ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

ইরানে যেভাবে উদযাপিত হয় পবিত্র আশুরা

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ৬ জুলাই ২০২৫

ইরানে যেভাবে উদযাপিত হয় পবিত্র আশুরা

ছবি: সংগৃহীত

মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পবিত্র আশুরা ভিন্ন ভিন্ন রূপে পালিত হলেও, শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইরানে এই দিনটি শোক, ত্যাগ ও প্রতিরোধের এক গভীর ও আবেগঘন প্রকাশ হিসেবে প্রতি বছর উদযাপিত হয়। মহররম মাসের প্রথম রাত থেকেই শুরু হয় শোকানুষ্ঠান, যা ১০ মহররম, অর্থাৎ আশুরার দিন চূড়ান্ত রূপ নেয়, যখন কারবালার প্রান্তরে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতকে স্মরণ করা হয়।

ইরানে আশুরার উদযাপনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা একই সাথে ধর্মীয় ও আদর্শিক বার্তা বহন করে। তবে এর পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ রীতিনীতিও এই উদযাপনে বিশেষ মাত্রা যোগ করে।

ইরানে আশুরা উদযাপনের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ:

  • শোক মিছিল ও মাতম (Azadari/Daste Azadari): আশুরার মূল আকর্ষণ হলো বিশাল শোক মিছিল। কালো পোশাক পরিহিত লাখো শোকার্ত মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন, যারা ইমাম হুসাইন (রা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ও তার আত্মত্যাগের স্মরণে বুকে মাতম করেন। কিছু ক্ষেত্রে, ধর্মীয় অনুভূতির গভীরতা বোঝাতে অনেকে বিতর্কিতভাবে চেন বা ধারালো ব্লেড দিয়ে নিজেদের আঘাত করার (আত্মনিগ্রহ/তাৎবির/জানজির জানি) মতো রীতিও পালন করেন, যদিও অনেক আলেম এটি সমর্থন করেন না এবং কিছু এলাকায় এটি নিষিদ্ধ। এর বিকল্প হিসেবে অনেকে রক্তদান কর্মসূচিতে অংশ নেন।

  • তা’জিয়া (Ta'ziyeh): এটি এক প্রকার শোক-নাট্য বা 'প্যাশন প্লে' যা কারবালার যুদ্ধের ঘটনাগুলোকে নাটকীয়ভাবে ফুটিয়ে তোলে। গান, আবৃত্তি ও অভিনয়ের মাধ্যমে ইমাম হুসাইন (রা.) এবং তার সঙ্গীদের আত্মত্যাগের করুণ কাহিনি তুলে ধরা হয়, যা দর্শকদের হৃদয়ে গভীর আবেগ জাগিয়ে তোলে।

  • নাকল গার্দানি (Nakhl Gardani): এটি একটি ঐতিহ্যবাহী আচার, যেখানে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কফিনের প্রতীকী রূপে বিশাল কাঠের কাঠামো ('নাকল') কাঁধে বহন করে মিছিল করা হয়। এই কাঠামোটি কাপড়, আয়না ও ধর্মীয় প্রতীক দিয়ে সজ্জিত থাকে এবং এটি এক ধরনের শোকযাত্রা হিসেবে বিবেচিত হয়।

  • শোকসভা ও ওয়াজ: মসজিদ, হোসাইনিয়া এবং অস্থায়ী তাঁবুতে ধর্মীয় সভা (মাজালিস বা কিরাত) অনুষ্ঠিত হয়। এখানে আলেম ও বক্তারা কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা এবং ইমাম হুসাইন (রা.)-এর জীবনের বিভিন্ন দিক বর্ণনা করেন, যা শ্রোতাদের চোখে অশ্রু আনে এবং চারপাশে শোকের আবহ তৈরি করে।

  • নজর (Nazr) বিতরণ: ইমাম হুসাইন (রা.)-এর নামে 'নজর' হিসেবে রান্না করা খাবার মুসল্লি ও দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়। এটি পুণ্যের কাজ হিসেবে বিবেচিত এবং বিশ্বাস করা হয় যে এই খাবারের নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে।

  • আঞ্চলিক ও গ্রামীণ ঐতিহ্য: ইরানের বিভিন্ন প্রদেশে আশুরা উদযাপনের নিজস্ব কিছু রীতি রয়েছে। যেমন, বুশেহরে সমুদ্রের পানিতে নাট্যসামগ্রী ধোয়া হয়; শাহরে কুর্দে মোমবাতি নিয়ে পাহাড়ে প্রার্থনা যাত্রা করা হয়; বিজার ও খোরামআবাদে গোলাপজল মেশানো কাদামাটি মেখে মাতম (গেল মালি) করা হয়।

  • শাম-এ গরিবান: আশুরার সন্ধ্যায় ও রাতে এই বিশেষ রীতি পালিত হয়, যেখানে মোমবাতি জ্বালিয়ে কারবালার এতিম শিশুদের দুর্দশাকে স্মরণ করা হয়।

ইরানি সরকার আশুরার কিছু অনুষ্ঠানকে সমর্থন ও প্রচার করে, আবার কিছু ঐতিহ্যবাহী আচারকে উপেক্ষা করে বা নিষিদ্ধও করে থাকে। সমগ্র ইরানে আশুরার দিন সরকারি দপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়, বাজার এবং জাদুঘর বন্ধ থাকে, যা এই দিনের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে। শোক ও ত্যাগের এই উদযাপন ইরানের শিয়া মুসলিমদের জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা তাদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং প্রতিরোধের চেতনার প্রতিফলন।

সাব্বির

×