
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই অভ্যুত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন ১৬ই জুলাই। ছাত্রলীগ-যুবলীগ আর পুলিশের হিংস্রতায় প্রথম শহীদ আবু সাঈদসহ ছয় জনের নিহতের মধ্য দিয়ে এদিনই মূলত. আওয়ামী ফ্যাসিজমের কবর খোঁড়া শুরু হয়ে যায়।
আগের দিনে ছাত্রলীগের নির্মম হামলার কারণে আন্দোলন পুরো ঢাকা শহর তো বটেই দেশব্যাপী তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানীর চানখারপুল, সায়েন্সল্যাব, শাহাবাগ, মহাখালীও মতিঝিলের পাশাপাশি আরও অন্তত পাঁচ জেলায় মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ভীত নড়ে যায় স্বৈরশাসকের। দিশেহারা হয়ে পুলিশের সাথে মাঠে নামে ছাত্রলীগ আর যুবলীগ। ত্রিপক্ষীয় হামলায় রক্তাক্ত হয় রাজপথ।
এই তিন পক্ষ মিলে রাজধানীর পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বান্দরবান, রাঙামাটি, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, বরিশাল, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুরসহ অন্তত ১৫টি জেলায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। যার নেতৃত্ব দেয় ছাত্রলীগ। যুক্ত হয়, যুবলীগ ও পুলিশ।
হামলায় এদিন নিহত হয় ৬ জন। । নিহতদের ছয় জনের মধ্যে চট্টগ্রামে তিনজন, ঢাকায় দুজন ও রংপুরের একজন। আহত হয় আরও চার শতাধিক।
রংপুরে শহীদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ভিডিও মুহুর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়ানো আবু সাঈদকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেস থেকে পুলিশ গুলি করে, একটা নয় পরপর অনেকগুলো। এক পর্যায়ে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে।
এদিন বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের মুরাদপুরে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের মধ্যে ছাত্রলীগ-যুবলীগের মিছিল থেকে একজনকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তাঁর নাম মোহাম্মদ ওয়াসিম। ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়কও ছিলেন।
নিহত অন্য দুজন হলেন চট্টগ্রাম নগরের ওমর গণি এমইএস কলেজের ছাত্র ফয়সাল আহমেদ শান্ত এবং পথচারী মো. ফারুক।
বিকেলে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তারা হলেন পলক সানজিদ শুভ, অয়ন, সাফিন ও রাতুল। আগে থেকেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ওমর বিন আবদাল আজিজের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চানখাঁরপুল মোড়ে অবস্থান নেন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়।
আবু সাঈদসহ ছয়জনের মৃত্যু এবং প্রায় ৪০০ মত আহতের ঘটনার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ ছাত্রীরা ১৬ জুলাই রাতে সম্মিলিতভাবে হল থেকে ছাত্রলীগের সদস্যদের বের করে দেন। লেজুড় বৃত্তির রাজনীতি ছেড়ে হলে বিশুদ্ধ রাজনীতি করবেন - শিক্ষকদের কাছ থেকে এরকম মুচলেকা নেন ছাত্রীরা। তাদের দেখানো পথে পরদিন ভোরে ছেলেদের হল থেকেও ছাত্রলীগের সদস্যদের বের করে দেওয়া হয়।
এর আগের রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও আন্দোলন কাদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
১৬ জুলাই সন্ধ্যা ৭টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিমকে ধাওয়া করেন শিক্ষার্থীরা। তিনি ধানমন্ডির ল্যাবএইডে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। ডাক্তার দেখিয়ে বের হলে শিক্ষার্থীরা তাঁকে ধাওয়া করলে হাসপাতালে ঢুকে পড়েন। এ সময় তাঁর গাড়িও আটকে দেওয়া হয়।
এদিন সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে সবার্ত্মকভাবে পাশে রয়েছে বলে জানান ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব।
অকুতোভয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে ভয় পেয়ে যায় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার। ১৬ জুলাই রাতেই ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী ও রংপুরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
রাতেই বন্ধ ঘোষণা করা হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মধ্যরাতে বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইলের ফোরজি নেটওয়ার্ক। ব্যাপকভাবে যোগাযোগ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়।
অপরদিকে, এদিন সরকারের পক্ষ থেকে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এটর্নি জেনারেল এর কার্যালয় থেকে এ আবেদন জমা দেওয়া হয়। আবেদনে বলা হয় সরকারি চাকরিতে কোটার বিধান রাখা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং আদালত এই নীতিগত সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
১৬ জুলাই আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড মামলায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বিবৃতি প্রদান করে যাতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৫ জন শিক্ষক স্বাক্ষর করেন।
বিবৃতিতে চারটি দাবি জানানো হয়, ০১ আন্দোলনে যারা হামলা করেছে, গুলি করেছে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের সনাক্ত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
দুই. ন্যায্য দাবি অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংস্কার করতে হবে সংবিধানের আলোকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে কোটা সংস্কারের রূপ নির্ণয় করতে হবে।
তিন. ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের ক্যাম্পাসে অনুপ্রবেশ ও ত্রাস সৃষ্টির ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে কোন বহিরাগত জন্য কম্পাসের ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুলিশ প্রশাসনকে হস্তক্ষেপ নিতে হবে।
চার. শিক্ষার্থীরা যাতে নিরাপদে ছাত্রাবাসে থাকতে পারে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দিনভর সংঘর্ষের পর ১৬ জুলাই রাতে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজ ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পবিত্র আশুরা উপলক্ষে কর্মসূচি বন্ধ রাখলেও পরদিন বেলা ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে নিহতদের গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের পাশাপাশি সারা দেশে এ কর্মসূচি সমন্বয় করার ঘোষণা দেয়া হয়।
ফারুক