
ছবি: জনকণ্ঠ
শেরপুরের নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার গারো পাহাড়ে বসবাস করছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গারো সম্প্রদায়, যাদের বর্তমানে প্রায় ১২০,০০০–১৫০,০০০ জন সদস্য রয়েছে। তারা প্রধানত রাজবংশীয় ভিত্তিক ‘সাংমা, মারাক, মোমিন, শিরা ও আরেং’ পাঁচটি প্রধান গোত্রে বিভক্ত।
গারো সমাজ নৃতাত্ত্বিকভাবে মাতৃসুত্রীয় বৈবাহিক ব্যবস্থা, সম্পত্তি উত্তরাধিকার ও পারিবারিক নাম সকলই মায়ের লাইন অনুসারে চলে। পরিবারে বসবাস ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের আধিপত্য রয়েছে, যা গ্রামের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গতিশীলতাকে প্রভাবিত করে। গারো সমাজে ‘নকনা’ নামে সর্বকনিষ্ঠ কন্যা সম্পত্তির অধিকারী হয়। পুরুষেরা ‘নকপান্তে’ নামে অবিবাহিতদের বাসস্থানে থাকে, যেখানে তারা সমাজ, সংস্কৃতি ও কারিগরি দক্ষতা শেখে।
গারোদের নিজস্ব ভাষা আচিক্, যা টিবেটো‑বর্মান‑কোষে অন্তর্গত, বর্তমানে বাংলা বর্ণমালায় রূপান্তর হচ্ছে। ধর্মের দিক থেকে, খ্রিস্টান দীক্ষার প্রভাবে বর্তমানে প্রায় ৫৬% গারো খ্রিস্টান, বাকিরা অবশিষ্ট Songsarek পালন করে। তবে গানার ও সংস্কৃতিপূজাত ভিন্ন ভিন্ন পরম্পরাগুলো এখনো টিকে আছে।
গারো খাবারের প্রধান উপাদানে চাল, পাটানচি, সরিষা, ডাল ও শুকনো মাছ থাকে। স্থানীয়ভাবে ‘চু’ ও ‘মিনিল বিচি’ নামে নিজস্বভাবে তৈরি মদ প্রথাগত উৎসবে ব্যবহৃত হয়। শিল্পশৈল্পিকভাবে তারা তৈরি করেন হস্তশিল্প ও বস্ত্র, বিশেষ করে ‘ডাকমান্ডা’ ও ‘ডাকষারী’ পোশাক, কিন্তু বর্তমানে এসব তৈরির শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। জাতিগত সাধিপাঠে সম্মুখীন হয়, পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ গড়ে উঠছে।
গারো পাহাড়ে যেমন বনভূমি সংকুচিত হচ্ছে, তেমনই রয়েছে অবৈধ দখল ও মানব-হাতি সংঘাতের ভয়াবহতা। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাতির আগ্রাসনে প্রায় ৩৫ জন নিহত, ৩০টি হাতি মারা গেছে, আর পৃথকভাবে বনসংরক্ষণ কার্যকরী হচ্ছে না। বন দখল ও জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশ ও খেটে খাওয়া জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে।
গারোদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলো Wangala, যা ফসল উৎসব ‘রি-মি’, স্বর্গ–সালজংকে উৎসর্গ করে পালিত হয়। ‘শত ডম’ বর্ণাঢ্য কল্যাণ-অনুষ্ঠানে তরুণরা ঢাকি নৃত্য করে এবং নারীরা চিত্রাঙ্কিত পোশাক ও গহনায় নিজেদের সাজায়। উৎসবে ধর্ম, সংগীত ও ঐতিহ্য একত্রে মিশে যায়।
শিক্ষায় গারো সম্প্রদায় অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে, শিক্ষিতা নারীদের সংখ্যা বাড়ছে, যা সমগ্র বাংলাদেশের নারীশক্তির জন্য উদাহরণস্বরূপ। তবে বন ও ভূমি অধিকার, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সব ক্ষেত্রেই এখনো বড় সমস্যা বিদ্যমান। খাবারের নিরাপত্তা, প্রাকৃতিক পানির অভাব, স্বাস্থ্যসেবা ও কাজের সুযোগ সীমিত।
শেরপুরের গারো জনগোষ্ঠী তাৎপর্যপূর্ণ এক সমাজ মাতৃতান্ত্রিক কাঠামো, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক। তবে পরিবেশ, আধুনিকীকরণ ও সামাজিক চাপের কারণে তাদের ঐতিহ্য ও জীবনবোধ এখন সংকটে। সরকার, পরিবেশবাদী, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের কর্মীদের একত্রে উদ্যোগ নিয়ে গারো আদিবাসীদের অধিকার, বন ও পাহাড় সংরক্ষণ ও সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
শহীদ