ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

চর্চার সংকটে বিলুপ্তির পথে দেশের বাউলশিল্প

রাজু আহমেদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ২০:০১, ৬ জুলাই ২০২৫

চর্চার সংকটে বিলুপ্তির পথে দেশের বাউলশিল্প

বাংলাদেশের শহর-শহরতলী এবং গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত ৮০ ভাগ মানুষই প্রকৃতির অপরূপ রূপবৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে গুরুভাবপূর্ণ বাউল সংগীত ও সংস্কৃতিকে হৃদয়ে লালন করে আসছে বহুকাল ধরে।

জারি-সারি, পল্লীগীতি, কবিগান ও বাউল গান মিশে আছে গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে, মাটি ও মানুষের হৃদয়ে। এই হৃদয় থেকে উঠে আসা মাটির সুরই বাংলা সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে সম্মানের উচ্চ শিখরে স্থান দিয়েছে।

কিন্তু চর্চার সংকটে দেশীয় নিজস্ব সংস্কৃতির বহু পুরনো অংশ ও ঐতিহ্যবাহী বাউলশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।

পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে রাজধানীর মিরপুরস্থ হযরত শাহ্ আলী বাগদাদী (রঃ) মাজার শরীফ কেন্দ্রীক বসবাসকারী সহস্রাধিক ছিন্নমূল বাউল ও যন্ত্রসংগীতশিল্পী অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানটির গৌরব আজ ফিকে হয়ে আসছে।

সূত্র জানায়, মহান তাপসপ্রবর সুলতানুল আউলিয়া হযরত শাহ্ আলী বাগদাদী (রঃ) সুদূর ইরাক থেকে এদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসে রাজধানীর মিরপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কালের বিবর্তনে তার নামেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিশাল এই মাজার কমপ্লেক্স।

দেশ-বিদেশের লাখো ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রতিনিয়ত মাজার জিয়ারতে এসে মুগ্ধ হতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার পীর-মাশায়েখগণ ভক্ত-শিষ্যসহ সমবেত হয়ে তরিকতের শিক্ষা গ্রহণ করতেন। দেশজুড়ে আগত হাজারো জেয়ারতকারীর কাফেলায় আবাল-বৃদ্ধ-নারী-শিশু মিলে বর্ণিল মোমবাতি জ্বালিয়ে জিকির-মিলাদ ও ভক্তিমূলক গানবাজনায় মশগুল হয়ে রাতযাপন করতেন। সেই সময় মাজার প্রাঙ্গণ মুখরিত হতো বাউল সুরের মূর্ছনায়।

“সেই বৃহস্পতিবারের আসরে বাউল গানের ভাবগম্ভীর্য ও সুরে মুগ্ধ হয়ে দর্শনার্থীরা অর্থ-সহায়তা দিতেন। সেই অর্থেই এক সপ্তাহের খাবার জুটত ছিন্নমূল বাউলদের,” বলেন প্রবীণ বাউলশিল্পী আব্দুল মালেক সরকার।

বাউলশিল্পী লতিফ সরকার জানান, দেশের শীর্ষ বাউলরা এখনো মিরপুর ভিত্তিক কার্যালয়ে অবস্থান করেন। ফলে বিভিন্ন জেলা থেকে নতুন শিল্পীরা শিষ্যত্ব নিতে আসেন। কিন্তু চর্চার পরিবেশ না থাকায় তারা আজ ছিন্নমূল শিল্পী হিসেবে দিন পার করছেন।

জাতীয় যন্ত্রসংগীত শিল্পী সমিতির সভাপতি মনির হোসেন বলেন, “হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম, লালন ফকিরের মতো কিংবদন্তিরা সৃষ্টি করেছেন যে বাউলসুর, তা আজও বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। অথচ চর্চার অভাবে সেই বাউলশিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে।”

বাংলাদেশ জাতীয় বাউল সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল সরকার অভিযোগ করে বলেন, প্রযুক্তিনির্ভর অপসংস্কৃতির চাপে বাউলগান ও লোকজ ধারার গান আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। অনেক শিল্পী বাঁধা-বিপত্তির মুখে পড়ে গান ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

বিশিষ্ট বাউলশিল্পী শাহিন সরকার বলেন, “বাউলশিল্প রক্ষায় প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও মাজার প্রাঙ্গণে চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করা। না হলে এই শিল্প আমাদের সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে।”

মাজার কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক মোর্শেদ আলম জানান, “উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মাজার প্রাঙ্গণে বাউলগান চর্চা আপাতত বন্ধ আছে। অনুমতি পেলে আবারও সাপ্তাহিক আয়োজন করা সম্ভব হবে।”

মিমিয়া

×