ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

আশুরার ইতিহাস ও তাৎপর্য

হাবিবুর রহমান সুজন, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সাজেক, রাঙামাটি

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ৬ জুলাই ২০২৫

আশুরার ইতিহাস ও তাৎপর্য

ছবি: সংগৃহীত

ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। এই মাসকে আশহুরুল হুরুম বা নিষিদ্ধ মাসগুলোর অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। মহররম মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো ১০ তারিখ, যা “আশুরা” নামে পরিচিত। এ দিনটি শুধু শোক কিংবা শোক প্রকাশের দিন নয়, বরং এটি ইবাদত, ধৈর্য ও আল্লাহর রহমত লাভের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন।

হিজরতের আগেও কুরাইশরা এ দিনে রোজা রাখতেন, এবং হিজরতের পরেও রাসুল (সা.) মুসলিমদেরকে এ দিন রোজা রাখার আদেশ দেন।
আরবি 'শাহরুন' শব্দের অর্থ হচ্ছে মাস, আর 'মুহাররম' শব্দের অর্থ সম্মানিত। সুতরাং 'শাহরুল মুহাররম' এর যৌগিক অর্থ হলো 'সম্মানিত মাস।'
আরবি 'মুহাররম' থেকেই 'মহররম' শব্দটি বাংলা সাহিত্যে ও বাংলাভাষী মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে। সে যাই হোক, মহররম হলো হিজরি সনের প্রথম মাস। যা আল্লাহ তায়ালার নিকট সম্মানিত চার মাসের এক মাস। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, "নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২, যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।" (সুরা তাওবা : ৩৬)

এ মাসের দশ তারিখকে বলা হয় 'আশুরা।' কারণ, আরবি 'আশারা' থেকে এর উৎপত্তি। যার অর্থ হচ্ছে দশ। তাই এ মাসের দশ তারিখকে পবিত্র আশুরা বলে অবহিত করা হয়। আদিকাল থেকেই যুগে যুগে আশুরার এই দিবসে বহু স্মরণীয় ও ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যা আমরা পবিত্র কোরআন ও হাদিস শরীফ থেকে জানতে পাই। হাদিসে এসেছে—আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেদিন আকাশ, বাতাস, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, জান্নাত-জাহান্নাম, লাওহে মাহফুজ ও যাবতীয় সৃষ্টিজীবের আত্মা সৃষ্টি করেছেন, সে দিনটি ছিল ১০ই মুহাররম তথা পবিত্র আশুরার দিবস। আবার এ দিনেরই কোনো এক জুমাবারে হযরত ইস্রাফিল (আ.)-এর ফুঁৎকারে নেমে আসবে মহাপ্রলয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায় যাকে বলা হয় কেয়ামত।

এছাড়াও ইসলামের আরও অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে এ আশুরাতেই। এই যেমন—আদি পিতা হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয় এ দিনে, এ দিনেই হযরত আদম (আ.) কে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়, আবার ভুলের কারণে তাঁদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণের পর এ দিনই তাঁর তাওবা কবুল করা হয়।

এমনিভাবে এ দিনে জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) জন্মগ্রহণ করেন, আবার এদিনেই নমরুদের বিশাল অগ্নিকুণ্ড হতে মুক্তি লাভ করেন। এই আশুরাতেই তুর পাহাড়ে আল্লাহর সাথে হযরত মুসা (আ.)-এর কথোপকথন ও আসমানী কিতাব 'তাওরাত' লাভ করেন, আবার এই ১০ই মহররমেই জালেম ফেরাউনের দলবলসহ নীল দরিয়ায় সলিল সমাধি হয়।

তদ্রূপ, হযরত নূহ (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মহাপ্লাবন হতে মুক্তি লাভ, মাছের পেট হতে হযরত ইউনুস (আ.)-এর পরিত্রাণ, আসমান হতে বৃষ্টি বর্ষণের সূচনা—এসব কিছুই সংঘটিত হয়েছে ১০ই মহররম অর্থাৎ আশুরার দিনে।

মোট কথা, এই ১০ই মহররম যেন ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী। তাই শরিয়তের দৃষ্টিতে এ দিনটির রয়েছে অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য। মহররম মাসের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস শরীফে বহু বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে। আর এসব ফজিলতের আলোকে মুসলিম উম্মাহর জন্য এ মাসের সুনির্দিষ্ট আমল হলো 'আশুরার সিয়াম।'

হযরত আলী (রা.)-কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেন, রমজানের পর আর কোনো মাস আছে কি, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন?
তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসুল (সা.)-এর নিকটও জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ''রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তায়ালা একটি জাতির তাওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তাওবা কবুল করবেন।" (জামে তিরমিযী, ১১৫৭)

মহররম মাসের রোজা সম্পর্কে অনেক বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমনটি ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। তদুপরি, নিম্নে কয়েকটি হাদিস উপস্থাপন করা হলো। হাদিস থেকে জানা যায়, রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজাই উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর ফরজ ছিল। পরবর্তী সময়ে ওই বিধান রহিত হয়ে তা নফলে পরিণত হয়। হাদিসটি হলো, "রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা আল্লাহর মাস মহররমের আশুরার রোজা।" (সুনানে কুবরা, ৪২১০)

হযরত জাবের (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত আছে, ''রাসুল (সা.) আমাদের আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। এ বিষয়ে নিয়মিত তিনি আমাদের খবরাখবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না এবং নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবরাখবরও নিতেন না।'' (মুসলিম, ১১২৮)

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) যখন হিজরত করে মদিনায় পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন যে মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, আশুরার দিনে তোমরা রোজা রেখেছ কেন? তারা উত্তর দিল, “এই দিনটি অনেক বড়। এই পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ মূসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফিরআউন ও তার বাহিনীকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হযরত মূসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি।”

তাদের উত্তর শুনে নবী করিম (সা.) বললেন, “হযরত মূসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার।” অতঃপর তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করলেন। (বুখারি-৩৩৯৭, মুসলিম-১১৩৯)

মুসলিম শরিফের এক হাদিসে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইহুদি-নাসারারাও তো এই দিনটিকে বড় দিন মনে করে। আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য হবে।”

তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ''তারা যেহেতু এদিন একটি রোজা পালন করে, আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা এই ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব।'' (মুসলিম-১১৩৪)

ইমাম শাফেয়ী ও তাঁর সাথীবৃন্দ, ইমাম আহমাদ, ইমাম ইসহাক প্রমুখ বলেছেন, আশুরার রোজার ক্ষেত্রে দশম ও নবম উভয় দিনের রোজাই মুস্তাহাব। কেননা রাসুল (সা.) দশ তারিখ রোজা রেখেছেন এবং নয় তারিখ রোজা রাখার নিয়ত করেছেন।

হযরত আবু কাতাদা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.)-কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, "এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়।" (মুসলিম-১১৬২)

তাই আসুন! পবিত্র এই আশুরাকে মনগড়া কুসংস্কারে না ভাসিয়ে আশুরার প্রকৃত আমলকে নিজেদের জন্য পরকালের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করি।

মুমু ২

×