
মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য করে বের হলাম।’ হাজারো মানুষকে কাঁদানো এমনই এক চিঠি লিখে জুলাই বিপ্লবে অংশ নিয়েছিল দশম শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার খান আনাস। মিছিলে গিয়ে ঘাতকের গুলিতে দিয়েছিল প্রাণ।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কয়েক ঘণ্টা আগে ঢাকা মহানগরীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে মারা যায় আনাস। একটি বুলেট তার বুকের বাঁ-পাশ দিয়ে ঢুকে পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে যায়।
আনাস সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে পড়ার টেবিলের ওপর মা-বাবাকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি লিখে বেরিয়ে যায়। ৫ আগস্ট আনাসের মা সকালের নাশতা আনতে ছোট ছেলেকে পাঠান তাকে ডাকতে। সে এসে বলে, ভাইয়া ঘরে নেই। আনাসের মা সানজিদা খান দীপ্তি তৎক্ষণাৎ ছুটে যান আনাসের রুমে। ঘর খালি, হঠাৎ চোখে পড়ে আনাসের পড়ার টেবিলে থাকা একটি চিঠি।
চিঠিতে আনাস লিখেছিল– ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য করে বের হলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। আমাদের ভাইরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে নেমে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। অকাতরে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। একটি প্রতিবন্ধী কিশোর, ৭ বছরের বাচ্চা, ল্যাংড়া মানুষ যদি সংগ্রামে নামতে পারে, তাহলে আমি কেন বসে থাকব ঘরে। একদিন তো মরতে হবেই। তাই মৃত্যুর ভয় করে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয় সে-ই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো। জীবনের প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই। আনাস।’
গত বছরে এক ভার্চুয়াল আলোচনায় সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আনাসের মা বলেন, ‘আনাস বেশ কিছুদিন যাবৎ মিছিলে যাওয়ার অনুমতি চাচ্ছিল। কিন্তু ওর বাবা আর আমি আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলে ওকে বিরত রাখছিলাম। কিন্তু সেদিন সে কিছু না বলেই আন্দোলনে গেল। সেদিন আনাসের বাবার অফ ডে থাকায় তিনি বেলা ১১টা নাগাদ ঘুম থকে ওঠেন। আনাস মিছিলে গিয়েছে শোনে তিনি রাগ করেননি।’
আনাসের মা বলেন, ‘বেলা বাড়ার সাথে সাথে আমার দুশ্চিন্তা বাড়ছিল। আমি দোয়া করছিলাম। বেলা ২টা নাগাদ আমার ফোনে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। অপর প্রান্তে থাকা ভদ্রলোক জানতে চান, ‘আপনাদের বাসার কেউ কি মিছিলে গিয়েছে?’ আমি ‘হ্যাঁ’ বলতেই তিনি আমাকে মিটফোর্ড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসতে বললেন। আমি তাড়াতাড়ি আনাসের বাবাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে, আমার দুটি শিশুপুত্রকে মায়ের বাসায় রেখে দ্রুত হাসপাতালে গেলাম। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কাছাকাছি গিয়ে সেই অপরিচিত নাম্বারে ফোন দিলাম। কয়েকজন যুবক হাত নেড়ে তাদের অবস্থান জানাল।’
এই পর্যায়ে আনাসের মা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। তিনি পাশে বসা আনাসের বাবাকে কথা বলতে অনুরোধ করলেন।
এসময় আনাসের বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পলাশ বলেন, ‘আমরা সবাই জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখি টেবিলে আহত একজনের চিকিৎসা চলছে। ভাবলাম এই তো আমার আনাস। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তখন একজন বললেন, এটা আপনার বাচ্চা না। ওকে ভেতরে রাখা হয়েছে। আমি জানতে চাইলাম, ভেতরে কোথায়? তিনি বললেন, কেঁচি গেটের ভেতরে। কথাটা শুনেই চমকে উঠলাম, কারণ আমি জানতাম, কেঁচি গেটের ভেতরে মরদেহ রাখা হয়। ওরা কেঁচি গেট খুলে দিলে আমি ভেতরে ঢুকেই আনাসের বুকে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করলাম হার্টবিট চলে কি না। না, চলে না। পালস চেক করলাম, সেটাও বন্ধ। এর মধ্যেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসে বলল, ‘বের হোন, তাড়াতাড়ি বের হোন।’ কেউ একজন অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করতে বললেন।
আনাসের বাবা বলেন, ‘আমি রাস্তায় এসে কিছুই পাচ্ছিলাম না। একসময় একজন রিকশাচালক রাজি হলে সেই রিকশায় করে ওকে নিজ এলাকা গেন্ডারিয়ায় নিয়ে আসলাম। এলাকার বহু মানুষ জড়ো হলেন। তারা আফসোস করে বলছিলেন, ‘এই ছেলে তো কোনো দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক কাপ চা পর্যন্ত খায়নি। ও কীভাবে আন্দোলনে গেল!’
তিনি বলেন, ‘এলাকার লোকজন আনাসের লাশ নিয়ে মিছিল করল। তারপর অপর একজন শহীদের সঙ্গে একত্রে জানাজার নামাজ শেষে ওকে জুরাইন গোরস্তানে আমার মায়ের কবরে দাফন করলাম।’
আনাসের বাবা জানান, অনেক চেষ্টা তদবির করার পর শেষ পর্যন্ত ৫ সেপ্টেম্বরের শহীদি মার্চে আনাসের ডেথ সার্টিফিকেট ও অন্যান্য ডকুমেন্ট সমন্বয়কদের হাতে দেওয়া হয়। অনেক চেষ্টার পর তাদের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলেও কাগজপত্র দিতে পারেনি পরিবারটি।
মিমিয়া