
ছবিঃ সংগৃহীত
কল্পনা করুন, আপনার পরিচিত কারো মুখ বসানো এমন একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে যেখানে সে অশ্লীল ভাষা বলছে বা আপত্তিকর কাজে লিপ্ত। ভিডিওটি এতটাই নিখুঁত যে অনেকেই সেটি আসল ভেবে নিন্দা করছে, শেয়ার করছে, বিচার করছে। বাস্তবে ভিডিওটি বানানো হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
এ ধরনের ভিডিওকেই বলা হয় ডিপফেক ভিডিও। এক সময় যা প্রযুক্তির ‘মজার খেলা’ হিসেবে দেখা হতো, তা এখন ব্যক্তিগত মানহানি, রাজনৈতিক অপপ্রচার এমনকি লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
ডিপফেক (Deepfake) মানে হচ্ছে “ডিপ লার্নিং” প্রযুক্তি দিয়ে ফেক ভিডিও বানানো। এআই অ্যালগরিদম ব্যবহার করে কারো মুখ, কণ্ঠ বা অভিব্যক্তি অন্য কোনো ভিডিওর ওপর বসিয়ে এমনভাবে সম্পাদনা করা যায় যে আসল-নকল পার্থক্য করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনকার কিছু ডিপফেক ভিডিও এতটাই নিখুঁত যে ভিডিও ফরেনসিক টুল ব্যবহার না করে এর জালিয়াতি প্রমাণ করা কঠিন।যুক্তরাষ্ট্রের একটি সমীক্ষা বলছে, বিশ্বের ৯০-৯৫% ডিপফেক ভিডিও অ-সম্মতিমূলক পর্নোগ্রাফি, যার প্রায় ৯০% নারীদের মুখ বসিয়ে বানানো হয়।
বাংলাদেশেও এই প্রবণতা এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখে পড়ছে। বিশেষ করে ফেসবুকে দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করতে বা ব্ল্যাকমেইল করতে তৈরি করা হয়েছে অবিকল বাস্তবের মতো ভিডিও।
কোনো ব্যক্তিকে মিথ্যা, আপত্তিকর বা অশ্লীল দৃশ্যে উপস্থাপন করে সম্মান ও সামাজিক অবস্থানকে ধ্বংস করা যায়। এরপর সেই ভিডিওকে ব্ল্যাকমেইলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।শিকার ব্যক্তি মানসিক ট্রমা, অবসাদ, আত্মহত্যার চিন্তায় পর্যন্ত ভুগতে পারে। পরিচিত ব্যক্তির ছদ্মবেশে জাল ভিডিও তৈরি করে প্রতারণা করে অর্থ আদায় করা হয়। যেমন সিইও বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ‘ডিপফেক নির্দেশ’ দিয়ে আর্থিক লেনদেন করানো।
রাজনৈতিক অঙ্গনে ডিপফেক এখন এক নতুন অস্ত্র।নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দ্বীর নামে উস্কানিমূলক বা অশ্লীল বক্তব্যের ভিডিও বানিয়ে ভোটারদের বিভ্রান্ত করা।সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়ানো।নেতাদের চরিত্রহনন করে জনমত প্রভাবিত করা বিশ্বজুড়ে এর নজির আছে। ২০২৪ সালের ভারতের নির্বাচনে কংগ্রেস ও বিজেপি উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে ডিপফেক ভিডিও ব্যবহার করে প্রচার চালানোর অভিযোগ ওঠে।
ডিপফেক ভিডিও দিয়ে ভুয়া খবর ছড়িয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্ভাবনা তৈরি হয়।শত্রু রাষ্ট্র কোনো সেনা কর্মকর্তা বা রাষ্ট্রনেতার ‘নকল নির্দেশ’ দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে।উগ্রবাদী বার্তা ছড়িয়ে সহিংসতা উসকে দিতে পারে।বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন — ভুয়া খবরের চেয়েও বিপজ্জনক ডিপফেক ভিডিও, কারণ মানুষ সহজে বিশ্বাস করে যা চোখে দেখে।
ডিপফেক ভিডিওর সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো নারীদের বিরুদ্ধে এর ব্যবহার।যৌন হয়রানি ও পর্নোগ্রাফি নারীর মুখ বসিয়ে অশ্লীল ভিডিও তৈরি করে অনলাইনে ছড়ানো হয়।এই ভিডিও দেখিয়ে টাকা, শারীরিক সম্পর্ক বা অন্য অনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা।নারী শিকারীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে — অবসাদ, আতঙ্ক, আত্মহত্যার প্রবণতা।কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের কাছে পৌঁছালে চাকরি হারানো বা পদোন্নতি আটকে যাওয়া।নারী রাজনীতিবিদদের সম্মানহানি করে তাদের প্রভাব খর্ব করা।সাইবার হয়রানির আশঙ্কায় নারীরা সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি সীমিত করে ফেলেন।ব্যক্তিগত তথ্য সহ ভিডিও ছড়ালে শারীরিক হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।
এ বিষয়ে সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞর বলছেন,ডিপফেক ভিডিও নতুন নয়, কিন্তু এখন সহজে বানানো যায়। যে কেউ ফ্রি এআই টুল ব্যবহার করে ভয়ংকর ভিডিও তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশে এখনই আইন ও প্রযুক্তি উভয় দিকেই প্রস্তুতি দরকার।”
ডিপফেক প্রযুক্তি একটি বাস্তবতা — একে ঠেকানো এক দিনে হবে না। তবে আইন, প্রযুক্তি এবং জনসচেতনতা — এই তিনটি স্তরেই লড়াই জারি রাখতে হবে।
বিশেষ করে নারীদের জন্য এটি একটি নতুন সহিংসতার হাতিয়ার। তাই নীতিনির্ধারক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পরিবার — সবাইকে এই বিষয়ে সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
কারণ শেষ পর্যন্ত — আমাদের চোখকে বিশ্বাস করেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই। আর সেই চোখকে যদি ভুল দেখানো হয়, তবে ক্ষতি শুধু একজনের নয় — পুরো সমাজের।
লেখক: সালাহউদ্দিন সালমান, মুন্সীগঞ্জ
নোভা