ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

আলিফ লায়লা; কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া শৈশব

মো. আতিকুর রহমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ৬ জুলাই ২০২৫

আলিফ লায়লা; কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া শৈশব

নব্বইয়ের দশকে যারা বেড়ে উঠেছেন, তাদের শৈশবের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল শুক্রবার সন্ধ্যার সেই অপেক্ষা—যখন বিটিভির পর্দায় ভেসে উঠতো জাদুর এক দুনিয়া, যার নাম আলিফ লায়লা। ভারতীয় টিভি ধারাবাহিক হলেও, ‘আরব্য রজনীর’ গল্পভিত্তিক এই সিরিয়ালটি বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরের অতিথি হয়ে উঠেছিল যেন। গল্প বলার অসাধারণ ভঙ্গি, কল্পনার জগৎকে জীবন্ত করে তোলার দক্ষতা এবং সময়োপযোগী পরিবেশনায় এটি হয়ে উঠেছিল এক প্রজন্মের কল্পনার রঙিন সেতু।

প্রতি শুক্রবার বাংলা সংবাদের পরপরই, পুরো পরিবার একসঙ্গে বসে টিভির সামনে। শেহেরেযাদের কণ্ঠে গল্প শুরু হতো—একটি গল্পের ভেতর আরেকটি গল্প, আর তারও ভেতর আরেকটি, যেন এক অন্তহীন রহস্যের গোলকধাঁধা। সিনবাদ, আলাদিন, আলী বাবা কিংবা চোর-জাদুকরেরা পর্দায় এসেই যেন আপন মানুষ হয়ে উঠত। শিশু থেকে প্রৌঢ়, সবাই এই গল্পগুলোতে নিজের ছায়া খুঁজে পেত।

আলিফ লায়লা কেবল একটি টেলিভিশন প্রোগ্রাম ছিল না, ছিল বাস্তব জীবনের বাইরে গড়ে তোলা এক আশ্চর্য জগৎ, যেখানে উড়ন্ত কার্পেট, দৈত্য-জিন আর চতুর রাজারাজড়ারা কল্পনার খাঁচা ভেঙে পর্দা ছাপিয়ে মনে গেঁথে যেত। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সেট, কস্টিউম, চরিত্র ও আবহসংগীত—সব মিলিয়ে ধারাবাহিকটি এমনভাবে নির্মিত হয়েছিল, যা আজও দর্শক মনে বিস্ময়ের ছাপ রেখে গেছে।

এই ধারাবাহিকের সফলতা মূলত নিহিত ছিল তার ‘গল্প বলার শক্তি’-তে। প্রতিটি পর্বের শেষে গল্পটি থেমে যেত এক রহস্যময় মুহূর্তে, আর শেহেরেযাদ বলত—“কাল বলব বাকি কথা।” সেই ‘কাল’ ছিল পরের শুক্রবার, আর তার জন্য অপেক্ষা ছিল এক সুদীর্ঘ অধীরতা। আজকের ওটিটি ও ইউটিউবের যুগে যেখানে এক বসায় পুরো সিরিজ দেখা যায়, সেখানে এমন ধারাবাহিক অপেক্ষা ও আগ্রহ আজ প্রায় বিলুপ্ত।

আলিফ লায়লার মতো একটি বিদেশি প্রযোজনাকে এদেশের মানুষ এভাবে আপন করে নিয়েছিল, তার একটি বড় কারণ ছিল গল্পগুলোর সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আবহের মিল। ইসলামী ইতিহাস, নৈতিক শিক্ষা, এবং কল্পনার রং মিলে এক অদ্ভুত আকর্ষণ তৈরি করেছিল। অনেক শিশু এই ধারাবাহিক দেখে জেনেছে ‘সাবর’ কী, ‘চালাকি’ কাকে বলে, কিংবা সত্য বলার পুরস্কার কী হতে পারে।

আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই দেখা যায়—আলিফ লায়লার পুরনো ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করা হচ্ছে, বা কেউ নস্টালজিক হয়ে লিখছেন—“আমার শৈশবের শুক্রবারের সন্ধ্যা মানেই আলিফ লায়লা।” যারা তখনকার দর্শক ছিলেন, তারা জানেন এই অনুভূতির মর্ম।

এই সাফল্য আধুনিক নির্মাতাদের জন্যও বড় এক শিক্ষা। প্রযুক্তি বা বাজেট নয়, একটি ভালো গল্পই পারে যুগান্তকারী কাজ করতে। আলিফ লায়লা আজও প্রমাণ করে—স্মার্টফোন বা স্পেশাল ইফেক্ট নয়, মানুষের মনে সবচেয়ে গভীর ছাপ রাখে হৃদয় ছোঁয়া কাহিনি।

শুধু একটি সিরিয়াল নয়, আলিফ লায়লা ছিল এক অভিজ্ঞতা। এক যুগান্তকারী শৈশবের সাক্ষী, এক স্বপ্নের দরজা—যেটি শুক্রবার সন্ধ্যায় খুলত, আর প্রতিবার আমাদের নিয়ে যেত কল্পনার এক রাজ্যে, যেখান থেকে ফেরার পরও সেই জাদু অনেকক্ষণ ধরে মন থেকে যেত না।

আঁখি

আরো পড়ুন  

×