ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

ইনভেস্টমেন্ট এক্সপো উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী

আরও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০১:৩৩, ২০ নভেম্বর ২০২৩

আরও বিদেশী বিনিয়োগ  আকর্ষণে সব ব্যবস্থা  নেওয়া হয়েছে

ইনভেস্টমেন্ট এক্সপো-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা করেন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আরও বিদেশী বিনিয়োগের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্য-জার্মানি এবং বর্তমান উচ্চ-প্রবৃদ্ধির ভিয়েতনাম বা থাইল্যান্ডের বাজারকে যেন ছাড়িয়ে যেতে পারে সে লক্ষ্য নিয়েই আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করে যাচ্ছে। সরকার বৃহত্তর বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নিয়েছে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে পরিণত হবে বলে আমাদের ধারণা। আরও বেশি পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগ যাতে বাংলাদেশে আসতে পারে সেজন্য আমরা বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছি।

রবিবার রাজধানীর হোটেল রেডিসন ব্লুতে ফরেন ইনভেস্টরস্ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই-ফিকি) ৬০ বছরপূর্তি উদযাপন এবং দুদিনব্যাপী ইনভেস্টমেন্ট এক্সপো-২০২৩ এর উদ্বোধনকালে দেওয়া প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন. আমাদের বিশাল জনশক্তি আছে। সেটাকে আমরা সবচেয়ে বেশি কাজে লাগাব। তাদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে আমরা গড়ে তুলছি। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর একটিতে পরিণত করেছি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) লোকমান হোসেন মিয়া, ফিকির সভাপতি নাসের ইজাজ বিজয় সংগঠনের সিনিয়র সহ-সভাপতি দীপল আবেবিক্রমা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

কয়েকজন আন্তর্জাতিক সব বিনিয়োগকারীও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।ফরএভার ফিউচার ফরওয়ার্ডশিরোনামের একটি ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ফিকির গবেষণা প্রতিবেদনক্যাটালাইজিং গ্রেটার এফডিআই ফর ভিশন-২০৪১ : প্রাইওরিটিজ ফর বিল্ডিং কনডাক্টিভ ট্যাক্স সিস্টেম ইন বাংলাদেশএবং ইএসজি কমিটি প্রণোদিতইএসজি স্ট্র্যাটেজিস অ্যান্ড ইর্ম্যাক্টস ফ্রম দি মেম্বারস অব এফআইসিসিসিআইশীর্ষক দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।

প্রধানমন্ত্রীকে প্রখ্যাত বাংলাদেশী শিল্পী ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের  তৈরি একটি স্মারক উপহার দেওয়া হয়, যা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার প্রতীক। বিডা এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হল এফআইসিসিআইর ৬০ বছর উদযাপন এবং বিনিয়োগ এক্সপো-২০২৩-এর কৌশলগত অংশীদার। ইনভেস্টমেন্ট এক্সপো -২০২৩ এফআইসিসিআই সদস্য এবং সরকারি স্টেকহোল্ডারদের প্রদর্শকদের সঙ্গে স্থানীয় এবং বিদেশী উভয় বিনিয়োগকারীদের লক্ষ্য করে ৪০টি স্টল প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত করেছে।রেডিসন ব্লুর ওয়াটার গার্ডেনেইনভেস্টমেন্ট এক্সপো-২০২৩আজ সোমবার পর্যন্ত চলবে এবং সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

তাঁর সরকার  সারাদেশে ১শটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ৩৯টি হাইটেক পার্ক প্রতিষ্ঠা করেছে, এগুলো বিদেশী বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এককভাবে কোনো দেশ যদি এক - জমি চায় আমরা তাও দেব। আবার যদি কেউ যৌথ উদ্যোগে করতে চান সেটাও করা হবে অথবা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে  করতে চাইলে সেটাও করা হবে।

তিনি বলেন, তাঁর সরকার অনেকগুলো সংস্থা  তৈরি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা), বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা), বাংলাদেশ ইকোনমিক প্রসেসিং জোন অথরিটি (বেপজা), বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটি (এইচটিপিএ) এবং পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটি (পিপিপিএ) বিনিয়োগের সুবিধার্থে বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থাগুলোতেওয়ান স্টপপরিষেবা চালু করা হয়েছে।

সরকারপ্রধান বলেন, বিনিয়োগ পরিষেবা প্রদানকারী সমস্ত অফিস সম্পূর্ণ অনলাইন এবং ডিজিটালাইজড করার পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়েছি। একইসঙ্গে কর মওকুফ, রেমিটেন্স রয়্যালটি, প্রস্থান নীতি, লভ্যাংশ এবং মূলধন সম্পূর্ণ প্রত্যাবর্তন, আইন দ্বারা বিদেশী বিনিয়োগ সুরক্ষাসহ বিনিয়োগ নীতিকে আরও সহজ করার জন্য অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, তাঁর সরকার দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২- সরবরাহ খাত, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সংশ্লিষ্ট খাত এবং পর্যটন খাতকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

সুনীল অর্থনীতিরপ্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সুনীল অর্থনীতিরখাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে আমরা নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। লজিস্টিক শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং এই খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে অন্যান্য শিল্প খাতের উন্নতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে জাতীয় লজিস্টিকস ডেভেলপমেন্ট পলিসি প্রণয়নের কাজ চলছে। বাংলাদেশে এখন জ্বালানি, পানি, লজিস্টিকস এবং পরিবহন খাতে ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবকাঠামো গড়ার সুযোগ রয়েছে।

২০২৫ সালের মধ্যে শুধু লজিস্টিকস খাতই ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজারে পরিণত হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাণিজ্য শিল্প মন্ত্রণালয়ও শক্তিশালী রপ্তানি কৌশল এবং শিল্পনীতি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। আমরা ২০৩১ সালের মধ্যে জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুপাত ৩১ দশমিক ৪৩ শতাংশে উন্নীত করতে চাই। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এখন প্রায় সতের কোটি মানুষের একটি বড় অভ্যন্তরীণ বাজার। এটি ২০৩০ সালের মধ্যে ৯ম বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে পরিণত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তখন যুক্তরাজ্য এবং জার্মানির মতো প্রতিষ্ঠিত বাজারগুলোকে এবং বর্তমান উচ্চ-প্রবৃদ্ধির ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডকে আমাদের দেশ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তিনি আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত ধনীক শ্রেণির সংখা হবে কোটি ৪০ লাখ। ২০৪০ সালের মধ্যে আনুমানিক মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়াবে হাজার ৮৮০ মার্কিন ডলার। কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ৩শকোটি মানুষের আঞ্চলিক বাজারের কেন্দ্রস্থল হতে পারে।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডিজিটাল খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মোট জনগোষ্ঠীর ৭৮.৫৫ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। বাংলাদেশে প্রায় লাখ ৫০ হাজার ফ্রিল্যান্সার রয়েছে যা বিশ্বব্যাপী অনলাইন শ্রমের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী। আইসিটি রপ্তানি খাতে ২০২৩ সালে আমরা অর্জন করেছি . বিলিয়ন ডলার। আশা করা হচ্ছে, ২০২৫ সাল নাগাদ এই খাতে রপ্তানি আয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে।

শক্তিশালী সামষ্টিক অর্থনৈতিক মৌলিক বিষয়সমূহ বাণিজ্য সংহতকরণের ফলে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মাথাপিছু আয় মাত্র এক দশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে হাজার ৭৯৩ মার্কিন ডলারে। জিডিপির আকার ২০০৬ সালের লক্ষ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ দশমিক ৩১ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৩গুণ কমে ১৮ দশমিক শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, উৎপাদন খাত ছাড়াও, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই সাফল্যের  পেছনে রয়েছে ব্যক্তি খাতে ভোগ বৃদ্ধি, যাকে প্রাথমিকভাবে সহায়তা করছে ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ, শক্তিশালী গ্রামীণ অর্থনীতি, প্রবাসী আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ জ্বালানি খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের বিগত প্রায় ১৫ বছরের উন্নয়নের কৃতিত্ব দেশের বেসরকারি খাতের। ১৯৯৬ সালে আমরা বেসরকারি খাতের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দেই। গত ১৫ বছরে আমরা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য খাতের উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ বাস্তবায়ন করেছি। এর ফলে বেসরকারি খাত আরও শক্তিশালী বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।

সরকার প্রধান বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে জাতির পিতা মাত্র বছর মাসের মধ্যে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত করেছিলেন। যেটা৭৫ সালে আমরা স্বীকৃতি পাই কিন্তু এর পর আর বেশিদূর এগুতে পারেনি। আমাদের বিচক্ষণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং বাণিজ্য সংহতকরণের ওপর ভিত্তি করে আজকের এই টেকসই অর্থনীতি উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে এবং ২০২৬ সাল থেকে এই উন্নয়নশীল দেশের অগ্রযাত্রা শুরু হবে। তার প্রস্তুতিও আমরা এখন থেকে নিচ্ছি।

প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ২০৩৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে উন্নত সমৃদ্ধস্মার্ট বাংলাদেশ কারণ, জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজিও তাঁর সরকার বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে এবং এতে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করেছে। যদিও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক সমস্যার প্রভাব বাংলাদেশে পড়েছে। তবু এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

×