ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২

জুলাইয়ের ঐতিহাসিক ৯ দফা নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন ছাত্রশিবির নেতা মুতাসিম বিল্লাহ শাহেদী

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ২৯ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ২০:৪৯, ২৯ জুলাই ২০২৫

জুলাইয়ের ঐতিহাসিক ৯ দফা নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন ছাত্রশিবির নেতা মুতাসিম বিল্লাহ শাহেদী

জুলাই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে দেওয়া ঐতিহাসিক ৯ দফা নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক সম্পাদক মুতাসিম বিল্লাহ শাহেদী। 

তিনি বলেন, ১৯ জুলাই ২০২৪। দিনটি ছিল শুক্রবার। আগেরদিন ১৮ জুলাই সারাদেশে ভয়াবহ ম্যাসাকার হয়েছিল এবং রাতে এশার সময় সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। নিরাপত্তা ইস্যুর কারণে অফলাইন ফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা আমাদের জন্য দেশের কোথায় কী হচ্ছে, জানার ক্ষেত্রে অসুবিধা তৈরি হয়ে যায়। নানান আশঙ্কা মনের মধ্যে দানা বাঁধছিল।  


জুমার নামাজ পড়ে আমি ঢাকা ক্যাম্পাস অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক মাহাদী আল মাহমুদ ভাইয়ের বাসায় যাই। বাসাটি ছিল কাঁঠালবাগানে, আমাদের বাসা থেকে কাছেই। যেহেতু আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এবং ঢাকার প্রায় সকল সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ঢাকা ক্যাম্পাস অঞ্চলের অধীনস্ত, সঙ্গত কারণেই আন্দোলনে মাহাদী ভাইয়ের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে ক্যাম্পাস লাইফে ভাই সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত থাকায় অনেক বিষয়ের আপডেট ভাইয়ের কাছে থাকতো। 


আন্দোলনের প্রথমদিকে আন্দোলন সমন্বয়ের জন্য কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম ভাই একটি বিশেষ কমিটি করে দেন। সে কমিটিতে সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম ভাই, সাহিত্য সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ ভাই, ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক আমিরুল ইসলাম ভাই, ঢাকা ক্যাম্পাস অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক মাহাদী আল মাহমুদ ভাই এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি সাদিক কায়েম ভাই ছিলেন। কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলরা রাজপথের আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বাড়লে শেষদিকে এ কমিটি বড় করা হয়। 


আন্দোলন ইস্যুতে প্রথমদিকে আমি দেশের বাইরের বাংলাদেশি ও বিদেশি ভাইদের সাথে যোগাযোগ করা এবং কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সেক্রেটারি জেনারেলের এসাইন করা কাজগুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সিপি-এসজির সাথে যোগাযোগ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অফলাইন নাম্বার না থাকায় বিশেষ কমিটির কারো সাথেও যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। 


সার্বিক বাস্তবতায় মাহাদী ভাইয়ের বাসায় গেলে দেশের এক্সেক্ট সিচুয়েশন এবং আন্দোলনের ভবিষ্যত পলিসি জানা যাবে, এসব চিন্তা করে জুমার নামাজ পড়ে ভাইয়ের বাসায় যাই। গিয়ে দেখি মাহাদী ভাইয়ের প্রচণ্ড জ্বর এসেছে এবং ভাইয়ের বাসায় সিবগাতুল্লাহ ভাইও আছেন। সিবগাহ ভাই আমাকে দেখে খুশি হলেন। আমরা প্রথমেই অফলাইন নাম্বার বিনিময় করে নিলাম। ভাইদের কাছ থেকে জানলাম যে পুরো ঢাকাজুড়ে তীব্র আন্দোলন চলমান আছে। আমাদের বাসায় ঐদিন হকারের পত্রিকা পাইনি। মাহাদী ভাইয়ের বাসায় অনেকগুলো পত্রিকা একসাথে পেলাম। কিছুক্ষণ এগুলো পড়লাম। মাহাদী ভাই নিজের ওপর রাগ করছিলেন, এরকম গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কেন ওনার জ্বর এলো। 

দুই.
কিছু সময় মাহাদী ভাইয়ের বাসায় থেকে সিবগাহ ভাইয়ের সাথে বের হলাম। নিচে নামলে রেজাউল করিম শাকিল ভাই এসে আমাদেরকে মোটরসাইকেল দিয়ে গেলেন। সিবগাহ ভাইয়ের সাথে আমি বাটা সিগন্যালে একটা অফিসে গেলাম। ওখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ ছিলেন, উনি ল্যাপটপে করে একটা প্রেস রিলিজের ড্রাফট নিয়ে এসেছিলেন। শান্তিপূর্ণ কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিবর্ষণ করে সরকার রক্তপাত শুরু করায় শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে নতুন আঙ্গিকে দাবি উপস্থাপন করা সময়ের চাহিদা ছিল। সকালে সাদিক কায়েম ভাই ওনাকে প্রেস রিলিজ তৈরির দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন। উনি ড্রাফটের কাজ শুরু করে দেন। প্রাথমিক প্ল্যান ছিল মিডিয়া হাউজগুলোতে মুসাদ্দিক আলীর নামে প্রেস রিলিজ যাবে। পরে সাদিক ভাই সহ-সমন্বয়ক মুসাদ্দিককে সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন এবং দুইজনকে একসাথে প্রেস রিলিজ তৈরি করতে বলেন। কিন্তু আব্দুল কাদের যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে মোহাম্মদপুর বা কাঁটাবন এলাকায় আসতে না পারার কারণে মুসাদ্দিক ভাই উনার মোহাম্মদপুরের বাসায় বসে একাই ড্রাফট তৈরি করেন এবং সেটা নিয়ে বাটা সিগন্যালে আসেন। 


সিবগাহ ভাই অফিসে পৌঁছেই ড্রাফট নিয়ে বসে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেক্রেটারি এসএম ফরহাদ ভাই অফিসে পৌঁছলেন। সাদিক ভাই এবং শাকিল ভাই নিচে সংঘর্ষে আটকে গিয়ে আর অফিসে আসতে পারলেন না। আমি সিবগাহ ভাইয়ের কাছে প্রেস রিলিজ কার নামে যাবে জানতে চাইলাম। ভাই আব্দুল কাদেরের কথা বললেন। ব্যক্তি নির্ভরযোগ্য কি না জানতে চাইলে ভাই কনফার্ম করলেন। মূলত সহ-সমন্বয়ক কারো নামে মিডিয়া হাউজে প্রেস রিলিজ যাওয়ার চেয়ে সমন্বয়ক কারো নামে প্রেস রিলিজ গেলে বেটার হবে চিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

তিন.
মুসাদ্দিক ভাইয়ের তৈরি করা প্রেস রিলিজের ড্রাফটে সাতটি দাবি ছিল। দাবিগুলো হচ্ছে :
১। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে পদত্যাগ করে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।
২। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবৈধ উপায়ে ব্যবহার করে ছাত্র হত্যা করার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে।
৩। ঢাকাসহ যত জায়গায় ছাত্র শহীদ হয়েছে সেখানকার পুলিশ কমিশনার, ডিআইজি, পুলিশ সুপারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে। 
৪। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে। 
৫। যে পুলিশ সদস্যরা গুলি করেছে, ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ যে সকল সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের উপর নৃশংস হামলা পরিচালনা করেছে এবং পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে তাদেরকে গ্রেফতার এবং হত্যা মামলা দায়ের করে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে। 
৬। ঢাবি, জাবি, চবি, রাবি সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠনসহ সকল ধরণের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্রসংসদকে কার্যকর করতে হবে।  
৭। জরুরী অধিবেশন ডেকে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে সর্বোচ্চ ৫% কোটা রেখে সংসদে আইন পাস করতে হবে। 

আমাদের আলোচনায় প্রশ্ন উঠলো প্রথমে সরাসরি শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি না করে শুধু ক্ষমা প্রার্থনার দাবি করা ঠিক হবে কি না? ফরহাদ ভাই মত দিলেন— হাসিনা যে গণহত্যা শুরু করেছে, তার পদত্যাগের দাবি না করলে শিক্ষার্থীরা আমাদেরকে ‘হাসিনার দালাল’ বানিয়ে দিবে। সুতরাং পদত্যাগের দাবি থাকতে হবে। সবার সাথে পরামর্শ করে দাবিটি আপডেট করে পদত্যাগের প্রসঙ্গ যুক্ত করা হলো। 


এরপর প্রশ্ন আসলো দ্বিতীয় দাবিতে শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পদত্যাগ দাবি করা সঠিক হচ্ছে কি না? তখন সবাই মিলে পরামর্শ করে এ দফায় প্রথমে ওবায়দুল কাদেরের নাম যুক্ত করা হয়। আরও পরে এখানে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও আনিসুল হককে যুক্ত করে মোট ৪ জনের পদত্যাগের দাবি রাখা হয়। 


৭ নম্বর দফা নিয়ে প্রশ্ন আসলো, খুনি হাসিনা গণহত্যা শুরু করার পর এ পরিস্থিতিতে আর কোটা সংস্কারের দাবি তোলা সঠিক হবে কি না? সিবগাহ ভাই এবং ফরহাদ ভাই মত দিলেন, রক্ত ঝরার পর আন্দোলন আর কোটা সংস্কারে সীমাবদ্ধ নেই। সাধারণ মানুষ মূলত খুনের প্রতিবাদেই রাজপথে নামছে। সুতরাং সরাসরি কোটা সংস্কারের দাবি রাখা আর ঠিক হবে না। বরং সরকার দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিলে এ সংক্রান্ত ফারদার ডিসিশন শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে নেওয়ার অপশন রাখতে ক্যাম্পাসগুলোতে সফর সংক্রান্ত একটি বাক্য প্রেস রিলিজে যুক্ত করার ব্যাপারে আমরা একমত হই। 


ফরহাদ ভাই প্রস্তাবনা দিলেন, যেহেতু সরকার ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ করে দিয়েছে, আর শিক্ষার্থীদের সাথে কানেক্ট হওয়ার জন্য তাদের ক্যাম্পাসে আসতে পারতে হবে, তাই ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া সংক্রান্ত দাবি যুক্ত করা দরকার। তখন সবাই মিলে পরামর্শ করে ”অবিলম্বে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলসমূহ খুলে দিতে হবে” দাবিটি যুক্ত করা হয়।


যেহেতু প্রেস রিলিজ আব্দুল কাদেরের নামে যাবে, ফরহাদ ভাই আব্দুল কাদেরের সাথে ফোনে কথা বলে ওনাকে দাবিগুলো জানাচ্ছিলেন। আব্দুল কাদেরও প্রথম দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। ফরহাদ ভাই ‘হাসিনার দালাল’ হয়ে যাওয়ার কনসার্ন জানালে উনি আমাদের চিন্তার সাথে একমত হলেন। 


ইত্যবসরে পাশের রুম থেকে একজন ভাই এসে জানালেন, একাত্তর টিভির নিউজ রুম থেকে ‍ওনাকে ইনফরমেশন দেওয়া হয়েছে যে, কয়েকজন সমন্বয়ক সরকারের সাথে মিটিং করতে যাচ্ছে এবং সেখানে সরকারের সাথে সমঝোতা হতে পারে— এ নিউজ কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচারিত হবে। সিবগাহ ভাই আমাকে প্রেস রিলিজের ড্রাফট প্রুফ রিড করতে বলে একাত্তর টিভি থেকে প্রাপ্ত সংবাদ বিস্তারিত শুনতে দ্রুত উঠে গেলেন। তাৎক্ষণিক করণীয় হিসেবে চিন্তা করা হলো যে, যারা সরকারের সাথে আলোচনায় বসবে, পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে তাদেরকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে বহিষ্কারের নিউজ হাউজে দেওয়া হবে। এরপর আবার চিন্তা করা হলো, এ বহিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হলে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ভাঙ্গন শুরু করা হবে এবং এত বড় ডিসিশন নেওয়ার আগে বাকি সমন্বয়কদের সাথেও পরামর্শ করা দরকার। আর ইন্টারনেট বন্ধ থাকা ঐ সময়ে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা সকল সমন্বয়কের সাথে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি ছিল না। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, আমরা পাল্টা নিউজ পাঠাবো— সরকার সমন্বয়কদের একটা অংশকে জিম্মি করে মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে সরকারের দেওয়া বক্তব্য তাদেরকে দিতে বাধ্য করছে। এর সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। বক্তব্যটি আব্দুল কাদেরের নামে হাউজে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। যেহেতু পরিস্থিতি ক্রিটিক্যাল ছিল, এ নিউজ দ্রুত প্রচার হওয়া নিশ্চিত করতে সিবগাহ ভাই নিজেই কাজে নেমে পড়লেন। 


আমি, ফরহাদ ভাই এবং মুসাদ্দিক ভাই আবার ড্রাফট নিয়ে বসে পড়লাম। আমরা প্রেস রিলিজের প্রতিটা শব্দ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিলাম। যেন ভুল কোনো বক্তব্য এখানে থেকে না যায়। দাবিগুলো রিভিউ করতে গিয়ে আমার মনে হলো, যারা অলরেডি আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদেরকে নিয়ে এখানে কোনো দাবি না থাকলে দাবিগুলো অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমি এ সংক্রান্ত দাবি যুক্ত করার প্রস্তাবনা দিই। তখন আমরা আলোচনা করে ”দেশব্যাপী যে সকল শিক্ষার্থী ও নাগরিক শহীদ ও আহত হয়েছে তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে”— এ দাবিটি যুক্ত করি। এ দাবি যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে আমাদের মোট দাবি নয় দফা দাবিতে পরিণত হয়। আমরা পুরো প্রেস রিলিজের বক্তব্য, বানান, সেন্স, বাক্যবিন্যাস, সবগুলো দাবির পূর্ণাঙ্গতা নিশ্চিত করা ইত্যাদি সব সম্পাদনা করি। 


ওখানে উপস্থিত থাকাদের মধ্যে শুধু আমারই SutonnyMJ-র টাইপিং জানা ছিল। তাই ল্যাপটপে আমারই বসা লেগেছে। আর আগে থেকে কেন্দ্রীয় সংগঠনের প্রেস রিলিজগুলোর ড্রাফট প্রুফ রিড করার অভ্যস্ততা থাকায় বিষয়টি কঠিন মনে হয়নি। তবে বুঝতে পারছিলাম যে, আমরা একটা ঐতিহাসিক কাজ আঞ্জাম দিচ্ছি। 


আমাদের মধ্যে জোরালো প্রশ্ন উঠলো ”ঢাবি, জাবি, চবি, রাবি সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠনসহ সকল ধরণের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্রসংসদকে কার্যকর করতে হবে”- এ দাবিটি এভাবে রাখবো কি না? সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি করতে গিয়ে একেবারে সকল ধরণের ছাত্ররাজনীতিই নিষিদ্ধের দাবি তোলা ঠিক হবে কি না? 


আলোচনায় একটা কনসার্ন আসলো, যেহেতু আমরা ছাত্রসংগঠন করি এবং আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেকে ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত, তাই সরাসরি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি দেওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে ছাত্রলীগের ওপর শিক্ষার্থীরা এতবেশি বীতশ্রদ্ধ যে ছাত্ররাজনীতি সংক্রান্ত কোনো দাবি এখানে না থাকলে আমাদের দাবিগুলো শিক্ষার্থীদের চিন্তাকে ধারণ করতে পারবে না; ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত সাপোর্টও পাবে না। 


এরপর কনসার্ন আসলো, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি না রেখে শুধু ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করা যায়। কিন্তু এটা করলে আন্দোলনে ছাত্রশিবিরের সংশ্লিষ্টতা আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ হয়ে যাবে। বিশেষত সরকার এটা নিয়ে প্রচণ্ড প্রোপাগাণ্ডা ছড়াবে। এ প্রোপাগাণ্ডা এড়াতে হবে। উল্লেখ্য, ফ্যাসিবাদি আমলে ছাত্রশিবিরকে ডিহিউম্যানাইজ করে ছাত্রশিবিরের জনশক্তিদের ওপর আওয়ামী লীগ সরকার ও তার লাঠিয়াল বাহিনী অকথ্য জুলুম-নির্যাতন চালাতো। সরকারবিরোধী যে কাউকে ছাত্রশিবির তকমা দিয়ে তার ওপর নির্যাতনের বৈধতা উৎপাদন করার অপচেষ্টা করতো। সরকারের রুদ্ররোষে পড়ার ভয়ে সাধারণত কেউ এ নির্যাতনের বিরোধীতা করার সাহস করতেন না। আর সরকারও এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে যেকোনো ন্যায্য আন্দোলনকে ‘শিবিরের আন্দোলন’ বলে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো। তাই সরকারকে এ সুযোগ না দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল।  


আরেকটা চিন্তা আসলো, আমরা ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবির পাশাপাশি লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুললে বিষয়টা সফট হবে। যেহেতু ছাত্রসংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে মূল সংগঠনের লাঠিয়াল না হওয়ার মধ্যেই কল্যাণ এবং একেবারে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথাও বলা হবে না, সুতরাং এর মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির ছাত্রলীগিয় ভার্সনে সংস্কার আসবে এবং ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংগঠনগুলোও সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতি করতে পারবে। তাছাড়া ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠার দাবিতো থাকছেই; আর এটাই হচ্ছে ছাত্ররাজনীতির প্রাণ। 


এছাড়া কনসার্ন এলো, আমরাতো দাবিগুলো ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে দিচ্ছি না। এগুলো যাবে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর নামে। সুতরাং, আমরা শুধুমাত্র ছাত্রশিবিরের পার্সপেক্টিভ থেকে চিন্তা না করে পুরো ছাত্রসমাজের কমন অপিনিয়নকে ধারণ করার মতো দাবি দেওয়াই ভালো। 
আরও কনসার্ন এলো, আমরাতো প্রেস রিলিজে বলে দিচ্ছি, সরকার আমাদের দাবিগুলো মেনে নিলে আমরা ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে মতবিনিময় করে সিদ্ধান্ত নিবো যে, আমরা সরকারের সাথে সংলাপে বসবো নাকি বসবো না, সুতরাং ছাত্ররাজনীতি কীভাবে চলবে এবং বাকি বিষয়গুলো নিয়েও আমরা কীভাবে এগুবো, এটা নিয়েও তখন শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করা যাবে। 


সবমিলিয়ে প্রধাণত আন্দোলনে ছাত্রশিবিরের সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ না হওয়া নিশ্চিত করতে আমরা দাবিটি “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠনসহ সকল দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্রসংসদকে কার্যকর করতে হবে”— এভাবে আপডেট করার বিষয়ে একমত হই। এর চেয়ে বেটার কোনো অপশন ঐসময় আমাদের মাথায় আসেনি। 


আমরা যখন প্রেস রিলিজ নিয়ে কাজ করছিলাম, তখন নিচের রাস্তায় (বাটা সিগন্যাল থেকে হাতিরপুলের রাস্তায়) পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের তীব্র সংঘর্ষ চলছে। কিছুক্ষণ পরপর হেলিকপ্টার এসে নিচের দিকে গুলি করছিল। যখন হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনছিলাম কিংবা গোলাগুলির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছিলো, তখন আমরা জানালায় ছুটে যাচ্ছিলাম আবার টেবিলে এসে বসছিলাম। খুব উত্তেজিত সময় কাটছিল আমাদের। 


মাহাদী ভাই ফোনে বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন, ৫টার মধ্যে মিডিয়া হাউজগুলোতে প্রেস রিলিজ পৌঁছাতে হবে। নাহয় কাভারেজ পাওয়া যাবে না। এদিকে প্রেস রিলিজ নির্ভরযোগ্য হওয়ার জন্য সাংবাদিকরা কল দিয়ে যাচাই করার সুবিধার্থে প্রেস রিলিজের নিচে আব্দুল কাদেরের কন্টাক্ট নাম্বার দেওয়া দরকার। আব্দুল কাদের তখনো বাসার বাইরে ছিলেন। ফরহাদ ভাই ওনাকে ফোনে বারবার তাড়া দিচ্ছিলেন দ্রুত বাসায় পৌঁছে একটা নাম্বার দেওয়ার জন্য। ফোনের কথা থেকে আব্দুল কাদের বেশ জোরে হাঁটছিলেন বুঝা যাচ্ছিলো। 
একপর্যায়ে আব্দুল কাদের বললেন যে, উনি যে বাসায় যাচ্ছেন, ওখানে পৌঁছতে আরও আধা ঘন্টার মতো সময় লেগে যাবে। তাই যে নাম্বারে কথা হচ্ছে, এ নাম্বারটিই দিয়ে দেওয়া যায়। 


ফরহাদ ভাই বললেন, এ নাম্বারে তোমার সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। সুতরাং, এ নাম্বার দেওয়া হলে আমাদের সাথে তোমার সংশ্লিষ্টতা প্রশাসন খুব সহজেই বের করে ফেলবে। তাই একটু সময় লাগলেও তুমি বাসায় পৌঁছে একটা ফ্রেশ নাম্বার দাও। 


আমরা নাম্বার পাওয়ার জন্য একটু সময় নিলাম। ফোনে কথা বলার সময় মিডিয়া হাউজে প্রেস রিলিজ পৌঁছে দেওয়ার পর আব্দুল কাদের যেন কিছু সময় বাসার বাইরে অবস্থান করে সাংবাদিকদেরকে দাবির ব্যাপারে ব্রিফ করেন, এ ব্যাপারে ফরহাদ ভাই ওনাকে বলে দেন। 


এর মধ্যে কয়েকজন সমন্বয়কের সরকারের সাথে বসা ইস্যুতে আমাদের বক্তব্য মিডিয়ায় প্রচার হয়ে গেছে এবং সিবগাহ ভাই আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন। ভাইকে আমরা ছাত্ররাজনীতি সংক্রান্ত ধারাটি নিয়ে বিশেষভাবে ভাবার পরামর্শ দিলাম। ভাই ভেবে আমাদের আপডেটকৃত ভার্সনের সাথেই একমত হলেন। তবে ভাই প্রুফরিডিং দ্রুত শেষ করার তাগাদা দিলেন। 


এর মধ্যে মিটিংয়ে অপিনিয়ন উঠলো নয় দফা দাবির প্রথম দফাটি শেখ হাসিনার পদত্যাগ সংক্রান্ত হলে বাকি দাবিগুলো দুর্বল হয়ে যাবে এবং এটা মূলত এক দফা দাবি হয়ে যাবে। তাই আন্দোলনটি ধীরে ধীরে এক দফায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রথমেই পদত্যাগের দাবি না দিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনার দাবি দেওয়াই যৌক্তিক হয়। তবে হাসিনা যেরকম ভয়াবহ গণহত্যা শুরু করেছে, শুধুমাত্র ক্ষমাপ্রার্থনার মাধ্যমে হাসিনা পার পেয়ে যাওয়া যৌক্তিক হবে না, এটা আমরা খুব অনুভব করছিলাম এবং এ আন্দোলনের মাধ্যমে হাসিনার পতন ঘটানো আমাদের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাই নয় দফা মেনে নেওয়া হাসিনার জন্য কঠিন করে রাখার ব্যাপারে আমরা সিরিয়াস ছিলাম। শেষ পর্যন্ত বাকি দাবিগুলোসহ চিন্তা করে আমরা প্রথম দাবিটি শুরুতে যেরকম ছিলো, সেরকমই পুনস্থাপন করলাম— “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে”। অভারফোনে ফরহাদ ভাই আব্দুল কাদেরকে দাবি আপডেটের বিষয়ে জানালেন। দাবিগুলো সাংবাদিকদের জানানোর সুবিধার্থে ওনাকে দাবিগুলো টুকে রাখতে বললেন। এর মধ্যে কিছু বিষয় নিয়ে ফরহাদ ভাই ফোনে সাদিক ভাইয়ের সাথেও পরামর্শ করেন।


ইত্যবসরে আসরের নামাজের সময় হয়ে যায় এবং নিচে হওয়া সংঘর্ষ আরও বেড়ে যায়। কিন্তু প্রেস রিলিজের সম্পাদনা সংক্রান্ত আমাদের কাজ তখনো শেষ হয়নি। আবার যে অফিসে আমরা ছিলাম, ওখানকার প্রিন্টার কাজ করছিল না। তখন সিদ্ধান্ত হয়, আমরা দ্রুত কাজ শেষ করে বের হয়ে যাবো আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় গিয়ে প্রিন্ট দেওয়া যাবে। সিবগাহ ভাইয়েরা নামাজে দাঁড়িয়ে যান। 
আমি আর ফরহাদ ভাই প্রেস রিলিজের প্রুফরিডিং শেষ করি। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় আমাদের হাতের কাছে “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন”-এর অফিসিয়াল প্যাডের সফটকপি ছিল না। তখন আগের প্রেস রিলিজের ছবি দেখে আমরা একটা নতুন প্যাড তৈরি করি। 


এরপর অসুবিধা দেখা দেয় প্রেস রিলিজ এক পৃষ্ঠার চেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছিলো। তখন ফরহাদ ভাই ‘Legal’ পেইজে সেইভের অপশন বের করেন। A4 সাইজ থেকে ‘Legal’ সাইজে নিয়ে যাওয়ার পর লেখাগুলো এক পৃষ্ঠায় আটলো। সবমিলিয়ে আমাদের প্রেস রিলিজ ফাইনাল করার কাজ শেষ হয়। 


প্রথম জামায়াত শেষে আমাদের কাছ থেকে ফাইনাল ফাইল নিয়ে মুসাদ্দিক ভাইকে সাথে করে সিবগাহ ভাই অফিস থেকে বের হয়ে যান। এরপর আমি আর ফরহাদ ভাই দ্বিতীয় জামায়াতে নামাজ পড়ি। নামাজ শেষে ফরহাদ ভাই লম্বা সিজদাহ দিয়ে দু’আ করছিলেন। আমি বিষয়টাতে খুবই চমৎকৃত হই। 


এরপর আমরা অফিস থেকে নামলাম। কিন্তু নেমে আমরাও সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যাই আর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। সিবগাহ ভাইয়েরা ঢাবির বাসার দিকে গিয়েছিলেন। ওখানে ৫ কপি পেইজ প্রিন্ট দেওয়ার পর আর প্রিন্ট দেওয়া যাচ্ছিলো না। পরে বাংলামোটরের একটা অফিস থেকে আরও কিছু কপি প্রিন্ট করে সিবগাহ ভাইয়েরা মাহাদী ভাইয়ের কাঁঠালবাগানস্থ বাসায় যান। সাদিক ভাই কয়েকজন সাংবাদিককে বলে রেখেছিলেন। যদিও ৫টা পার হয়ে যায়, এরপরও ভাইয়েরা প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে নয় দফা দাবি সংবলিত প্রেস রিলিজটি মিডিয়া হাউজগুলোতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। ওদিকে আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত বাটা সিগন্যাল ও কাঁটাবন এলাকায় রাজপথে থেকে বাসায় ফিরি। 

সম্পাদনাকৃত প্রেস রিলিজে নয় দফা দাবি নিম্নোক্তভাবে ছিল:
১। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। (পরে এখান থেকে ’মাননীয়’ শব্দ বাদ দিয়ে দেওয়া হয়)
২। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রীপরিষদ এবং দল থেকে পদত্যাগ করতে হবে। (পরে এখানে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নাম যুক্ত করা হয়)
৩। ঢাকাসহ যত জায়গায় শহিদ হয়েছে সেখানকার ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে। 
৪। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টরদের পদত্যাগ করতে হবে।
৫। যে পুলিশ সদস্যরা শিক্ষার্থীদের উপর গুলি করেছে, ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ যে সকল সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের উপর নৃশংস হামলা পরিচালনা করেছে এবং পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে তাদেরকে আটক করে এবং হত্যা মামলা দায়ের করে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার দেখাতে হবে। 
৬। দেশব্যাপী যে সকল শিক্ষার্থী ও নাগরিক শহিদ ও আহত হয়েছে তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে । 
৭। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠনসহ সকল দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্রসংসদকে কার্যকর করতে হবে।  
৮। অবিলম্বে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলসমূহ খুলে দিতে হবে।
৯। কোটা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কোনো ধরনের হয়রানি করা হবে না মর্মে নিশ্চয়তা দিতে হবে।

চার. 
২০ জুলাই ২০২৪, শনিবার।
পত্রিকাগুলোতে নয় দফা আসার পর কিছু মিডিয়া হাউজ থেকে কথা আসে যে, প্রেস রিলিজটিতো ভুয়াও হতে পারে। কারণ প্রেস রিলিজে কারো স্বাক্ষর নেই। ফোনে কে কথা বলছে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। সব মিলিয়ে আব্দুর কাদেরের একটি ভিডিও বক্তব্য খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। 


তখন সিবগাতুল্লাহ ভাই নারায়নগঞ্জ মহানগর সভাপতি আসাদুজ্জামান রাকিব ভাইকে এ বিষয়ে সহযোগিতার জন্য নক দেন। রাকিব ভাই মহানগর অফিস সম্পাদক অমিত হাসান ভাইকে এসাইন করে দেন। অমিত ভাই সিবগাহ ভাইয়ের নির্দেশনার আলোকে দুপুরের দিকে কাজলায় আব্দুল কাদেরের কাছে পৌঁছেন। আব্দুল কাদের দাবিগুলো ভিডিও করে এনেছিলেন। তবে ভিডিওগুলো একাধিকবারে ধারণকৃত হওয়ায় এগুলো একত্র করে মেমোরি কার্ডের মাধ্যমে অমিত ভাইকে হস্তান্তর করেন। 


তখন প্রচণ্ড সংঘর্ষের কারণে যাত্রাবাড়ী এলাকা হয়ে বাংলামোটর আসার মতো পরিস্থিতি ছিলো না। অমিত ভাই এবং সিদ্ধিরগঞ্জ পশ্চিম থানা সভাপতি জাহিদ ভাই কোনাপাড়া-মানিকদিয়া-বৌদ্ধমন্দির-খিলগাঁও হয়ে বাংলামোটর পৌঁছে মেমোরি কার্ড দিয়ে যান। কিন্তু মেমোরি কার্ডের ভিডিওটি একাধিক ভিডিও একসাথ করে প্রস্তুত করার কারণে বক্তব্যে স্বাভাবিক ফ্লো ছিল না। তাই এটি মিডিয়া হাউজগুলোতে দেওয়া যায়নি। 
ওদিকে আব্দুল কাদের কাজলা এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় ছিলেন। ওখানে দীর্ঘসময় থাকা অনিরাপদ হওয়ায় সিবগাহ ভাইয়ের নির্দেশনার আলোকে অমিত ভাই আব্দুল কাদেরকে নিরাপদ জায়গা হিসেবে ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল শিহাব ভাইয়ের বাসায় পৌঁছে দেন। শিহাব ভাইয়ের বাসা মাতুয়াইল এলাকায় ছিল। 

পাঁচ. 
২১ জুলাই ২০২৪, রবিবার। 
দুপুরের পর আমি মাহাদী ভাইয়ের বাসায় যাই। গিয়ে দেখি সিবগাতুল্লাহ ভাই, মাহাদী ভাই আর সাদিক ভাই কাজ করছেন। মাহাদী ভাইয়ের জ্বর একটু কমেছে। সরকারের তরফে কয়েকজন সমন্বয়কের নামে আট দফা দাবির প্রসঙ্গ সামনে আসায় নয় দফা দাবি ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়ে। ভাইয়েরা দাবিগুলো মিডিয়া হাউজগুলোতে মেসেজ করে পাঠাচ্ছিলেন। 


আমি সিবগাতুল্লাহ ভাইয়ের সাথে বের হলাম। হাঁটতে হাঁটতে সিবগাহ ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন— শাহেদী ভাই, হাসিনার কি পতন হবে?  আমি উত্তর দিলাম, মূল রাজনৈতিক দলগুলো ভালোভাবে এনগেজড হলে পতন হবে, নাহয় কঠিন হবে। ভাই বললেন— আমার বিশ্বাস অবশ্যই হাসিনার পতন হবে। 
ভাই চিন্তিত ছিলেন আব্দুল কাদেরের নিরাপত্তা নিয়ে। কারণ ইতোমধ্যে আব্দুল কাদের প্রচণ্ড নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছেন আর ভিডিও বক্তব্যও প্রচার হয়ে গেলে উনি সরকারের মোস্ট ওয়ান্টেড পার্সনে পরিণত হবেন। উনাকে কয়েকটি বাসায় রাখার বিষয়ে ভাই পরামর্শ করলেন। কথা বলতে বলতে আমরা বাংলামোটর মোড়ে এসে পৌঁছলাম। এখানে অমিত হাসান ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। 


গতদিনের ভিডিও ভালো না হওয়ায় শিহাব ভাইয়ের বাসায় এদিন দুপুরে নতুন করে আবার ভিডিও ধারণ করা হয়। ক্যামেরাম্যান ছিলেন নারায়নগঞ্জ মহানগরের সাহিত্য সম্পাদক রায়হান ভাই। এবারের ভিডিওটি তুলনামূলকভাবে ভালো হয়। ভিডিও ধারণ শেষে অমিত ভাই পেনড্রাইভে করে ভিডিও নিয়ে এসেছিলেন। 
আমরা পেনড্রাইভ রিসিভ করে বাসায় যাই। বাসার ল্যাপটপে ফাইল ট্রান্সফার করে ভিডিও ঠিক আছে কি না, চেক করা হয়। এরপর আমি পেনড্রাইভ নিয়ে আবার বাংলামোটর মোড়ে আসি। এখানে অমিত ভাইয়ের কাছ থেকে যাত্রাবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জের আপডেট অবস্থা জানি। তখন বাংলামোটর মোড়ে সময় টিভির সাংবাদিকরা নিজেদের চ্যানেলের নাম সম্বলিত চিহ্নগুলো লুকিয়ে নিউজ কাভার করা নিয়ে কাজ করছিলেন। 


অমিত ভাইয়ের সাথে আলাপ শেষে বাসায় পৌঁছে দেখি, নতুন কেনা সিমকার্ডগুলো থেকে বড় মেসেজ যাচ্ছে না। তবে পুরাতন সিমকার্ড দিয়ে বড় মেসেজ যাচ্ছে। এ অবস্থায় ৫টার মধ্যে হাউজগুলোতে মেসেজ পাঠানো নিশ্চিত করতে মাহাদী ভাই এবং সাদিক ভাই দুইজনই ওনাদের নিজেদের ফোনের সিমকার্ডগুলো ব্যবহার করে ফেলেন। 


মাগরিবের পর সিবগাহ ভাই, শাকিল ভাই এবং আমি আশেপাশের এলাকার আপডেট অবস্থা দেখতে মহানগর উত্তর ছাত্রশিবিরের বাইকে বের হয়ে পড়ি। ওদিকে অমিত ভাই আব্দুল কাদেরকে শিহাব ভাইয়ের বাসা থেকে বনশ্রীতে আহমেদ আফগানী ভাইয়ের বাসায় পৌঁছে দেন। আর লোকেশন ডিটেক্ট হওয়া থেকে রক্ষা পেতে আব্দুল কাদেরের ফোনগুলো রাকিব ভাইয়ের দায়িত্বে রেখে দেওয়া হয়। 

ছয়.
২২ জুলাই ২০২৪, সোমবার। 
সকালবেলা সিবগাতুল্লাহ ভাই আমাকে কল করে বললেন যে, আজকে আমাদের বাসায় বসতে চান। আমি কনফার্ম করি। 


আসলে গত দু’দিন (২০ ও ২১ জুলাই) মাহাদী ভাইয়েরা কাঁঠালবাগানের বাসায় থেকে প্রেস রিলিজ পাঠানো; বিশেষ করে আগের দিন মাহাদী ভাই ও সাদিক ভাই ঐ বাসায় থাকা অবস্থায় মেসেজ পাঠানোর জন্য নিজেদের সিমকার্ড ব্যবহার করে ফেলার কারণে অবস্থান করা কিংবা মিটিং করার জন্য বাসাটি অনিরাপদ হয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে বাসার দারোয়ান আশেপাশে অপরিচিত লোকজনের ঘোরাঘুরির তথ্যও দিয়েছেন। সবমিলিয়ে বাসাটি আর ব্যবহার করা যাচ্ছিলো না। 


দুপুরের পর ভাইয়েরা বাংলামোটরস্থ (এক্সেক্ট লোকেশন নিউ ইস্কাটন) আমাদের বাসায় এলেন। ঘটনাচক্রে আমাদের বাসা এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে একেবারে আমার রুমটিই কর্মসূচি প্রণয়নের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ইন্টারনেট শাটডাউন থাকা বাকি দিনগুলোতে প্রতিদিন দুপুরের পর সিবগাহ ভাই, মাহাদী ভাই, সাদিক ভাই, মুসাদ্দিক ভাই এবং শাকিল ভাই আমার রুমে আসতেন। এসে পরবর্তী দিনের কর্মসূচি ঠিক করতেন। আমার দিক থেকে কোনো পরামর্শ থাকলে আমি দেওয়ার চেষ্টা করতাম। এ বাসায় হোসাইন আহমেদ জুবায়ের ভাইও থাকতেন। কোনো বিষয়ে ভাইয়ের পরামর্শ থাকলে ভাই শেয়ার করতেন। আমরা প্রতিদিনের প্রেস রিলিজে নয় দফা যুক্ত করে দিতাম। এ দিনগুলোতে সাধারণত ফজর ও এশার পর সিপি-এসজির সাথে আমাদের যোগাযোগ হতো। ভাইয়েরা এ সময়ে কর্মসূচি এবং সারাদেশের আন্দোলন সমন্বয়ের ইস্যুতে নির্দেশনা দিতেন। ভাইদের নির্দেশনাগুলো ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত উর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের নির্দেশনার আলোকে এসময় লাখো জনশক্তি ময়দানে মুভ করেছেন। পরিস্থিতির প্রয়োজনে ২৩ তারিখ সিপি বিশেষ কমিটিকে আন্দোলন ইস্যুতে প্রয়োজনীয় যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়ে দেন। 


এসময় মাহাদী ভাই আমাদের বাসায় থাকতেন। আর মুসাদ্দিককে কেন্দ্রীয় বিতর্ক বিভাগের বাসায় রাখা হয়। মাঝে আব্দুল কাদেরের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আব্দুল হান্নান মাসউদের নামেও প্রেস রিলিজ পাঠানো শুরু হয়। ধানমন্ডিতে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে এককভাবে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে উনি অনশনের হুমকি দিয়েছিলেন। উনার এ সাহসিকতার ঘটনা প্রেস রিলিজ ওনার নামে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে আমাদেরকে হেল্প করে।


এ সময় সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম ভাই নয় দফায় অনেকগুলো কারেকশন দিয়েছিলেন। ভাই কারেকশন দেওয়ার পর নয় দফা নিম্নরূপ হয়:
১। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। 
২। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় ক্যাডার এবং সন্ত্রাসী কর্তৃক ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল,  আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। ইন্টারনেট শাটডাউন করে দেশে ডিজিটাল ক্র্যাকডাউন করায় তথ্য প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলককে পদত্যাগ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শহীদ শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে ড্রাগ এডিক্ট বলে কুরুচিপূর্ণ ও মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে এবং আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করায় তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতকে পদত্যাগ করতে হবে। 
৩। ঢাকাসহ যত জায়গায় ছাত্র-নাগরিক শহীদ হয়েছে সেখানকার ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে। 
৪। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ক্যাম্পাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা হয়েছে, প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং প্রক্টরদেরকে পদত্যাগ করতে হবে। 
৫। যে পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাব ও সেনা সদস্যরা শিক্ষার্থীদের উপর গুলি করেছে, ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ যে সকল সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের উপর নৃশংস হামলা পরিচালনা করেছে এবং যেসকল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদেরকে নিরস্ত্র ছাত্র-নাগরিকদের উপর গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে তাদেরকে আটক করে হত্যা মামলা দায়ের করতে হবে ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে। 
৬। দেশব্যাপী যেসকল ছাত্র-নাগরিক শহীদ এবং আহত হয়েছে তাদের পরিবারকে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে । 
৭। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দ্রুততম সময়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ছাত্রসংসদ কার্যকর করতে হবে।  
৮। অবিলম্বে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলসমূহ খুলে দিতে হবে। কারফিউ তুলে নিয়ে সারাদেশের সমস্ত ক্যাম্পাসে মোতায়েনকৃত পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, সোয়াট এবং আর্মি তুলে নিতে হবে। 
৯। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কোনো ধরনের হয়রানি করা হবে না এই মর্মে অঙ্গীকার করতে হবে। ইতিমধ্যে গণগ্রেফতার ও পুলিশি হয়রানির শিকার সমন্বয়কবৃন্দ ও ছাত্র-নাগরিকদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে ও সকল মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। 

সাত.
ইন্টারনেট ক্র‌্যাকডাউনের সময় কর্মসূচি নির্ধারণ হওয়ার পর প্রতিদিন বিভিন্নজন বিভিন্ন দিকে গিয়ে মেসেজের মাধ্যমে প্রেস রিলিজ মিডিয়া হাউজগুলোতে পাঠাতে হতো। কখনো হাতিরঝিলে গিয়ে, কখনো ধানমন্ডি লেকে গিয়ে, কখনো মোটরসাইকেলের পেছনে বসে চলন্ত অবস্থায় ইত্যাদি নানা উপায়ে দাবিগুলো মেসেজ করা হতো। আবার সাংগঠনিক চ্যানেলে শাখাগুলোকে কর্মসূচির সংবাদ জানানো হতো। 


এসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি আব্দুল মুহাইমিন ভাইসহ কয়েকজন রাজশাহীর সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় নেটওয়ার্ক কাজ করার সংবাদ পান। উনারা এ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে দেশের বাইরের ভাইদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। সেখানে কেন্দ্র থেকেও একটি টিম পাঠানো হয়। আমরা ঢাকায় গৃহীত সিদ্ধান্ত ওনাদের জানালে ওনারা দেশের বাইরের ভাইদের তা জানিয়ে দিতেন। আবার দেশের বাইরের ভাইদেরকে তাঁদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাব কিংবা ছড়িয়ে পড়া নানা গুজবের ব্যাপারেও আমরা ভারতীয় নেটওয়ার্কের আওতায় অবস্থান করা ভাইদের মাধ্যমে ক্লিয়ার করতাম। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঐসময় দেশের বাইরে আন্দোলনসংক্রান্ত তৎপরতার সাথে সমন্বয়সাধন সম্ভব হয়। 


প্রতিদিন সকালে ওমর ফারুক ভাই বাংলামোটর মোড় থেকে সবগুলো পত্রিকা এক কপি করে বাসায় নিয়ে আসতেন। আমরা পত্রিকাগুলো স্টাডি করে হাউজগুলো কর্মসূচির সংবাদ কতটুকু কাভার করেছে, তা দেখতাম। ইন্টারনেটবিহীন পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার এ সময়ে আমাদের নির্ধারণ করা কর্মসূচি বিভিন্ন স্থানে পালন হওয়ার সংবাদ দেখে আমরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তাম। খুবই আবেগ-উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তাপূর্ণ দিন ছিলো সেগুলো। তবে আমরা ইতিবাচক পরিবর্তনের আশায় আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করেছিলাম। 


আলহামদুলিল্লাহ। জুলাইয়ের নয় দফা দাবি বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। রাজপথে মানুষের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণে সময়ের ব্যবধানে এখান থেকেই এক দফার সূচনা হয় এবং ফাইনালি ৩৬ জুলাই নির্মম নিষ্ঠুর লেডি হিটলারের পতন হয়। 

বি. দ্র. জুলাই ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের সময় আমরা যে কাজগুলো করেছি, এগুলো নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করেছি। আমরা আমাদের সামর্থ্যের আলোকে চেষ্টা করেছিলাম। ঐ সময় দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের আপামর মানুষ রাজপথে নেমে এসে গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। জাতিগতভাবে আমাদের এ ডেডিকেশনকে আল্লাহ কবুল করেছিলেন বলেই বিজয় এসেছে। যেহেতু এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের বহুল কাঙ্ক্ষিত বিজয় পেয়েছেন, সঙ্গত কারণেই এ আন্দোলনের পর্দার আড়ালের গল্পগুলোও মানুষের কাছে উম্মুক্ত থাকা প্রয়োজন। নয় দফা নিয়ে আমি যতটুকু জানি, জনপরিসরে তা জানিয়ে রাখার দায়বোধ থেকে ওপরের লেখাটি লিখেছি। আমরা প্রত্যেকে স্ব স্ব পার্সপেক্টিভ থেকে আন্দোলনকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সবাই নিজের দেখা বিষয়গুলো নির্মোহভাবে প্রকাশ করতে পারলে জুলাই ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের পূর্ণাঙ্গ ঘটনা সবার জানার সুযোগ হবে, ইনশাআল্লাহ। লম্বা লেখাটি যারা পড়েছেন, সবার প্রতি শুকরিয়া জানাচ্ছি।

 
 

রিফাত

×