
ছবিঃ ছাত্রদল নেতা রাফি
জুলাই অভ্যুত্থানে পতন হওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। সে সময়ের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) ছাত্রদল কর্মী রিফাত হোসেন রাফি ভিন্ন মতাদর্শের হওয়ায় বৈধভাবে হলের সিট পেলেও আশ্রয় মেলেনি। ছাত্রলীগের অমানুষিক নির্যাতন সহ্য ও জোরপূর্বক হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল রাফিকে।গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তীতে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর সেই একই রুমে প্রত্যাবর্তন করেছেন তিনি। থাকতেন ৫০৪ নাম্বার রুমে।
সেই দিনগুলো স্মৃতিচারণ করে ছাত্রদল কর্মী রাফি বলেন, “একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে উন্মুক্ত এবং স্বতন্ত্র। সেখানে সবাই নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে এবং যার যার আদর্শ ধারণ করতে পারবে। এটাই তো স্বাধীনতা, যা অতীতের স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট শাসনের আমলে ছিল না। একজন শিক্ষার্থী বুকে অনেক আশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে—পড়াশোনা করতে, মুক্তভাবে চিন্তা করতে, নিজের আদর্শ মেনে চলতে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুটা আমার জন্য মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল। ক্লাস করতাম, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম—এইভাবেই দিনগুলো কেটে যেত। কিন্তু জাতীয়তাবাদী আদর্শের পরিবারে বড় হওয়া ছেলে হিসেবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজনীতিতে যুক্ত হই।
এরপর বৈধ এলটমেন্টের মাধ্যমে হলে সিট পাই। কিন্তু সেখানেই শুরু হয় নতুন বিপত্তি। সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের অনুমতি ছাড়া হলে প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইদের সহযোগিতায় ছাত্রলীগকে না জানিয়ে সাধারন হয়ে হলে থাকতে শুরু করি।
একদিন মালপত্র নিয়ে হলে উঠতে গিয়ে আমাকে দেখে ফেলে ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক কুরুত বাবুল। বিষয়টি গিয়ে পৌঁছে তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেলের কাছে। আমাদের রুমটি ছিল পুরোপুরি ‘ননপলিটিক্যাল’। পোমেলের কাছের বন্ধু ছিলেন আমার ডিপার্টমেন্টের মাহাদী ভাই। সেই সুবাদেই পোমেল, নিজের ইচ্ছা না থাকলেও, আমাকে রুমে থাকতে দিয়েছিল।
কিন্তু আমার হলে ওঠার কারণে নতুন সমস্যা তৈরি হয়। কারণ, সেই রুমে কুরুত বাবুল একজন ছেলেকে তুলতে চেয়েছিল। এরপর আমাদের ডেকে আনে পোমেল, বাবুলসহ আরও কয়েকজন। ইইই বিভাগের ১০ম ব্যাচের উসমান ভাইকে পোমেল আর বাবুল অকথ্য গালাগালি বর্ষণ করল যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
পমেল চিৎকার করে বলল—“আমার অনুমতি ছাড়া তোদের রুমে একজন ননপলিটিক্যাল ছেলে কার অনুমতিতে তুললি? তোদের রুম থেকে কেউ কোনো প্রোগ্রাম করে না, তার ওপর আবার আরেকটা ননপলিটিক্যাল ছেলে! ও কি প্রোগ্রাম করবে?” আরও কত যে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করল!
ভাবতেই অবাক লাগে একজন শিক্ষার্থী বৈধ সিট পেয়েও হলে থাকতে পারছে না। কী ভয়ঙ্কর সেই পরিস্থিতি!
এইদিকে আমি লুকিয়ে বিএনপির বিভিন্ন প্রোগ্রামে যেতাম, মহানগরে গিয়ে। একদিন বিএনপির একটি প্রোগ্রামে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের আহ্বায়ক মোঃ আল-আমিন ইসলাম ভাই, আমি,এবং ইয়ামিন সহ আমরা তিনজন বিএনপি পার্টি অফিস থেকে বের হচ্ছিলাম। সেই সময় ছাত্রলীগের সহসভাপতি তানভীর আমাকে দেখে ফেলে। তবে তেমনভাবে পরিচিত না থাকায় সে আমাকে চিনতে পারেনি। সেদিন ভয়ে ভয়ে সরে পড়ি।
প্রথমে মনে হলো, যেহেতু কোনো চাপ এলো না, নিশ্চিন্ত। কিন্তু বুঝতে পারিনি। এটি ছিল ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা।
একদিন হলে ঢুকতে গিয়ে তানভীর আবার আমাকে দূর থেকে দেখে ফেলে। পরে আমার ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাইকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। সেভাবে কোনো তথ্য পায়নি। তবু সন্দেহের বশে তানভীর আমার রুমমেটদের বিভিন্নভাবে হুমকি আর চাপ দিতে শুরু করে।
একসময় আমার রুমের সবাই মিটিং বসায়। তারা আমাকে চাপ দেয়, জিজ্ঞাসাবাদ করে। শেষমেশ আমি স্বীকার করি যে আমি ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত। তখন ভাইরা বলল “দেখছিস, আমরা কোনো প্রোগ্রাম করি না, আর তুই বিএনপি/ছাত্রদল করিস। এখন তো আমাদের হলে থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে!”
এই খবর পোমেলদের কানে পৌঁছে যায়।
এরপরই শুরু হয় ভয়াবহ নির্যাতন। আমাকে শেখ মুজিব হল বর্তমান বিজয় ২৪ হলের ছাদে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল, সহ-সভাপতি তানভীর, বাবুল, সুব্রত ঘোষ, তন্ময়সহ আরও কয়েকজন ছাত্রলীগের নেতা। দেশীয় অস্ত্র—রড, লোহার পাইপ, লোহার চেইন দিয়ে আমাকে অমানুষিকভাবে মারধর করে। সারা শরীরে কালশিটে দাগ পড়ে। সারারাত নির্যাতনের পর, ভোরের আলো ফোটার আগেই তারা আমাকে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। উপায় না দেখে আমি হল ছেড়ে চলে যাই।
এরপর একদিন, আমার বন্ধু তারেক, ইতিহাস বিভাগের ১৩তম ব্যাচ, হঠাৎ কল করে। ওপাশ থেকে বলে “তোকে খুঁজতে দুইজন লোক হলে এসেছিল। সাবধানে থাকিস!” পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি,আহ্বায়ক আল-আমিন, সদস্য সচিব রাশেদ মন্ডল ভাইয়ের নেতৃত্বে, দেশনায়ক তারেক রহমানের আহ্বানে রংপুর টু দিনাজপুর তারুণ্যের রোডমার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল এর প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ায় ডিবি পুলিশ সিভিল ড্রেসে আমাকে খুঁজতে এসেছিল। আল্লাহর রহমতে সেদিন বেঁচে যাই। আমার বন্ধু কোনো তথ্য দেয়নি তাদের।
কিন্তু এরপরও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা প্রায়ই আমার খোঁজ নিতে থাকল। সুব্রত ঘোষ তো প্রায়ই রুমে এসে হুমকি দিত, আমার খবর দেওয়ার জন্য।
এরপর টানা প্রায় তিন মাস আমি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই ঢুকতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হয়ে এর থেকে বঞ্চনা এবং বেদনাদায়ক আর কি হতে পারে? আমার একাডেমিক ক্যারিয়ার প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়ে যায়।
একজন ছাত্র যখন নিজের আদর্শ চর্চার কারণে এমন অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়, যখন সে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখতে পারে না, তার একাডেমিক জীবন ধ্বংসের মুখে পড়ে—তখন এর চেয়ে বড় কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন আর হতে পারে না।
আমি চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো হোক মুক্ত আদর্শিক চর্চার স্থান—যেখানে যেকোনো শিক্ষার্থী তার নিজস্ব আদর্শ চর্চা করতে পারবে, ভয় বা নির্যাতনের শঙ্কা ছাড়াই।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মোঃ আল আমিন ইসলাম বলেন, " প্রতিটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা তাদের গনতান্ত্রিক চর্চা করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠনটি কোনো ক্যাম্পাসেই ফ্যাসিস্ট হাসিনার সময়ে ভিন্নমতকে সহ্য করতে না পেরে শিক্ষার্থীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন সহ বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের হয়রানি করেছে। রাফি আমাদের সাথে ছাত্রদলের কর্মসূচীতে যাওয়ার কারণে ছাত্রলীগ সভাপতি পোমেল সহ তার সন্ত্রাসী বাহিনীর দ্বারা হলে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিলো। শুধু রাফি না, ভিন্নমতের কেউ ক্যাম্পাসে নিরাপদে তাদের শিক্ষা-কার্যক্রম চালাতে পারেনি।বিভিন্ন সময়ে অনেক শিক্ষার্থী এরকম নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। অবিলম্বে দলের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে, ইনশাআল্লাহ।‘
নোভা