ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

মুসলিমদের যেসব ভুলের কারণে গড়ে উঠেছে ইহুদি রাষ্ট্র ‘ইসরায়েল ’

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:১৮, ৫ জুলাই ২০২৫

মুসলিমদের যেসব ভুলের কারণে গড়ে উঠেছে ইহুদি রাষ্ট্র ‘ইসরায়েল ’

ছবি: সংগৃহীত

“ইহুদি রাষ্ট্র” — এই দুটি শব্দ শুধু একটি ভূখণ্ডের নাম নয়, বরং মুসলিম বিশ্বের শত বছরের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও ঐক্যহীনতার একটি জীবন্ত চিত্র। ১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তখন গোটা মুসলিম জগতে যেন শোকের ছায়া নেমে আসে। প্যালেস্টাইন নামক একটি মুসলিম-অধ্যুষিত ভূমি কীভাবে ইহুদি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হলো — এ প্রশ্নের জবাবে ইতিহাস আমাদের দেখায় একের পর এক ভুল, ভ্রান্তি এবং ব্যর্থ নেতৃত্বের করুণ চিত্র।


■ ১. খেলাফতের পতনে মুসলিম বিশ্বের নীরবতা

১৯২৪ সালে ওসমানীয় খেলাফতের পতনের মধ্য দিয়ে মুসলিম বিশ্বের সর্বশেষ রাজনৈতিক ঐক্য ভেঙে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ব্রিটিশরা আরব অঞ্চলগুলো নিজেদের দখলে নেয়, তখন প্যালেস্টাইনও হয়ে ওঠে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা। এই সুযোগে ব্রিটিশরা শুরু করে এক গভীর ষড়যন্ত্র — যার প্রথম ধাপ ছিল "ব্যালফোর ঘোষণা"।


■ ২. বিশ্বাসঘাতকতায় আরব নেতৃত্ব

অপেক্ষাকৃত স্বাধীনতার আশায় কিছু আরব নেতা ও গোত্রপতি ওসমানীয়দের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের সঙ্গে মিত্রতা করে। ১৯১৬ সালের আরব বিদ্রোহ ছিল মুসলিম ঐক্যের বিরুদ্ধে এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। যার ফলাফল আসে ১৯১৭ সালের ব্যালফোর ঘোষণাতে — যেখানে বলা হয়, প্যালেস্টাইনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য ব্রিটিশ সরকার সহায়তা করবে।

 

■ ৩. ব্যর্থ কূটনীতি ও নেতার অভাব

ব্যালফোর ঘোষণার বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের কোনও সুসংগঠিত প্রতিবাদ হয়নি। মুসলিম বিশ্ব তখন কলোনিয়াল শাসনের নিচে ধুঁকছিল। ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে ইউরোপীয় ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে বসতি গড়তে দেয়। মুসলিম নেতারা তৎপর হয়নি, তারা ভাবেনি জনসংখ্যাগত পরিবর্তন কতটা মারাত্মক হতে পারে।


■ ৪. মুসলিম দেশগুলোর যুদ্ধ-পরিকল্পনায় বিভ্রান্তি

১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করে, তখন পাঁচটি আরব দেশ (মিশর, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন ও ইরাক) যুদ্ধ করে। কিন্তু তাদের ছিল না সমন্বিত নেতৃত্ব, একক সামরিক পরিকল্পনা কিংবা আধুনিক অস্ত্র। ইসরায়েল, বিপরীতে, পশ্চিমাদের সমর্থনে সুসংগঠিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।


■ ৫. জাতিসংঘে মুসলিম বিশ্বের ভঙ্গুর অবস্থান

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনকে দুই ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয় — একটি ইহুদিদের জন্য, একটি আরবদের জন্য। ইহুদিরা প্রস্তাবে রাজি হয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়; আর মুসলিম দেশগুলো শুধু প্রতিবাদ করে থেমে থাকে। এখানে স্পষ্ট হয়: রাজনীতি আবেগে নয়, কৌশলে চলে।


■ ৬. একের পর এক সামরিক ও কূটনৈতিক পরাজয়

১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল একাই মিশর, জর্ডান ও সিরিয়াকে হারিয়ে দেয় এবং দখল করে পূর্ব জেরুজালেম, গাজা, পশ্চিম তীর ও গোলান হাইটস। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে মুসলিম দেশগুলো কিছু অগ্রগতি করলেও, রাজনৈতিকভাবে তারা ইসরায়েলকে চাপে ফেলতে ব্যর্থ হয়।


■ ৭. উম্মাহর ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি

প্যালেস্টাইন সংকটকে অনেক মুসলিম জনগোষ্ঠী ‘মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা’ হিসেবে দেখে। মুসলিম দেশগুলো নিজেদের স্বার্থ নিয়ে এত ব্যস্ত যে উম্মাহভিত্তিক রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে পারেনি। এমনকি জাতিসংঘেও মুসলিম দেশগুলোর পক্ষে কোনো দীর্ঘস্থায়ী কৌশল নেই।


■ ৮. প্রযুক্তি ও জ্ঞানে পশ্চাদপদ মুসলিম বিশ্ব

ইহুদিরা ইউরোপীয় প্রযুক্তি, সামরিক শিক্ষা ও আধুনিক বিজ্ঞানকে নিজেদের অস্ত্র বানিয়েছে। মুসলিম বিশ্বের বড় অংশ তখনও চরমপন্থা, অশিক্ষা ও রাজতান্ত্রিক জড়তায় আবদ্ধ। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ আজ বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সংস্থা, যেখানে মুসলিম দেশগুলোর গোয়েন্দা কাঠামো দুর্বল ও রাজনৈতিক প্রভাবাধীন।

 

ইসরায়েল শুধু একটি রাষ্ট্র নয় — এটি একটি বার্তা। সেই বার্তা হলো: "যদি তুমি ঐক্যবদ্ধ না হও, পরিকল্পনাহীন থাকো, নেতৃত্বে সংকট থাকে — তবে শত্রু তোমার বুকের ওপর রাষ্ট্র গড়বেই।" ইসরায়েল গঠনে ইহুদি পরিকল্পনার পাশাপাশি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মুসলিমদের ভ্রান্তি, আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত, এবং নেতৃত্বহীনতা।

আজও যদি মুসলিম বিশ্ব শিক্ষা না নেয়, উম্মাহর স্বার্থকে প্রাধান্য না দেয় — তবে ইতিহাস আবারও নিজেকে পুনরাবৃত্ত করতে পারে। প্যালেস্টাইন হারিয়ে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে যেন আর কিছু না হারায় — এটাই হোক শিক্ষা।

Mily

×