ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

কর্মব্যস্ত জীবনে প্রকৃতির মাঝে প্রশান্তির সন্ধান

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ৫ জুলাই ২০২৫

কর্মব্যস্ত জীবনে প্রকৃতির মাঝে প্রশান্তির সন্ধান

কর্মব্যস্ত জীবনে প্রকৃতি

নাগরিক জীবনের নিরবচ্ছিন্ন ছুটে চলার মাঝে এক ধরনের গভীর মানবিক অভাব জন্ম নিচ্ছে। নিজের সঙ্গে যোগাযোগের, প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানোর, প্রকৃতির স্পর্শে কিছুটা প্রশান্তি পাওয়ার। প্রতিদিনকার সকাল অফিসের তাড়া, যানজটের বিরক্তি, দুপুরে লাঞ্চের ফাঁকে ইমেইল চেক, আর সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজের চাপে ডুবে থাকা। এই তো আমাদের চেনা জীবনচিত্র। ঘড়ির কাঁটা যেন বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। তোমার বিরতির কোনো অবকাশ নেই। এই বাস্তবতায় ছুটি হয়ে ওঠে শুধু বিশ্রামের সুযোগ নয়, বরং জীবনের সঙ্গে পুনঃসংযোগের দরজা।

ঈদের ছুটি, পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস, বড়দিন বা হঠাৎ পাওয়া সরকারি লম্বা ছুটিগুলো আমাদের সামনে এনে দেয় এমন কিছু মুহূর্ত, যা আমাদের আবার জীবনকে নতুনভাবে চিনতে শেখায়। অনেকে এই ছুটিকে পরিবারের সঙ্গে কাটানোর সেরা সময় হিসেবে বিবেচনা করেন, আবার কেউ কেউ বেরিয়ে পড়েন প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে। নতুন কিছু দেখার আশায়, নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে।

সময়ের চাপে হারিয়ে যাওয়া মানুষ 

ঢাকা, চট্টগ্রাম বা সিলেটের মতো শহরে জীবনের গতির এমন অবস্থা যে প্রতিদিন একটি নির্ধারিত রুটিনে বন্দি থেকে মানুষ ক্রমেই ক্লান্ত, নিষ্প্রাণ এবং আবেগহীন হয়ে পড়ছে। ট্রাফিকের সময়, অফিসের চাপ, মোবাইল ও ল্যাপটপের নিরবচ্ছিন্ন অনলাইন সংযোগ। সব মিলিয়ে জীবন যেন শুধুই চলতে থাকা এক যন্ত্র। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সময় নেই, প্রিয়জনকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরার সময় নেই।
এই অবস্থায় ছুটির দিনগুলো আমাদের সামনে নিয়ে আসে এক রকম ‘মানবিক পরিত্রাণ’। সেগুলো যেন জীবনের ভেতর ছোট্ট কিন্তু প্রয়োজনীয় এক বিরতি। ছুটির দিন মানে শুধু বিছানায় গড়িয়ে পড়ে থাকা নয়, বরং নিজের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে এবং পরিবারের সঙ্গে নতুন করে সংযোগ স্থাপন করার উপলক্ষ।

প্রকৃতির কোলে কিছুটা প্রশান্তি

এই ছুটির সুযোগে অনেকেই ঘুরে বেড়াতে যান। কেউ কক্সবাজারের বালুকাবেলায়, কেউ বান্দরবানের পাহাড়ে, কেউবা সিলেটের চা বাগানে। এই বেড়ানো কেবলমাত্র বেড়ানো নয়। এটি এক ধরনের মানসিক নিরাময়। প্রকৃতি আমাদের বিচার করে না, গঠন করে না, প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয় না। বরং প্রকৃতি শুধু আমাদের ‘থাকতে’ শেখায়। এই মুহূর্তে, শান্তভাবে, সজীবভাবে। যখন কেউ নাফ নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বাতাস অনুভব করে বা লালাখালের নীল জলরাশি দেখে মুগ্ধ হয়, তখন শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনের এক অজানা ভার হালকা হয়ে যায়। শহরের কোলাহল, কর্মক্ষেত্রের চাপ, সামাজিক দায়িত্ব। সব কিছু কিছু সময়ের জন্য হলেও দূরে চলে যায়।
প্রকৃতির কাছে গেলে মানুষ আবার নিজের শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত হয়। সে মনে করে। আমি শুধু একজন কর্মচারী নই, আমি একজন মানুষ; আমি কেবল ছুটে চলা যন্ত্র নই, আমি অনুভব করতে পারি। এই অনুভবই মানুষকে আবার জীবনের মূল সুরে ফিরিয়ে আনে।

ছোট ছোট মুহূর্ত, বড় বড় স্মৃতি

একটি ছোট ছুটি বড় কোনো উপলব্ধির জন্ম দিতে পারে। হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া, এক কাপ চায়ের আড্ডায় অচেনা কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব বা রাস্তার পাশে স্থানীয় কোনো খাবার চেখে দেখা। এই অভিজ্ঞতাগুলো কেবল আনন্দ দেয় না, এগুলো মনে থাকে, হৃদয়ে থাকে, জীবনের রঙিন স্মৃতিতে পরিণত হয়। এই মুহূর্তগুলোতে পরিবারে সম্পর্কগুলো আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। যারা প্রতিদিন এক ছাদের নিচে থেকেও আলাদা সময় কাটান, ছুটির একটি দিন একসঙ্গে কাটিয়ে বুঝতে পারেন। আসলে আমরা কতটা দূরে সরে গিয়েছিলাম। একসঙ্গে হাঁটা, খাওয়া, ঘোরাফেরা। এসব ছোট ছোট কাজগুলোই আমাদের মধ্যে থাকা আত্মিক দূরত্ব কমিয়ে আনে।


শিশুদের জন্য শেখ ও বড়দের জন্য জীবন অনুভব

ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া শিশুদের জন্য শুধু আনন্দ নয়। এটি একটি শিক্ষার ক্ষেত্র। কক্সবাজারের সমুদ্র দেখা, সিলেটের চা বাগানে হাঁটা, মহাস্থানগড় বা স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভে দাঁড়ানোÑ এসব তাদের বইয়ের পাতা থেকে বাস্তব জীবনের সংযোগ তৈরি করে। তারা শেখে ইতিহাস, পরিবেশ, সংস্কৃতি, আর সবচেয়ে বড় কথাÑজীবনের বৈচিত্র্য। শিশুদের মতো বড়রাও নিজেরা অনেক কিছু শিখে ফেরেন। কাজের ক্লান্তি, সামাজিক দায়িত্ব ও মানসিক চাপে অনেকেই নিজের ভেতরের শান্তিকে হারিয়ে ফেলেন। প্রকৃতির মাঝে কয়েকটি দিন কাটিয়ে তারা ফিরে পান সেই হারানো প্রশান্তি, মনোযোগ, সৃষ্টিশীলতা।

নতুন চেতনা নিয়ে কর্মজীবনে ফিরে আসা

ছুটির পর কর্মক্ষেত্রে ফিরে এসে আমরা যেন একটু অন্য মানুষ হয়ে উঠি। চোখে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি, মাথায় নতুন চিন্তা, কাজে নতুন উদ্যম। ক্লান্তিকর দিনগুলোতে ভ্রমণের সেই মুহূর্তগুলোই হয়ে ওঠে আমাদের মনের শক্তি। বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায়ও দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ছুটি নেন বা প্রকৃতির সঙ্গে কিছু সময় কাটান, তারা কর্মজীবনে আরও উৎপাদনশীল, সৃজনশীল এবং মানসিকভাবে স্থিতিশীল থাকেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, ছুটি এবং ভ্রমণ আসলে একটি জীবনের বিনিয়োগÑকাজের বিরতি নয়, কাজের প্রেরণা।

সংস্কৃতির সঙ্গে পুনঃসংযোগ
ছুটি আমাদের শুধু প্রকৃতির সঙ্গে নয়, নিজের সংস্কৃতির সঙ্গেও সংযোগ করিয়ে দেয়। যেমন পহেলা বৈশাখে গ্রামের মেলা দেখা, বা ঈদের সময় আত্মীয়দের বাড়ি যাওয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয়Ñ আমাদের শিকড় কোথায়। এই উৎসব ও ঐতিহ্য শুধুমাত্র বিনোদন নয়, এটি আমাদের পরিচয়ের অংশ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, বাউল, নগর সংস্কৃতিÑসবকিছু যখন ঘুরে দেখা যায়, তখন একজন মানুষ বুঝতে পারেÑ এই দেশ কেবল তার নয়, এটি বহু মানুষের, বহু কণ্ঠের মিলনস্থল।

প্রাকৃতিক পরিবেশে সবার অধিকার থাকা উচিত

আমরা যখন প্রকৃতির উপকারিতার কথা বলি, তখন একটি বাস্তবতা ভুলে গেলে চলবে নাÑ এই সুবিধা সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে সহজলভ্য নয়। উচ্চ পরিবহন খরচ, সীমিত ভ্রমণ সুবিধা, নিরাপত্তাহীনতাÑ এসব কারণে দেশের একটি বড় অংশ প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে পারে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার ও সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে জনসাধারণের জন্য সুলভ মূল্যে ইকোপার্ক, জলপ্রবাহ কেন্দ্র, ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে কর্মক্ষেত্রে ‘ওয়েলনেস ব্রেক’ বা প্রকৃতিনির্ভর কর্মী পুনর্গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে, যা কর্মজীবী মানুষের জন্য মানসিকভাবে উপকারী হবে।

জীবনের একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

এই ছুটি এবং প্রকৃতির অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায়- জীবন কেবল কাজের, প্রতিযোগিতার নয়; জীবন অনুভবের, সংযোগের এবং প্রশান্তির। আমরা যদি এই অভিজ্ঞতাগুলোর মর্মার্থ বুঝে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রয়োগ করতে পারিÑ ছোট হাঁটা, ছাদের বাগান, নিকটবর্তী নদীতীরে কিছুক্ষণ বসে থাকাÑতবে এই চর্চা আমাদের জীবনের গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে। অর্থাৎ, ছুটি কেবল পালানোর সুযোগ নয়; এটি জীবনের প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার একটি মাধ্যম।

প্রকৃতি ও শান্তির মধ্যে জীবনের সন্ধান

শেষ পর্যন্ত এই উপলব্ধিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে- ছুটি ও ভ্রমণ বিলাসিতা নয়, এটি জীবনের ভারসাম্য রক্ষার অপরিহার্য অংশ। ঈদ, নববর্ষ, বা হঠাৎ পাওয়া একদিনের ছুটিও যদি কেউ প্রকৃতির সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে বা নিজের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে পারে, তবে সেই অল্প সময়ই হয়ে ওঠে জীবনের প্রকৃত উপলব্ধি। কাজের ভিড়ে একটুখানি বিরতি, প্রকৃতির সান্নিধ্যে একটুখানি প্রশান্তি, পরিবার ও আত্মার সঙ্গে একটুখানি সংযোগ- এই ছোট ছোট উপহারগুলোই মানুষকে আবার নতুনভাবে বাঁচতে শেখায়। কারণ জীবনের আসল রূপ দেখা যায় তখনই যখন আমরা প্রকৃতির মাঝে কিছুটা সময় কাটাতে পারি। তখনই জীবন হয় একটু অন্যরকম, একটু গভীর, একটু মানবিক।

লেখক : অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×