
.
অষ্টম শতকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর তীরে দেয়াঙ পাহাড়ের সবুজ অরণ্যে পণ্ডিত বিহার নামে একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কালের বির্বতনে তা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ধ্বংস হয়ে যায়। কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন পণ্ডিত বিহারটি ঐতিহাসিক প্রত্ননির্দশন। তাই সেটি খুঁজে বের করতে ২০২৩ সালে সরকারিভাবে খননকার্য আরম্ভ হলেও মাঝপথে তা থেমে গেছে। পণ্ডিত বিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর। যে সময় পণ্ডিত বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় একই সময় নালন্দা বিশ^বিদ্যালয়ও গড়ে উঠেছিল।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ে প্রাচীন এ বিহারটি খনন কাজ তিন বছর আগে শুরু হলেও এখন বরাদ্দের কারণে থেমে আছে কাজ। পুনঃখনন শুরু হলে উঠে আসবে বিশে^র অন্যতম পুরার্কীতি, যা অবাক হয়ে দেখবে বিশ^। পণ্ডিতরাই পণ্ডিত বিহারের পাঠদানে ছিলেন বলে জানিয়েছেন ইতিহাস গবেষকেরা। অধিকাংশ বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ ও চর্যাগীতের রচয়িতা ছিলেন সেসব পন্ডিত। মূলত এ কারণেই বিহারটি পণ্ডিত বিহার নামেই পরিচিত।
জানা গেছে, পুরানো এ বিশ^বিদ্যালয়টি খোঁজ যখন ১৯২৭ সালে মেলে তখন সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় ৬০টি বুদ্ধমূর্তি। মূর্তিগুলো বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়াম, কলকাতা মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে। আর কিছু চট্টগ্রামের নন্দনকানন বৌদ্ধ মন্দিরেও রয়েছে। শতাব্দীর প্রাচীন পণ্ডিত বিহারটিকে আন্তর্জাতিক বিশ^বিদ্যালয় করারও দাবি রয়েছে চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকদের। একই সঙ্গে বিহারটির খননকার্যও পুনরায় শুরু করার অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার নিকট তারা।
উপমহাদেশের প্রতিষ্ঠালব্ধ জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র ছিল পণ্ডিত বিহার। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়- কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ও জুলধা এলাকায় ৮ম শতাব্দীতে এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। মূলত পাল সাম্রাজের অনেক প্রাজ্ঞ বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ অনেক ইতিহাসবিদ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী ছিলেন। বিলুপ্ত হওয়া ঐতিহাসিক পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল বেশ আগে। ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিনিধি দল সরেজমিনে দেয়াঙ পাহাড় অঞ্চলে পণ্ডিত বিহারের ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করে। তবে মাঝপথে আইনি, প্রশাসনিক ও মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন জটিলতায় তা সাময়িক থমকে আছে। চীন, জাপান, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার যৌথ অর্থায়নে প্রায় ১৫০ একর পাহাড়ি ভূমিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বিভিন্ন সমস্যার কারণে শুরু করা যায়নি এর পুনরায় খনন কাজ। দীর্ঘদিন যাবৎ পণ্ডিত বিহার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সমস্ত বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্লান্তিহীন দৌড়ঝাঁপ করছেন চট্টগ্রাম বৌদ্ধবিহারের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. জিনবোধি মহাস্থবির। তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক খননের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব উপলব্ধি করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরকে এ বিষয়ে চিঠিও দিয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন নাগরিক উদ্যোগের সদস্য সচিব মোস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে জানান, প্রফেসর ড. জিনবোধির একক প্রচেষ্টাকে নাগরিক নিবেদনে পরিণত করার লক্ষ্যে তাকে সভাপতি করে একটি কমিটি করা হয়। ফলে পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় একটি নাগরিক দাবিতে পরিণত হয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, পর্যালোচনা এবং বিশ্ব জার্নালেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা রয়েছে। অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে আনোয়ারা উপজেলাজুড়ে এটির অস্তিত্ব ছিল। এটি বৌদ্ধবিহার হলেও এখানে ১৮টি বিভাগ ছিল। জ্ঞানচর্চার জন্য আদর্শ কেন্দ্র ছিল এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। বিশে^র জ্ঞানী ও পণ্ডিতরা এ বৌদ্ধবিহারে পড়ালেখা ও জ্ঞানচর্চায় ছিলেন বহু বছর। ১৮টি বিষয়ে পাঠদানের কারণে বিশ্বজুড়ে এ পণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয়টির খ্যাতি ছিল। ইতিহাস থেকে জেনেছি এ পণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পণ্ডিতরা পাঠদানে ছিলেন। যার অধিকাংশই বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ ও চর্যাগীতের রচয়িতা। মূলত এ কারণেই বিহারটি পণ্ডিত বিহার নামেই পরিচিত। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রথমে ১৯৯১ সালেও পুনঃনির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত আলোচনা হয়েছিল। এরপর আবার থেমে যায়। ২০১৬ সালেও প্রথমে এটি খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০২৩ সালে খননকার্য শুরু হলেও আবারও থেমে যায়। পণ্ডিত বিহার খননকার্য পুনরায় শুরু এবং আন্তর্জাতিক পণ্ডিত বিহার বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
পণ্ডিত বিহার বিলুপ্তি হবার কারণ সম্পর্কে ইতিহাস সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন পুস্তক ও দেশি-বিদেশি জার্নালের বরাতে জানিয়েছেন, আরাকানীদের সঙ্গে মোগলদের বিভিন্ন সময় যুদ্ধের কারণে বন্দর শহর দেয়াঙ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলেই এটি ধ্বংস হয়ে বিলুপ্ত ঘটে। যদি এটি পুনরায় খনন শুরু হয় তাহলে বিশাল এক ইতিহাস কথা বলবে বিশে^। পণ্ডিত বিহার স্বরূপে পূর্ণাঙ্গতা পেলে বাংলাদেশকে আরও ব্যাপকভাবে পরিচিত করাবে। দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হবে।