
ছবি: সংগৃহীত।
ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর পর মুসলিম উম্মাহ'র খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান। দীর্ঘ বিশ বছর তিনি খেলাফতের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। শাসক হিসেবে ইসলামের অনেক নীতিমালা থেকে তিনি সরে আসেন এবং মুসলিমদের সাথে বহু ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তিনি নিজের পরিবার ও গোত্রের লোকদেরকে খেলাফতের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পদায়ন করেন এবং সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেন। তার সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা ছিল- মৃত্যুর আগে তিনি নিজের পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া। তার এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলে উম্মতে মুহাম্মদীর সীমাহীন কোরবানির বিনিময়ে গড়ে ওঠা ইসলামী খেলাফতের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় একটি পরিবারের হাতে এবং খেলাফতের পরিবর্তে সৃষ্টি হয় সালতানাত বা রাজতন্ত্রের ধারা।
মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ ছিল প্রচন্ড দুশ্চরিত্র আর দুরাচারী, অত্যাচারী ব্যক্তি। মদ্যপানসহ ইসলামের শরীয়া বিরোধী বহু কাজে সে লিপ্ত ছিল। কুখ্যাত হওয়া সত্বেও মুয়াবিয়া মৃত্যুর পূর্বে নিজের অযোগ্য এই সন্তানকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা দেন। ইসলামী খেলাফতের সকল গভর্নর ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে দামেস্কে নিজের প্রাসাদে ডেকে এনে ইয়াজিদকে মেনে নিয়ে তার আনুগত্য আদায় করেন মুয়াবিয়া। কিন্তু বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু সহ মোট চারজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ইয়াজিদের আনুগত্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।
মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ সিংহাসনে বসেই ইমাম হোসাইনের মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করে দেয়। ইমাম হোসাইন তখন মদিনায় বসবাস করতেন। ইয়াজিদ মদিনার গভর্নরকে চিঠি লিখে এই নির্দেশ দেয়, হোসাইন তাকে মেনে না নিলে তাকে যেন হত্যা করা হয়। মদিনার গভর্নর ইমাম হোসাইনকে ডেকে বলেন, আপনি এই কাগজে ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিয়ে লিখিত দেন এবং তাতে স্বাক্ষর করে দেন।
ইমাম হোসাইন বলেন, এজিদের মতো ব্যক্তি যখন খেলাফতের মসনদে বসে তখন নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ধর্ম মানবজাতির কোনো উপকারে আসে না। আমি তাকে খলিফা হিসেবে মানি না। ইয়াজিদকে বলে দাও উত্তরাধিকার সূত্রে জোরপূর্বক খেলাফত দখলকে আমি স্বীকার করি না। একথা বলে তিনি চলে যান। সেখানে ইয়াজিদের অনুগত সেনারা ইমাম হোসাইনকে হত্যা করার জন্য তলোয়ার তাক করলেও মদিনার গভর্নর তাদেরকে বারণ করেন। কেননা তিনি জানতেন ইমাম হোসাইনকে হত্যা করলে মদিনার জনগণ বিদ্রোহ করবে এবং তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।
এর কিছুদিন বাদেই ইমাম হোসাইন মক্কায় হজ করতে যান। সেখানে মসজিদুল হারামে ইমাম হোসাইনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। আর হোসাইনকে হত্যার দায়িত্ব দেয়া হয় বুকাইর নামে এক যুবককে, যে ছিল ইয়াজিদের রাজদূত ও গুপ্তঘাতক। কিন্তু উত্তেজিত জনতার প্রবল বাধার মুখে ঘাতকেরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মূলত পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনার লোকজন ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মানতে রাজি ছিল না। তারা বিশ্বাস করত রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুই হচ্ছেন খেলাফতের যোগ্য উত্তরসূরি। হজ পালনকালে মসজিদুল হারামের মত পবিত্র জায়গায় যেখানে রক্তপাত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, সেখানে ইমাম হোসাইনের উপর হামলার বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। তারা বুঝতে পারেন ইমাম হোসাইনকে হত্যা করার জন্য ইয়াজিদ কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এরই মধ্যে মুসলিম খেলাফতের আরেক প্রদেশ কুফা থেকে ইমাম হোসাইনের কাছে শত শত চিঠি আসতে থাকে। কুফার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এসব চিঠিতে উল্লেখ করেন, আমরা মুয়াবিয়া ও এজিদের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। আমরা তাদের জুলুম আর অন্যায়ের সামনে অসহায়। আপনি দ্রুত কুফায় আসুন এবং আমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করুন। আমরা আপনাকে আমাদের শাসক হিসেবে দেখতে চাই। ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তার অত্যন্ত বিশ্বস্ত একজন সঙ্গীকে কুফায় পাঠিয়ে দেন সেখানকার সত্যিকার পরিস্থিতি জানার জন্য। ইমাম হোসাইনের প্রতিনিধি সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে তাকে চিঠি লিখে জানান, কুফাবাসী সত্যিই আপনাকে নিজেদের শাসক হিসেবে দেখতে চায়। তাদের উপর খলিফা ইয়াজিদ ও কুফার গভর্নর এর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কুফাবাসী তাদের বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন করেছে এবং বিদ্রোহ করেছে। এই চিঠি পাওয়ার পর ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হন। তার সাথে ছিলেন নিজের ভাই আব্বাস ইবনে আলী, স্ত্রী ও পরিবারের লোকজন এবং অল্প কয়েকজন বিশ্বস্ত সঙ্গী। তাদের কোনো ধরনের যুদ্ধ প্রস্তুতি ছিল না।
কিন্তু ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু যখন কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হন, তার পরপরই কুফার পরিস্থিতি বদলে যায়। ইয়াজিদের অতি বিশ্বস্ত কয়েকজন ব্যক্তি কুফায় গমন করে এবং সেখানকার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ ও শিমার ইবনে জওশন। এই ওবায়দুল্লাহ ও শিমারের সাথে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর আমল থেকেই পারিবারিক বিরোধ চলে আসছিল। তাদের পূর্বপুরুষেরা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর খেলাফতের বিরোধী ছিল। মুয়াবিয়া খেলাফত গ্রহণের পর এদেরকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করে এবং ইয়াজিদের শাসনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই ওবায়দুল্লাহ ও শিমার ইবনে জওশন। তারা বিভিন্ন প্রদেশে গিয়ে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী ব্যক্তিদেরকে ধরে ধরে প্রকাশ্যে হত্যা করতে শুরু করে। অতঃপর ইয়াজিদের নির্দেশে ওবায়দুল্লাহ শিমারকে সাথে নিয়ে কুফায় গমন করে এবং সেখানকার গভর্নর ওমর বিন সাদের সাথে মিলে পরিকল্পনা শুরু করে কিভাবে এই বিদ্রোহ দমন করা যায়।
ওবায়দুল্লাহ ছিল অত্যন্ত চতুর আর সে ছিল চটকদার বক্তা। সে কুফাবাসীর সামনে দীর্ঘ বক্তব্যে প্রথমে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ভয়ানক পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করে। এরপর সে তাদেরকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখায়। আশ্চর্যের বিষয় ওবায়দুল্লাহর এই বক্তব্যে কুফার অধিবাসীরা মুহূর্তের মধ্যে ইমাম হোসাইনের আনুগত্যের শপথ থেকে বের হয়ে আসে এবং ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। অতঃপর সবার সামনে হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যুতে সেই কুফাবাসীকে বিপুল উল্লাস করতে দেখা যায়, যারা কদিন আগেও ইমাম হোসাইনের এই ভাইকে সবচেয়ে বেশি সম্মান করতো।
অতঃপর ওবায়দুল্লাহ কুফাবাসীকে আহবান করে ইয়াজিদের বাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য। দলে দলে কুফার লোকজন ইয়াজিদের বাহিনীতে যোগ দেয়। অতঃপর তারা রওনা হয় সেই হোসাইনকে হত্যা করার জন্য, যেই হোসাইনকে তারা নিজেরা দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছে। আর সেই সেনাবাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় হুর ইবনে ইয়াজিদ তামিমী নামে এক ব্যক্তিকে, যিনি ছিলেন খেলাফতের প্রতি অনুগত ও বিশ্বস্ত এক বর্ষীয়ান যোদ্ধা। তার সাথী হয় তারই পুত্র বুকাইর ইবনে হুর। এ হচ্ছে সেই যুবক যিনি ইয়াজিদের নির্দেশে মক্কায় গিয়েছিলেন ইমাম হোসাইনকে হত্যা করতে। ইয়াজিদের ডান হাত ওবায়দুল্লাহ হুরকে নির্দেশ দেয় ইমাম হোসাইনের পথ অবরোধ করতে এবং সেখানকার পরিস্থিতি তাকে জানাতে। এক হাজার সেনার একটি বাহিনী নিয়ে হুর বের হয়ে পড়েন এবং ফোরাত নদীর তীরে ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর মুখোমুখি হন। তিনি জানতেন ইমাম হোসাইন বিশাল বাহিনী নিয়ে এসেছেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি দেখতে পান ইমাম হোসাইনের সঙ্গী মাত্র বাহাত্তর জন। তিনি ইয়াজিদের প্রতিনিধি ওবায়দুল্লাহর নির্দেশে ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর পথ অবরোধ করেন এবং কারবালা প্রান্তরে তাদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। তাছাড়া তিনি ফোরাত নদীর পানি আটকে দেন এবং হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর সঙ্গীদের জন্য ফোরাতের পানি নিষিদ্ধ করে দেন। এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর তাঁবু থেকে কেউ যেন ফোরাত নদীর পানি নিতে না পারে সেজন্য একদল পাহারাদার মোতায়েন করা হয়। ওবায়দুল্লাহর নির্দেশে তিনি এই কাজ করেছিলেন যেন ইমাম হোসাইন ও তার সঙ্গীরা পানির যন্ত্রণায় মৃত্যুমুখে পতিত হন।
হুরের উপর নির্দেশ ছিল ইমাম হোসাইন ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নেয়ার আগ পর্যন্ত তাদেরকে কষ্ট দিতে থাকো। আর কোনো ব্যাপারে যদি তারা বাড়াবাড়ি করে তাহলে তাকে হত্যা করো। সেনাপতি হুর খেলাফতের নির্দেশ পালনে আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু তিনি যখন হযরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর সংস্পর্শে আসেন তখন তার বিশাল ব্যক্তিত্ব তাকে মুগ্ধ করে। ধীরে ধীরে তিনি হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। তিনি হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর তাঁবুতে নিয়মিত যাতায়াত করতে শুরু করেন এবং তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, তিনি তার গোটা সেনাবাহিনী নিয়ে ইমাম হোসাইনের ইমামতিতে নামাজ আদায় করতেন।
ওমর ইবনে সাদ কারবালার প্রান্তরে এসে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে নিয়ে নেয়। এরই মধ্যে ইয়াজিদ বাহিনীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এক হাজার থেকে ত্রিশ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ওমর ইবনে সাদও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর সাথে সাক্ষাত করার পর তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। সে হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর সাথে বৈঠক করার পর ওবায়দুল্লাহর উদ্দেশ্যে কুফায় একটি চিঠি পাঠায়, যে চিঠিতে হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর ব্যাপারে কিছুটা সহানুভূতি প্রকাশ পায়। এতে ওবায়দুল্লাহ খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ফিরতি চিঠিতে ওমর ইবনে সাদকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়। সে বলে, তোমাকে হোসাইনের প্রতি দরদ দেখানোর জন্য পাঠানো হয়নি। তোমাকে পাঠানো হয়েছে তাকে হত্যা করার জন্য। হয় খলিফা এজিদের প্রতি হোসাইনের আনুগত্য আদায় করো, না হয় তাকে হত্যা করো। যদি এই কাজে ব্যর্থ হও তাহলে তোমাকে তোমার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে এবং শিমারকে তোমার জায়গায় বসানো হবে। এই হুঁশিয়ারি পাওয়ার পর ওমর বিন সাদ নড়েচড়ে বসে। সে বুঝতে পারে নিজের গদি রক্ষা করতে হলে যা নির্দেশ এসেছে তার বাস্তবায়ন ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কখনো হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বা তার পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জন্ম নিলেও শিমারের দিকে তাকালে তার কলিজা শুকিয়ে যেত। মনে হতো এই শিমার তার ক্ষমতা কেড়ে নিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এই ভয়ে সে হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর প্রতি কঠোরতা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরদিন হামলা চালানোর ঘোষণা দেয়।
দুই পক্ষের মধ্যে যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে তখন ঘটে যায় চাঞ্চল্যকর এক ঘটনা। ইয়াজিদ বাহিনীর প্রথম সেনাপতি হুর ইবনে ইয়াজিদ ও তার ছেলে বুকাইর ইবনে হুর পালিয়ে ইমাম হোসাইনের তাঁবুতে চলে যান। তারা ইমাম হোসাইনের আনুগত্য গ্রহণ করেন এবং তার জন্য শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। পরদিন যখন দুই পক্ষ একে অপরের মুখোমুখি হয় তখন দেখা যায় একদিকে ইয়াজিদের ত্রিশ হাজার সেনা, অন্যদিকে হযরত ইমাম হোসাইনের মাত্র ৭২ জন সঙ্গী। সত্যি বলতে এটা কোনো যুদ্ধ ছিল না, বরং এটা ছিল হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ও তার সাথীদের উপর চালিয়ে দেয়া এক হত্যাযজ্ঞ। নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও হোসাইনের সঙ্গীরা তাকে ছেড়ে চলে যাননি। তারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নবীর দৌহিত্রের পাশে থেকে যুদ্ধ করে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। ইমাম হোসাইন তাদেরকে অনুরোধ করে বলেন, তোমরা রাতের অন্ধকারে ফোরাত নদী পার হয়ে চলে যাও। আমার একার জন্য সবার জীবন বিপন্ন করার কোনো মানে হয় না। কেননা তোমরা জীবন দিয়েও আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। তারা জিজ্ঞেস করেন, নবীর দৌহিত্র কি আমাদের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন? এরপর ইমাম হোসাইনের আর কিছুই বলার থাকে না।
নবীর দৌহিত্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারী এই ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন তারই ভাই আব্বাস ইবনে আলী, জুবাইর ইবনে কান, হাবিব ইবনে মাজোয়াহির, সাদ ইবনে হানযালা, কাসিদ ইবনে জুহাইর, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আবিস ইবনে শাবিব, মুসলিম ইবনে আওসাজা, জাফর ইবনে আকিল প্রমুখ। পাশাপাশি হুর ইবনে ইয়াজিদ তামিমী ও তার পুত্র বুকাইর ইবনে হুর। তারা প্রত্যেকে ছিলেন ঈমানী চেতনায় উদ্দীপ্ত একেকজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। যুদ্ধের দামামা যখন বেজে ওঠে তখন শুরুতেই রীতি অনুযায়ী দ্বৈত যুদ্ধের আহবান জানানো হয়।
দ্বৈত যুদ্ধে ইমাম হোসাইনের সঙ্গীদের কাছে ইয়াজিদের বাহিনীর বড় বড় যোদ্ধারা পরাজিত হতে থাকে। অতঃপর ইয়াজিদ বাহিনীর কমান্ডার ওমর ইবনে সাদ তার বাহিনীকে একযোগে আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেয়। মাত্র ৭২ জন যোদ্ধা মোকাবেলা করেন হাজার হাজার শত্রুকে। তাদের একেকজনকে ঘিরে ধরে অসংখ্য ইয়াজিদ সেনা। তবুও তাদের কেউই আত্মসমর্পণ করেন না। বীরদর্পে তলোয়ার চালিয়ে তারা লড়াই করতে থাকেন। আর এভাবেই নিজেদের নেতৃত্বের প্রতি অঙ্গীকার রক্ষা করতে গিয়ে একে একে শহীদ হন কাসিদ ইবনে জুহাইর, জুবাইর ইবনে কান, হাবিব ইবনে মাজোয়াহির, সাদ ইবনে হানযালা, আবিস ইবনে শাবিব, মুসলিম ইবনে আওসাজা, জাফর ইবনে আকিলের মতো যোদ্ধারা। শাহাদাতের এই যাত্রায় তাদের সঙ্গী হন হুর ইবনে ইয়াজিদ তামিমী, যিনি ছিলেন ইয়াজিদ বাহিনীর প্রথম সেনাপতি।
অতঃপর জোহরের নামাজের সময় হয়। যুদ্ধবিরতির আহবান জানানো হয় এবং উভয়পক্ষ যার যার শিবিরে ফিরে যায়। ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর নেতৃত্বে তার সেনারা যখন সালাতুল খউফ অর্থাৎ আশঙ্কাকালীন নামাজ আদায় করছিলেন, তখন ইয়াজিদের শিবির থেকে ছোড়া হয় ঝাঁকে ঝাঁকে তীর। আর সেই তীরে বিদ্ধ হয়ে নামাজরত অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন অনেক যোদ্ধা।
এদিকে পানির অভাবে ইমাম হোসাইনের শিবিরে সৃষ্টি হয় তীব্র হাহাকার। তৃষ্ণায় কাতর হয়ে মারা যেতে থাকে শিশুরা। শিবিরের এই হাহাকার দেখে আব্বাস ইবনে আলী তার ভাই হোসাইনের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে বলেন, আমাকে অনুমতি দিন। আমি ইয়াজিদের পাহারাদারদের উপর হামলা করে ফোরাত নদী থেকে পানি নিয়ে আসবো। ইমাম হোসাইন জানতেন তার ভাই আর কখনো ফিরে আসবে না। তিনি অশ্রুভেজা কন্ঠে তাকে অনুমতি দেন, কেননা এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আব্বাস ইবনে আলীর দ্রুতগামী ঘোড়া ছুটে যায় ফোরাতের তীরে। ইয়াজিদের পাহারাদার সেনারা তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি যাকে সামনে পান তাকেই হত্যা করে ফোরাতের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। কেউই তার পথ আগলে দাঁড়াতে পারে না। তিনি যখন ফোরাতের স্বচ্ছ পানি নিয়ে ফিরে আসছেন তখন দূর থেকে তাকে উদ্দেশ্য করে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছোড়ে ইয়াজিদের সেনারা। তীরে বিদ্ধ হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন আব্বাস ইবনে আলী।
অতঃপর তারা কাছে এসে আব্বাসের ডান হাত কেটে ফেলে। তিনি বাম হাতে পানির পাত্র ধরে রেখেছিলেন আর সেই পানি নিয়ে নিজের শিবিরে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তারা তার বাম হাতও কেটে ফেলে। অতঃপর তিনি পানির পাত্র মুখে তুলে নেন এবং শিবিরে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তারা তার মাথায় প্রচন্ড আঘাত করে আর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আর এভাবেই শিশুদের জন্য পানির আশায় ফোরাতের তীরে গিয়ে শহীদ হন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর পুত্র আব্বাস ইবনে আলী।
প্রিয় ভাইয়ের মৃত্যুর পর হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে সঙ্গ দেয়ার মতো তেমন কোনো যোদ্ধা অবশিষ্ট ছিল না। বেঁচে ছিলেন কেবল হুর এর পুত্র বুকাইর, যিনি একসময় হোসাইনকে হত্যা করার জন্য ঘুরে বেড়াতেন। তিনিও নিজের পিতার মতো ইয়াজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং গুরুতর আহত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অতঃপর যখন আর কোনো যোদ্ধা অবশিষ্ট নেই, তখন হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু নিজের ভাই আব্বাসের ছয় মাসের শিশুপুত্র আব্দুল্লাহকে কোলে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে যান। তিনি আব্দুল্লাহকে উঁচু করে ধরে বলেন, হে পাষণ্ডরা, তোমাদের সাথে শত্রুতা আমার, কিন্তু এই নিষ্পাপ শিশুকে কেন তোমরা পানির কষ্ট দিচ্ছ? হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর এই প্রশ্নের জবাব তারা দিয়েছিল তীরের ভাষায়। মুহূর্তে এক পশলা তীর এসে বিদ্ধ করে দেয় শিশু আব্দুল্লাহর বুক। অতঃপর তারা একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর উপর। নবীর দৌহিত্র শেষ নিঃশ্বাস থাকা অবধি বীরদর্পে যুদ্ধ করে যান ইয়াজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে। আর এভাবেই কারবালার ময়দানে শহীদ হন নবীজির নয়নের মনি, তার কলিজার টুকরা ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু।
তার এই শাহাদাতের সাক্ষী হয় অভিশপ্ত কারবালার প্রান্তর। আর সাক্ষী হয় হাত গুটিয়ে নেয়া ফোরাত নদী, আর সাক্ষী হয় মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর বুকাইর ইবনে হুর, আর সাক্ষী হয় সেই শ্বেত ঘোড়া, যে বহন করছিল বিশ্বাসঘাতক কুফাবাসীর সেই চিঠিগুলো, যেখানে তারা ইমাম হোসাইনের প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল।
এ ঘটনার কিছুকাল পর আব্দুল্লাহকে এক কুফাবাসী জিজ্ঞেস করেছিল, মশা মারার ফতোয়া কি? তিনি বলেছিলেন, এরা আমার কাছে মশা মারা জায়েজ কি নাজায়েজ সেই বিষয়ে জানতে চায়। অথচ কিছুকাল আগে এরাই হত্যা করেছে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয় নাতি হোসাইনকে।
মিরাজ খান