ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

লন্ডনের চিঠি

তীব্র তাপে আমরা প্রত্যেকে কাঁটা ভরা গাছ

সাগর রহমান

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ৫ জুলাই ২০২৫

তীব্র তাপে আমরা প্রত্যেকে কাঁটা ভরা গাছ

সাগর রহমান

লন্ডন ধুঁকছে। প্রচণ্ড রৌদ্রতাপে জনজীবনের নাভিশ্বাস দশা। সেই ভোরে, সাড়ে ৪টার সময় সূর্যটা আকাশে নিজের সগর্ব উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করে, তারপর মেঘহীন নীলের দিগন্ত প্রসারী খোলামাঠ পেয়ে স্বগর্ব মহিমায় জ্বলতে থাকে অন্তত ১৮ ঘণ্টা। অতঃপর সন্ধ্যায়, দিগন্ত রেখার নিচে সরে পড়ার সময় এলেও ওর মন যেন সরতে সায়-ই দেয় না। ঘোমটার আড়াল থেকেও ছড়াতে থাকে কেমন এক আবছা আলো। আর তার প্রভাবে মধ্যরাতেও একটি অদ্ভুত আলো-আলো জেগে থাকে চারদিকে।

সরে পড়া, তাও মাত্র ঘণ্টা চারেকের জন্য। ঘুম লেগে না আসতেই আবারও তার চোখ রাঙানো। সামারে সূর্যের রুটিনটি এখানে এরকম। তবে গরম লাগার রুটিনটি হঠাৎ হঠাৎ শুরু হয় বলেই যত সব বিপত্তি। গতকাল যেখানে দিব্যি জ্যাকেট-ব্লেজার পরে ঘর থেকে বেরুনো চলত না, আচমকা দেখা গেল, আজ গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি রাখতে ইচ্ছে হয় নাÑ গরমে গা জ্বলে যায় অবস্থা! রোদের কী রং! কমলা রঙের প্যালেটে বেশখানিকটা হলুদ রং মেশালে যে দাউদাউ রূপটা পাওয়া যেতে পারে, ঠিক সেরকম।

রীতিমতো রবীন্দ্রনাথের আর্তনাদ আকাশে আকাশে: ‘দারুণ অগ্নিবাণে রে/ হৃদয় তৃষায় হানে রে/ রজনী নিদ্রাহীন, দীর্ঘ দগ্ধদিন, আরাম নাহি যে জানে রে/ শুষ্ক কাননশাখে, ক্লান্ত কপোত ডাকে/ করুণ কাতর গানে রে।‘ ইউরোপের তাপদাহেও যে রবীন্দ্রনাথকে টানতে হচ্ছে, তার কারণ এখানকার কবিদের কবিতায় তাপপ্রবাহের উল্লেখ খুব একটা পাবেন না আপনি। বিশেষত ক্ল্যাসিক যুগের কবিদের কবিতায় সামারের কথা যা আছে, তাতে তাপপ্রবাহের রুদ্র কোনো মূর্তির দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব, অন্তত আমার চোখে পড়েছে বলে তো মনে পড়ছে না।

গ্রীষ্মের যে রুদ্রমূর্তির দুয়েকটা কথা উনারা বলেছেন, তার প্রায় পুরোটাই রোমান্টিক ভাবধারায় পূর্ণ। জন ডান তো রীতিমতো শাসিয়েছেন গ্রীষ্মকে: ‘ভাবিস, তোর রশ্মিগুলো কত শক্তিশালী আর তেজী? ফুঁহ। আমি তো ¯্রফে চোখের এক ইশারাতেই সেগুলো বিলকুল ঢেকে দিতে পারি। ‘বি. শেলীকে পড়–ন : ‘রৌদ্রের তলে সবকিছুই তো আনন্দের প্রতিচ্ছবি/ আগাছা, নদী, শস্যক্ষেত, আর কাশবনের ভাষা/ আহা! হালকা হাওয়ায় দুলছে বাঁশবন, আর দীর্ঘ বৃক্ষের পত্রপল্লবগুলো কেমন দৃঢ় আর স্থির...।

‘পড়–ন ডব্লিউ ইয়েটসকে: ‘...সেখানে আমি কিছু শান্তি পাব/ কেননা শান্তি নেমে আসে ধীরে, সকালের আবরণ ভেদ করে/ যেখানে ঝিঁঝিঁ পোকার গান শোনা যায়/ যেখানে মধ্যরাত ঝিকমিক করে আলোয়/ আর দুপুর জুড়ে বেগুনি আভা/ সন্ধ্যেটি ভরে থাকে লিনেট পাখির ¯িœগ্ধ আলোমাখা পাখার ছায়ায়...। ‘স্বীকার করি, এই লাইনগুলো অনুবাদ করতে গিয়ে আমি খানিকটা তাচ্ছিল্যের ভাষা বেছে নিয়েছি।

তবে বিশ্বাস করুন, তা আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাকৃত নয়। দোষ যদি কাউকে দিতে হয়, তবে দিতে হবে, গত কয়েকদিনের ওই পাগলাটে তাপপ্রবাহটিকে। শুরুতে বলেছিলাম না: ল-ন হাঁফাচ্ছে! আক্ষরিক অর্থেই হাঁফাতে হচ্ছে আমাদেরকে এখানে। গ্রীষ্মের সূর্যরশ্মি নিয়ে এদেশীয় কবিদের আদিখ্যেতা দেখলেও কেমন গা জ্বলে যাওয়ার মতো হচ্ছে দেখি এখন!
ভেবে দেখলাম, নেই কেন? মানে এদেশীয় কবিরা তাপপ্রবাহ নিয়ে তেমন কোনো লেখা লেখেননি কেন? বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না। কারণটা তো আসলে খুব সহজই। এ জিনিস তারা তো সচরাচর দেখেননি। উইকিপিডিয়া যুক্তরাজ্যের তাপদাহের যে ইতিহাস জানাচ্ছে, তার সবচেয়ে পুরানোটি বলছে ১৮০৮ সালে। তাপমাত্রা নাকি ৩৮ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠেছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পরবর্তী তাপপ্রবাহটির সাল দেখাচ্ছে ১৯০৬। মানে মাঝখানের একশ’ বছরে বলার মতো তেমন কোনো তাপমাত্রা দেখা যায়নি! কী জানি বাবা, আমার আর হিট নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে ইচ্ছে হলো না।

হিট শব্দটা যতবার চোখে পড়ছে, গরম যেন আরও বাড়ছে! মোদ্দা কথাটি হলো, যে জিনিস কবিরা সে অর্থে অভিজ্ঞতালব্ধ হতে পারেননি, সে জিনিস তাদের লেখায় খুব একটা প্রভাব বিস্তার করে থাকবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। তবে তুলনায় আধুনিক যুগের ইংরেজ কবিদের অনেক কবিতাতেই কিন্তু গরমের বিষয়টা আছে। এই যে ধরুন, কবি জন স্ট্যামারের কবিতা: ‘সে ছিল রেকর্ডে সবচেয়ে উষ্ণ গ্রীষ্ম/ একটি মাত্র শব্দেই ফুঁসে উঠতাম আমরা/ তীব্র তাপে আমরা প্রত্যেকে হয়ে উঠেছি একেকটা কাঁটা ভরা গাছ।‘

কিংবা পল বার্টলার না¤িœ জনৈক ইংরেজ কবির কয়েক লাইন: ‘এই ভেজা, দমবন্ধ করা রোদ অসহ্য/ চল্লিশ বছরের মধ্যে দীর্ঘতম তাপপ্রবাহ এখন/ সাহারার দমবন্ধ করা আঁচ চারদিকে/ ডেথ ভ্যালির ফাটল ভেদ করে শুকনো রুক্ষ্ম মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে নীরব চিতকার...।’
কথা যদিও বলছি শুধু লন্ডন, মানে যুক্তরাজ্যের, আসলে এই ক‘দিন ধরে তো পুরো ইউরোপই আসলে পুড়ছে। ইতালি, স্পেন, গ্রিস, ফ্রান্স- তাপপ্রবাহ সব জায়গাতেই। কোথাও কোথাও দাবদাহের কথা শোনা যাচ্ছে। কোথাও আশঙ্কার। আমাদের এলাকার সব পার্কের ঘাস রোদে জ্বলে গেছে। মাঝে মাঝে ভয় হয়, আগুন না লেগে যায় কোনোদিন! এই কদিন আগেও কেমন সবুজের সমারোহ ছিল চারদিকে। গাছগুলো ধুঁকছে। এদেশ যেহেতু শীতপ্রধান, শত শত বছর ধরে তাই এদের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-পরিকল্পনাÑ সব ছিল শীত ঠেকানোর উদ্দেশ্যে।

প্রতিটি ঘরেই সেন্ট্রাল হিটিংয়ের সিস্টেম। আগুন জ্বালানোর চিমনিগুলোও দিব্যি ঘরের চূড়ায় নিজেদের গৌরবময় অতীতের স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। যখন বিদ্যুৎ সরবরাহ এত সহজ হয়নি, তখনকার মানুষকে তো গরম রাখত ওই রোমান্টিক চিমনিগুলোÑ যেগুলোর ভিতর দিয়ে সান্তাক্লজ ঢুকে ক্রিসমাসের উপহার রেখে যেতেন বাচ্চাদের জন্য। কিন্তু ওই যে, আইয়ুব বাচ্চুর গানটি: ‘বদলে গেছে পৃথিবী, বদলে গিয়েছো তুমি, নেই বুঝি আমার প্রয়োজন, আর এখন...।’ সমস্যা হলো, দিন বদলাবে- সেটা এই দেশের বাড়ি তৈরির মিস্ত্রিরাও নিশ্চয়ই জানতেন।

তাই বলে এমন বছরব্যাপী তুষারপড়ার ইতিহাস বদলে এমন রাতারাতি তাপপ্রবাহের দেশে পরিণত হবে ইউরোপ, তা বোধহয় কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি। তাই বোধহয় এখানকার বেশির ভাগ বাড়িঘরেই গরম দিনের জন্য উপযোগী কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। একটা সিলিং ফ্যান ঝোলাবেন, তার উপযুক্ত ব্যবস্থাটিও অতি বিরল! বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাই টেবিল ফ্যানই ভরসা। 
তাতে যে তাপপ্রবাহের কোনো কিনারা হয় না, তা বোধহয় বাঙালি কাউকে বিতং করে বোঝাতে হবে! এয়ারকন্ডিশন বিক্রি-বাট্টার ইতিহাসও এদেশে প্রায় সাম্প্রতিক ঘটনাই এখানে, এই তো মাত্র এই শতকের শুরুর দিকে। বলাবাহুল্য, গরমের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন এর চাহিদাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আবহাওয়ার খবর বলছে, কাল (২ জুলাই) তাপ কমবে। বৃষ্টিও নাকি হবে। অন্য সময় হলে বৃষ্টির কথায় মন তিতে হয়ে যেত। আজ যেন কানে মধুবর্ষণ করছে। আবারও রবীন্দ্রনাথকে স্মরি: ‘...ভয় নাহি, ভয় নাহি/ গগণে রয়েছি চাহি/ জানি ঝঞ্ঝার বেশে/ দিবে দেখা তুমি এসে/একদা তাপিত প্রাণে রে...’। বৃষ্টি আসুক। পৃথিবী আবার শান্ত হোক।
১ জুন ২০২৫

[email protected]

×