
ছবি: সংগৃহীত
গুগল ম্যাপ খুললে নীল সমুদ্রের বুক চিরে ছড়িয়ে থাকা কিছু বৃত্তাকার দ্বীপ চোখে পড়ে। উপর থেকে দেখে মনে হয় যেন কেউ সমুদ্রের মাঝে এক ছড়া মালা সাজিয়ে রেখেছে। এই বিস্ময়কর দ্বীপমালাগুলোর নাম অ্যাটল (Atoll)। এগুলো মূলত বৃত্তাকারে গঠিত প্রবাল প্রাচীর, যার ভেতরে থাকে শান্ত, স্বচ্ছ জলরাশি—যাকে বলে লেগুন।
প্রবালদ্বীপের দেশ মালদ্বীপ থেকেই ‘অ্যাট’ শব্দের উৎপত্তি। মালদ্বীপীয় ভাষায় একে বলা হয় ‘আতোলু’, যার অর্থ বৃত্তাকার দ্বীপমালা। কিন্তু এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পেছনে লুকিয়ে আছে লক্ষ বছরের ভূতাত্ত্বিক বিবর্তনের এক দীর্ঘ ইতিহাস।
সমুদ্রতলদেশে রয়েছে অসংখ্য সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। এসব আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে লাভা জমে জমে এক সময় পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে ওঠে। দীর্ঘ সময় ধরে উদগীরণের পর যখন এই আগ্নেয় শৃঙ্গ পানির উপর মাথা তোলে, তখন গড়ে ওঠে আগ্নেয় দ্বীপ।
এই উষ্ণ ও স্বচ্ছ পানির পরিবেশ প্রবালের জন্মের জন্য উপযুক্ত। ক্ষুদ্র প্রবালরা নিজেদের শক্ত চুনাপাথরের কঙ্কাল ব্যবহার করে দ্বীপের চারপাশে দেয়াল নির্মাণ করতে শুরু করে। এই দেয়াল ধীরে ধীরে গঠিত হয় ‘ফ্রিঞ্জিং রিফ’-এ, যা মূল দ্বীপকে ঘিরে রাখে।
সময়ের সাথে সাথে আগ্নেয় দ্বীপ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সমুদ্রের নিচে ডুবে যেতে থাকে—এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় সাবসাইডেন্স। তবে প্রবালের দেয়াল তখনো বাড়তেই থাকে। একপর্যায়ে দ্বীপটি পুরোপুরি ডুবে গেলেও প্রবালের তৈরি বৃত্তাকার প্রাচীর রয়ে যায়। আর মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটি রূপ নেয় শান্ত, নীল পানির লেগুনে। এই বিস্ময়কর গঠনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রথম দেন চার্লস ডারউইন।
যদিও অনেক বিজ্ঞানী এখন বলছেন, সব অ্যাটলই আগ্নেয় দ্বীপ থেকে তৈরি হয় না। কখনো কখনো সমুদ্রের পানি কমে গেলে প্রবালের স্তর উপরে উঠে আসে। সেখানে বৃষ্টির পানি জমে তৈরি হয় গর্ত। পরবর্তীতে আবার সমুদ্রপানি বাড়লে গঠিত হয় লেগুন ও চারপাশে নতুন প্রবাল প্রাচীর।
অ্যাটল শুধু প্রকৃতিরই সৃষ্টি নয়, এটি ইতিহাসেরও সাক্ষী। যেমন—বিকিনি অ্যাটল, যা মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত। ১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র এখানেই চালায় তাদের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা। দ্বীপবাসীদের সরিয়ে নিয়ে সেখানে একাধিক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সেই বিস্ফোরণের স্মৃতিতে ‘বিকিনি’ নামেই পরবর্তীতে পরিচিতি পায় আধুনিক সাঁতারের পোশাক।
বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪৪০টি অ্যাটল রয়েছে, যার বেশিরভাগই প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে। এর মধ্যে কিছু এখনো একেবারেই জনশূন্য, যেমন ভারত মহাসাগরের এলডাব্রা অ্যাটল। এখানেই বাস করে প্রায় এক লাখ স্থলকচ্ছপ, যা বিশ্বের বৃহত্তম কচ্ছপ উপনিবেশ। ইউনেস্কো ১৯৮২ সালে এলডাব্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
প্রবালের তৈরি এই বৃত্তাকার দ্বীপগুলো প্রমাণ করে ক্ষুদ্র প্রাণীরাও একত্রে কী অসাধারণ কিছু গড়ে তুলতে পারে। আবার এই অ্যাটলগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়—পৃথিবী যেমন ধৈর্য ধরে গড়ে উঠে, তেমনি সামান্য পরিবর্তনেই ভেঙে পড়তে পারে।
সূত্র: https://www.youtube.com/watch?v=HLXHZWOf1Tk
রাকিব