
.
তিন মাসের শুল্কবিরতি প্রায় শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে সোমবার বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। শুল্ক আরোপের এ বিষয়টি জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে ব্যবসায়ী বিশেষ করে রপ্তানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। তারা বলছেন, বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের একক সিদ্ধান্তে আরোপিত এক চরম অর্থনৈতিক ধাক্কা। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। এর ফলে আগে যেখানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো, সেখানে এখন দ্বিগুণেরও বেশি দিতে হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে। তাই শুল্ক কমাতে বাংলাদেশ সরকারের জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
তবে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক চূড়ান্ত না বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, ওয়ান টু ওয়ান নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এটা ঠিক হবে। এ লক্ষ্যে বুধবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের বৈঠক হবে। কমানোর আশায় উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শুল্ক নিয়ে আলোচনার জন্য ইতোমধ্যে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হয়ে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সময় অনুযায়ী ৮ তারিখ ও বাংলাদেশ সময় ৯ তারিখ সকালে পরবর্তী বৈঠক হবে। বাণিজ্য সচিব ওই বৈঠকে অংশ নেবেন। যাওয়ার আগে তিনি বলেছেন, বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হবে স্বার্থ সংরক্ষণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিদ্যমান বাণিজ্যকে রক্ষা করা।
বাংলাদেশের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ ॥ জানা যায়, তিন মাস ধরে চলা আলোচনার পর বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সোমবার নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক ঘোষণায় তিনি এ তথ্য জানান। এছাড়া চূড়ান্ত শুল্কের পরিমাণ উল্লেখ করে বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের নেতাদের উদ্দেশে সোমবার চিঠি পাঠান ট্রাম্প।
গত ৩ এপ্রিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন ট্রাম্প। সে সময় বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর আগে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হতো।
সোমবারের ঘোষণায় বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানসহ মোট ১৪টি দেশের ওপর নতুন শুল্কহার নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। হোয়াইট হাউসের ঘোষিত ৯০ দিনের শুল্ক বিরতির সময়সীমা শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। শুরুতে এই শুল্ক ৯ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে ১ আগস্ট থেকে কার্যকর করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশসহ ১৪ দেশের শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও বাণিজ্যযুদ্ধ উস্কে দিয়েছেন। সোমবার (৭ জুলাই) তিনি এক ডজনের বেশি দেশের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। তবে একইসঙ্গে ট্রাম্প জানিয়েছেন, বাংলাদেশসহ ১৪ দেশে নতুন শুল্কের সময়সীমা ‘শতভাগ চূড়ান্ত নয়’। আগস্টের মধ্যে চুক্তিতে পৌঁছানোর যে নতুন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা তিনি কিছুটা নমনীয়ভাবে বিবেচনা করতে পারেন।
তবে আগের মতো এবারও শুল্ক আরোপ নিয়ে দেশগুলোর সঙ্গে দর কষাকষির সুযোগ রাখলেন ট্রাম্প। তবে এরই মধ্যে তার এ ঘোষণায় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই শুল্ক আরোপের মধ্যদিয়ে ট্রাম্প মূলত বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধ আরও উস্কে দিয়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর নতুন করে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমার ও লাওসের ওপর ৪০ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ৩০ শতাংশ, মালয়েশিয়া ও তিউনিসিয়া ২৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ৩২ শতাংশ, বসনিয়া ৩০ শতাংশ, সার্বিয়া ৩৫ শতাংশ, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডে ৩৬ শতাংশ এবং কাজাখস্তানের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
৩৫ শতাংশ শুল্ক চূড়ান্ত নয় ॥ বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক চূড়ান্ত না বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, ওয়ান টু ওয়ান নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এটা ঠিক হবে। এ লক্ষ্যে আগামীকাল (বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী বুধবার) ভোরে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের বৈঠক হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিয়ে সাংবাদিকদের করা এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ওখানে আমাদের বাণিজ্য উপদেষ্টা আছেন। উনি ৩ দিন আগে গেছেন। আজকেই কমার্স টিম যাচ্ছে। ৮ তারিখে মিটিং। ওদের ৮ তারিখ মানে কালকে খুব ভোরবেলা। মিটিংয়ের পর আমরা বুঝতে পারব। কারণ, যেটা দিয়েছে, সেটা ঠিক অফিসিয়াল। ইউএসটিআরের সঙ্গে যখন আলাপ করবেন উনি (বাণিজ্য উপদেষ্টা) ম্যান্ডেটরি। এর আগের দিন কথা বলেছেন। কালকের পর আপনারা বুঝতে পারবেন।
মিটিংয়ে কি কোনো উন্নতি হওয়ার আশা করা যায়? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সালেহউদ্দিন বলেন, আমরা আশা করি। যাই হোক, সেটার পরিপ্রেক্ষিতে অন্য পদক্ষেপগুলো নেব। এখন বৈঠকটা মোটামুটি পজিটিভ। ৬ তারিখ বোধহয় একটা মিটিং হয়েছে, মোটামুটি পজিটিভ।
ভিয়েতনাম চেষ্টা করে ২৬ শতাংশ কমিয়েছে, বাংলাদেশের কেন মাত্র ২ শতাংশ কমানো হলো। তার মানে কি নেগোসিয়েশন ভালো হয়নি? সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্ন করা হলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘না, না নেগোসিয়েশন। এটা ঠিক যে আমাদের ডেফিসিট মাত্র পাঁচ বিলিয়ন ডলার। ভিয়েতনামের ১২৫ বিলিয়ন ডলার। ওখানে কিন্তু ওরা কনসেশন দিতে পারে, মানে রাজি হয়েছে। কিন্তু আমাদের এত কম ডেফিসিট। আমরা চেষ্টা করছি যে, আমাদের এত কম ডেফিসিট, এত শুল্ক দেওয়ার তো জাস্টিফিকেশন থাকে না।’
আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ॥ যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর আশায় উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান মঙ্গলবার বলেছেন, আমরা একটি সংশোধিত খসড়া পেয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তর (ইউএসটিআর) থেকে, যা পর্যালোচনার পর্যায়ে রয়েছে। শুল্কহার কমানোর বিষয়ে আমরা আশাবাদী। বাণিজ্য সচিব জানান, বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন এবং মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করছেন।
সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বাণিজ্য সচিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক কমানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে সরকারিখাতে খাদ্যশস্য কেনায় যুক্তরাষ্ট্রকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে উড়োজাহাজ এবং সামরিক সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। মোট কথা, বাংলাদেশের প্রধান বিবেচ্য বাণিজ্য স্বার্থ সংরক্ষণ করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের যে বিদ্যমান বাণিজ্য আছে সেটি রক্ষা করা।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নতুন ডকুমেন্টসে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সামরিক সরঞ্জাম, বোয়িং, এলএনজি, গমসহ কৃষিপণ্য ও তুলা আমদানি আরও সহজ করার কথা বলেছে। আমরা ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, তুলা ও এলএনজি আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগও আছে।’
বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘চুক্তি স্বক্ষর নিয়ে আলোচনা চলাকালে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে আমাদের চিঠি দেওয়া হতাশাজনক।’
বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘৮ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে ট্যারিফ সিডিউল ডকুমেন্ট পাঠিয়েছে। এটা আমরা আগেই চেয়েছিলাম। এই নথির ওপরই মূলত আলোচনা হবে আগামী মিটিংয়ে। এই ট্যারিফ সিডিউল আগের এগ্রিমেন্টের একটা এক্সটেনশন বলতে পারেন। আলোচনার দরজা যেহেতু খোলা আছে, কাজেই কিছু একটা আউটকাম তো আমরা আশা করি।’
মার্কিন শুল্কে ‘ঝুঁকির শঙ্কা’ ॥ বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্ক আরোপে বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে। শুল্ক কমাতে বাংলাদেশ সরকারের জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, এই শুল্কহার থাকলে বাংলাদেশের বহু পোশাকশ্রমিকের চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য। তার কথায়, বাংলাদেশকে এখনই মার্কিন আমদানিকারকদের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ, উচ্চ পর্যায়ের বাণিজ্য আলোচনা ফের শুরু এবং বাংলাদেশি পণ্যের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)-এর সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানি বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বাজারে দেশের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ পণ্য পাঠানো হয়। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সুবিধা না থাকায় ইতোমধ্যেই মার্কিন বাজারে বাংলাদেশ কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে রয়েছে। নতুন এই শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশের পণ্যগুলো আরও বেশি অপ্রতিযোগিতামূলক হয়ে পড়তে পারে, যার ফলে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে বহু কারখানার ওপর- বিশেষ করে যেগুলো মার্কিন ক্রেতার ওপর নির্ভরশীল। অনেক কারখানার টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়তে পারে, যার প্রভাব পড়বে শ্রমিকদের ওপর। এই পেশায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিকই নারী, যারা পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী। এ ছাড়া, তৈরি পোশাক খাতের সহায়ক শিল্প যেমন- প্যাকেজিং, পরিবহন এবং এর সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও এই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসা, যাতে শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা বা ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যায়।
দেশের প্লাস্টিক খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, ‘উচ্চ শুল্কে প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাজার হারানোর শঙ্কা থাকবে। আমাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য বিক্রি খুব বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘এটি পোশাক খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা ধারণা করেছিলাম ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে শুল্ক ধার্য হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষত তৈরি পোশাক খাত এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। এর ফলে আগে যেখানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো, সেখানে এখন দ্বিগুণেরও বেশি দিতে হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।’
ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিস) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ‘শুল্ক কমানোর ক্ষেত্রে আমরা গত তিন মাস কিছুই করতে পারিনি। তবে আমেরিকা আমাদের সুযোগ দিয়েছে। আমরা প্রস্তাব দিয়েছি তাদের। কী কী পণ্য আমদানি করব, শুল্ক কমানো বা অশুল্ক বাধা কমানোর যেসব প্রস্তাব দিয়েছি সেগুলো খুব একটা আকর্ষণীয় মনে হয়নি আমেরিকানদের কাছে। এজন্য তারা মাত্র ২ শতাংশ আমাদের অনার করেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমেরিকা আবার আমাদের আলোচনার জন্য ২০ দিন সময় দিয়েছে। আমাদের বড় সমস্যা হলো আমরা কখনোই নেগোসিয়েশন ভালো করি না। আমরা এটাও জানি, নেগোসিয়েশন ভালো করার কোনো চেষ্টাও আমরা করি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি আমাদের সতর্ক করে সেখানে আমাদের বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। আমরা মুখে মুখে বললাম সবার জন্য উইন উইন করব। কিন্তু আমেরিকার জন্য লাভের বিষয় কী, সেটি আমরা বলতে পারি না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি বিষয়গুলো আগামী সাতদিনের মধ্যে পরিষ্কার করতে না পারি, কোনো শুল্কচুক্তি করতে যদি ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা বিপদে পড়ব। চীন, ভারত ও ভিয়েতনাম মোটামুটি একটা ফাইনাল করে ফেলেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বিপদের মধ্যে আছে।’
পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ॥ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম, চীন, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের ওপর প্রস্তাবিত পারস্পরিক শুল্ক হার (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) বেশি উল্লেখ করে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) এর সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান বলেছেন, এই শুল্ক হার কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে ক্ষতির মাত্রা কেমন হবে, তা রিটেইলারদের অর্ডার শিফট করার ধরনের ওপর নির্ভর করবে।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ ও চীনের ওপর ৩০ শতাংশ রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ নির্ধারণ করা হয়েছে। ভারতের ওপর ২৭ শতাংশ প্রস্তাব করার পর দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করে কমানোর চেষ্টা করছে।
মোস্তফা আবিদ খান আরও বলেন, ‘এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী হলো পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া। এ দুটি দেশের ওপর প্রস্তাবিত রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ রেটও বাংলাদেশের চেয়ে কম। ফলে এটা বলতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই যে, প্রস্তাবিত ট্যারিফ হার কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা চোখ বন্ধ করে যে কেউ বলতে পারেন। তবে ক্ষতির মাত্রা কেমন হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। বাড়তি শুল্কহার কার্যকর হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডগুলো কীভাবে তাদের অর্ডার শিফট করবে, তার ওপর ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করবে।’
মোস্তফা আবিদ খান বলেন, ‘এলডিসি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে- এমন আশাবাদ করা মোটেই ঠিক নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই এলডিসিগুলোকে কোনো সুবিধা দেয়নি। এবারও যে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ আরোপ করেছে, তাতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এলডিসি হওয়া সত্ত্বেও এদের ওপর উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বাড়তি ট্যারিফ আরোপ করার কথা বলা হয়েছে।’
অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে- ড. সেলিম ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, এপ্রিল মাসে প্রকাশিত প্রাথমিক পরিকল্পনার ভিত্তিতেই নতুন শুল্ক হার ঘোষণা শুরু হয়েছে। এতে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের একক সিদ্ধান্তে আরোপিত এক চরম অর্থনৈতিক ধাক্কা। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। এর ফলে আগে যেখানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো, সেখানে এখন দ্বিগুণেরও বেশি দিতে হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এই শুল্ক বৃদ্ধির বোঝা গার্মেন্টস শিল্প ও এর সঙ্গে জড়িত কোটি শ্রমিকের ওপরই সবচেয়ে বেশি পড়বে, যাদের সিংহভাগই নারী। এর ফলে প্রবৃদ্ধি হ্রাস, কর্মসংস্থান সংকট ও দারিদ্র্য বৃদ্ধির ঝুঁকি দেখা দেবে-যা একসঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে। এই পারস্পরিক শুল্ক আরোপের যৌক্তিকতাও স্পষ্ট নয়, যা উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। এখনো জানা যায়নি যে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ- যেমন ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ওপর কত শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দফায় ১৪টি দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত হারই সর্বোচ্চগুলোর একটি। অন্যদের ক্ষেত্রে হার কম হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের প্রতিযোগিতামূলক অসুবিধায় পড়বে। এতে ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি সরবরাহ চেইন পরিকল্পনাও জটিল হয়ে উঠবে।
তিনি বলেন, পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আরও গভীর। বাড়তি খরচের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা তুলনামূলকভাবে কম শুল্কের দেশে অর্ডার স্থানান্তর করতে পারেন। তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ, যা মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি, এতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘আরেকটি হতাশার দিক হলো-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শুল্ক আলোচনা যেভাবে হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ কোনো সুবিধাজনক অবস্থান আদায় করতে পারেনি। একটি ভারসাম্যপূর্ণ চুক্তি করতে ব্যর্থ হওয়া এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্ব বাণিজ্যের পরিবর্তনশীল পরিবেশে আরও দুর্বল করে তুলছে।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-জুন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৭.৬০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা ওই সময়ের মোট রপ্তানির ১৭.০৯ শতাংশ। ওই অর্থবছরে বাংলাদেশের ওভেন পোশাকের ২৫.৯৩ শতাংশ, নিট পোশাকের ১১.৭১ শতাংশ ও হোম টেক্সটাইলের ১৬.১২ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে।
প্যানেল মজি