ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৭ জুলাই ২০২৫, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২

‘ভালো ঘরের মেয়ে’ মানে কী?— শান্ত, চুপচাপ আর প্রশ্ন না করা মানুষ?

প্রকাশিত: ১১:২০, ৭ জুলাই ২০২৫

‘ভালো ঘরের মেয়ে’ মানে কী?— শান্ত, চুপচাপ আর প্রশ্ন না করা মানুষ?

ছ‌বি: প্রতীকী

‘ভালো ঘরের মেয়ে’— এই কথাটি আমাদের সমাজে বহুবার বহুভাবে উচ্চারিত হয়েছে। এটি একটি প্রচলিত বাক্য, যা শুনলে অনেকের মনে একধরনের সম্মানের ভাব জাগে, আবার অনেকের জন্য এটি হয়ে ওঠে সীমাবদ্ধতার আরেক নাম। মূলত, এই শব্দবন্ধটির মাধ্যমে সমাজ একটি নির্দিষ্ট ধরনের নারী চরিত্র নির্মাণ করে, যাকে অনুসরণ করাটাই নাকি নারী-জীবনের 'সফলতা'। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ‘ভালো ঘরের মেয়ে’ বলতে আমরা আসলে কী বুঝি?

বহু পরিবারের ধারনা অনুযায়ী, ‘ভালো ঘরের মেয়ে’ মানে একজন শান্ত, নম্র, চুপচাপ, বিনয়ী এবং ‘বুদ্ধিমতী’— অর্থাৎ, যে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন না তোলে। সে পরিবারের মান-মর্যাদা রক্ষা করে, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গোপন করে পরিবারের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়, স্বামীর পছন্দ-অপছন্দের বাইরে কিছু ভাবার সাহস রাখে না এবং সবকিছুর উপর মাথা পেতে নেয়। তাকে হতে হয় উচ্চশিক্ষিতা, তবে সেই শিক্ষার চর্চা যেন কখনো ‘উচ্চস্বরে’ না হয়। তার উচ্চাশা থাকতে পারে, কিন্তু সেই উচ্চাশা যেন সংসার নামক একটি কাঠামোর বাইরে গিয়ে না পড়ে।

এই ‘ভালো ঘরের মেয়ে’ যদি বেশি কথা বলে, যদি নিজের মতামত দেয়, যদি নিজের সীমারেখা টানে, তাহলে সমাজে সে হয়ে ওঠে ‘অপাত্রে গৃহীত’ এক চরিত্র। অথচ স্বাধীন মতামত পোষণ করা, প্রশ্ন তোলা, নিজের জন্য যুক্তির জায়গা তৈরি করা কোনোভাবেই অবাধ্যতা নয়, এটা সচেতনতা। কিন্তু সমাজ এই সচেতনতার নাম দেয় বেয়াদবি, নষ্টামী কিংবা ‘অভদ্রতা’।

একজন মেয়ে যখন প্রশ্ন করে, তখন সে হয়ে ওঠে অস্বস্তিকর। কারণ প্রশ্ন করা মানেই বিদ্যমান কাঠামোর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা। ‘তুমি কোথায় যাচ্ছো?’, ‘কখন ফিরবে?’, ‘কী পরেছো?’, ‘কাদের সঙ্গে ছিলে?’— এইসব প্রশ্নের জবাব মেয়েটিকে দিতে হয় প্রতিনিয়ত, অথচ সে যদি পাল্টা প্রশ্ন তোলে, যেমন— ‘তুমি কেন এই প্রশ্নগুলো করছো?’, ‘তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না কেন?’— তখনই তাকে ‘ঝগড়াটে’ কিংবা ‘অতিরিক্ত স্বাধীনচেতা’ বলা হয়।

‘ভালো ঘরের মেয়ে’ যেন এক ধরণের চুপচাপ অস্তিত্ব— যার কণ্ঠ আছে, তবে কণ্ঠস্বর নেই। সে বুঝে নেয়, বুঝিয়ে বলতে হয় না; সে সহ্য করে, প্রতিবাদ করে না; সে আত্মত্যাগে গর্বিত, কিন্তু নিজের প্রয়োজনের কথা বলতে গেলে লজ্জিত। এই কাঠামো আমাদের সমাজে এতটাই প্রোথিত যে, মা তার মেয়েকে শেখান— ‘তুমি মেয়ে, তোমার সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে।’ আর এই সহ্য করার ক্ষমতাকে বলা হয় ‘ভদ্রতা’, ‘নম্রতা’, কিংবা ‘ভালো মেয়ে’র অন্যতম গুণ।

তবে, এই কাঠামো শুধু মেয়েদের জন্য নয়, বরং ছেলেদের কাছেও এমন ‘ভালো ঘরের মেয়ে’ কাম্য হয়ে ওঠে। কারণ সমাজ ছেলেদের শেখায়— ভালো বউ মানে সে, যে কথা কম বলে, ঝগড়া করে না, চাকরি করলেও সংসার আগে দেখে, মা-বাবার মুখে কথা তুলে না, আর স্বামীর বন্ধুদের সামনে ‘সামনে আসতে’ জানে না। অথচ কোনো মানুষ যদি তার আত্মমর্যাদাবোধ, চিন্তা ও অনুভূতিকে অবদমন করে কেবল অন্যের জন্য চলতে থাকে, তাহলে সে কি আসলেই সুখী হতে পারে?

এখানে আসলে প্রশ্ন দাঁড়ায়— আমরা ‘ভালো ঘরের মেয়ে’ বলতে কি বোঝাতে চাই? একজন আত্মপরিচয়হীন, আত্মবিশ্বাসহীন, আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়া মানুষকে? নাকি এমন একজন মানুষকে, যে নিজের অধিকারের প্রতি সচেতন, কিন্তু সম্মানের সঙ্গেই তা দাবি করে? সমাজ যদি সত্যিকার অর্থে নারীর মর্যাদা দিতে চায়, তাহলে এই ‘ভালো ঘরের মেয়ে’ কথাটির অর্থ পুনরায় নির্ধারণ করা জরুরি।

ভালো ঘরের মেয়ে হতে হলে মেয়েটিকে অবশ্যই সাহসী হতে হবে— নিজের সীমা নির্ধারণ করতে জানতে হবে। তাকে চুপ করে থাকার শিক্ষা না দিয়ে যুক্তির পথে চলার শিক্ষা দিতে হবে। তাকে প্রশ্ন করতে শিখতে হবে, কারণ প্রশ্ন ছাড়া উন্নয়ন হয় না— ব্যক্তিগতভাবে নয়, সামষ্টিকভাবেও নয়। একজন নারী যখন নিজের জীবনের প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজেই খুঁজে নিতে শেখে, তখনই সে হয় আসল অর্থে ‘ভালো ঘরের’— একটি সাচ্চা মানবিক ঘরের, যেখানে মানুষ হওয়াটাই মুখ্য, লিঙ্গ নয়।

সমাজের উচিত ‘ভালো মেয়ে’ বা ‘ভালো ঘরের মেয়ে’ শব্দবন্ধের পেছনে থাকা নিয়ন্ত্রণমূলক ধারণাগুলোর ওপর আলো ফেলানো। এটি হোক এমন একটি ধারণা, যেখানে একজন নারী প্রশ্ন করতে পারে, মতামত দিতে পারে, নিজের জন্য ভাবতে পারে— তবুও সমাজের চোখে সম্মানজনক থাকে। শান্ত হওয়া খারাপ নয়, তবে সেটা যদি হয় ভয়ের কারণে, তাহলে তা একধরনের নিপীড়নের নামান্তর। চুপ থাকা খারাপ নয়, কিন্তু যদি তা হয় অভিমানের চাদরে আবৃত আত্মবিসর্জন, তাহলে সেটি নিঃসন্দেহে আত্মপ্রবঞ্চনা।

আমরা যদি সত্যিকার অর্থে নারীকে ভালোবাসি, সম্মান করি, তাহলে তাকে কেবল ‘ভালো ঘরের মেয়ে’ হবার বোঝা না দিয়ে, নিজের মতো করে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে। কারণ, একজন মানুষ তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন সে নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে— ভয় নয়, যুক্তি আর সাহসের সঙ্গে। এবং এই সাহসী, চিন্তাশীল, জিজ্ঞাসু মেয়েটিই আজকের দিনে ‘ভালো ঘরের মেয়ে’ হবার যোগ্য।

এম.কে.

আরো পড়ুন  

×