পেয়েছে। একইসাথে, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত বিসিআই ব্যবস্থা তৈরি করছে। যার মধ্যে রয়েছে চিন্তা থেকে চীনা ভাষা ডিকোডিং প্রযুক্তি এবং ল্যাবে তৈরি অর্গানয়েড মস্তিষ্ক, যা রোবটিক সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউরালিংকের সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, চীন একটি পৃথক কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। যেখানে নিউরালিংক ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় রয়েছে, চীন এখনই ক্লিনিকাল ফলাফলকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। চীনের এই সাফল্যের মূলে রয়েছে গবেষণা, শিল্প ও সরকারের সমন্বিত সহযোগিতা।

তবে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে। দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা, বায়ো-ইন্টিগ্রেশন এবং নিউরোডেটা নিরাপত্তা নিয়ে যেমন উদ্বেগ রয়েছে, তেমনি নৈতিকতা ও গোপনীয়তা নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠছে। চিন্তা থেকে কথা ডিকোডিং বা স্মৃতিচর্চা উন্নয়নের মতো বিষয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও মানবাধিকারের বিষয়গুলো সামনে আসছে। যদিও এসব প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ, তবুও এগুলো চীনের অগ্রগতিকে থামাতে পারেনি। বরং সরকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করছে।

২০২৬ সালের মধ্যেই চীন আরও অনেক রোগীর শরীরে ইমপ্লান্ট পরিচালনার পরিকল্পনা করছে এবং কিছু বিসিআই যন্ত্র সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থায় আনার প্রস্তুতিও নিচ্ছে। গবেষণালব্ধ সাফল্য, উৎপাদন সক্ষমতা ও সরকারি সহায়তার সম্মিলনে চীন এখন এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছে, যেখান থেকে মস্তিষ্ক–কম্পিউটার সংযোগ প্রযুক্তিকে বাস্তব জীবনের অংশে পরিণত করা সম্ভব। এই গতি বজায় থাকলে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই চীন এই প্রযুক্তির প্রথম বাণিজ্যিক ব্যবহারকারী রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে। এটি কেবল পক্ষাঘাত বা রোগ নিরাময়ের জন্য নয়, বরং মানব মস্তিষ্ক ও যন্ত্রের সীমাহীন সংযোগের এক নতুন যুগের সূচনা করবে।

শহীদ

×