
মোরসালিন মিজান ॥ কি মাধুরি গো কি মাধুরি/মনো চাহে যে ধরা দিতে/মনা চাহে যে ধরা দিতে/তবু সে লাজে সরে যায়/মধুমালতী ডাকে আয়...। ডাকছে মধুমালতী। এই ক’দিন আগেও গাছটিকে শুকনো প্রাণহীন ঝোপঝাঁড় মনে হচ্ছিল। যেন সব শেষ। ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু এখন চৈত্রের মাঝামাঝি সময়ে এসে মনে হচ্ছে প্রাণের ফোয়ারা। সৌন্দর্যের সবটুকু নিয়ে প্রিয় ফুল ফুটেছে। ফুটেছে বলতে, সবে ফুটল। একেবারেই টাটকা গায়ের রং। ঘ্রাণটাও দারুণ মিষ্টি। হালকা মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে এসে লাগতেই স্নিগ্ধ একটা অনুভূতি হচ্ছে। যাদের বাসার সামনে ফুলভর্তি গাছ আছে তারা দারুণ উপভোগ করছেন, অনুমান করা যায়।
জনকণ্ঠ ভবনের উদাহরণটাও দিতে পারি এখানে। ইস্কাটনে অবস্থিত সুরম্য ভবনের সামনের দিকে অনেক ফুল। তবে উপরের দিকে বড় জায়গা নিয়ে ফুটে আছে মধুমালতী। গত ক’দিনে অজস্র ফুল। একসঙ্গে এমনভাবে ফুটেছে যে, দেখে ঝুলন্ত বাগান বলে মনে হয়। চৈত্রের মৃদু হাওয়ায় ফুলগুলো দুলছে। পাপড়ির রং মূলত লাল। কিন্তু উল্টো বাতাসে পেছনে থাকা সাদা রংটাও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। বেশ লাগে দৃশ্যটা। নিজ থেকে ফুলের দিকে তাকাতে হয় না। মিষ্টি ঘ্রাণ যেন ফুলটির দিকে টেনে নিয়ে যায়। নিচের দিকে নেমে আসা ফুল পথচারীদেরও স্বাগত জানিয়ে চলেছে।
মধুমালতী গ্রীষ্মের ফুল। সে হিসেবে কয়েকদিন আগেই ফুটেছে বলতে হবে। একই ফুলের অবশ্য আরও কিছু নাম আছে। ইংরেজী নাম রেঙ্গুনক্রিপার। বৈজ্ঞানিক নাম কুইসকুয়ালিস ইন্ডিকা। আর এ দেশীয় নাম মাধুরীলতা ও মধুমঞ্জরীলতা।
মধুমঞ্জরীলতা নামটি আবার রবীন্দ্রনাথের দেয়া। কবিগুরুর প্রকৃতিপ্রেম সে তো আর কারও অজানা নয়। সবুজ বৃক্ষ তরুলতা ফুল পাখি সবই ভীষণ পছন্দ করতেন তিনি। কবিগুরুর জীবন-যাপনে, বহু লেখায় আমরা এর প্রমাণ পাই। একই প্রেম ভাব ও বোধের জায়গা থেকে এ ফুলের দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি। নতুন নাম দিয়ে একে বরণ করে নিয়েছিলেন। কারণ ফুলটি এখন খুব পরিচিত হলেও একসময় অচেনাই ছিল। এর কী নাম, কী বৃত্তান্ত, কেউ জানত না। হয়তো তাই রবীন্দ্রনাথকেই এগিয়ে আসতে হয়েছিল।
এ বিষয়ে লিখেও গেছেন কবিগুরু। ফুলটির পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এ লতার কোন একটা বিদেশী নাম নিশ্চয় আছে- জানিনে, জানার দরকারও নেই। আমাদের দেশের মন্দিরে এই লতার ফুলের ব্যবহার চলে না, কিন্তু মন্দিরের বাইরে যে দেবতা মুক্তস্বরূপে আছেন তার প্রচুর প্রসন্নতা এর মধ্যে বিকশিত। কাব্যসরস্বতী কোন মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন, তার ব্যবহারে এই ফুলকে লাগাব ঠিক করেছি, তাই নতুন করে নাম দিতে হলো। রূপে রসে এর মধ্যে বিদেশী কিছুই নেই, এ দেশের হাওয়ায় মাটিতে এর একটুও বিতৃষ্ণা দেখা যায় না, তাই দিশী নামে একে আপন করে নিলেম।’ এই ‘দিশী’ (দেশী) নামটিই মধুমঞ্জরীলতা। কবিগুরুর কবিতা থেকে বললে, ‘ফুলে ফুল তার পরিচয়লিপি ধরে/নাম দিয়ে আমি নিলাম আপন ক’রে-/মধুমঞ্জরীলতা।’
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, বহুকাল আগে নামকরণ করলেও এ ফুলের নাম নিয়ে বিভ্রান্তি দূর হয়নি আজও। অনেকেই একে ‘মাধবীলতা’ বলে ডাকেন। তখনই বিরাট গ-গোল বেধে যায়। আদতে মাধবীলতা স্বতন্ত্র একটি ফুল। গুচ্ছাকারে হয়। প্রতি গুচ্ছে থাকে বিশ থেকে ত্রিশটির মতো ফুল। ৫ পাপড়ির চারটি ছোট ও একটি বিশেষ বড় হয়। ছোট পাপড়িগুলো সাদা। আর বড় পাপড়ির মাঝখানটায় হলুদ ছাপ থাকে। ‘লতা’ শব্দটি ছাড়া দুই ফুলের মধ্যে আর কোন মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এর পরও কেন এমন ভুল চর্চা, কী করে এত চেনা জানা ফুল অন্য আরেকটি ফুলের নামে পরিচিতি পেল সে এক রহস্য বটে। এই ভুল শুধরে দেয়ার চেষ্টাও কম দিন ধরে হচ্ছে না। কিন্তু বিশেষ কাজ হয়েছে, না, এমনটি এখনও বলা যাবে না।
সে যাই হোক, নিজের আশপাশে তাকান। মধুমালতী বা মধুমঞ্জরীলতা ফুটে আছে। এটি ঠিক বাগানের ফুল নয়। বাড়ির সামনের গেটে বা সীমানা প্রাচীরের দেয়াল ঘেঁষে লাগানো হয়। মধুমালতী ঘন সবুজ পাতা দেখতে অনেকটা ঝোপের মতো। সেই ঝোপে এখন অযুত ফুলের সমাহার।
উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা মতে, এটি মালয়েশীয় প্রজাতি। গাছের পাতা একক অখ- আয়তাকার। ৬-৮ সেমি লম্বা। শিরা সামান্য রোমশ। বিন্যাস বিপ্রতীপ। দলনল প্রায় ৫ সেমি লম্বা। মুখে ৫টি গোল লতি। ফুল চওড়ায় ২ সেমি। সাদা ও ছোট ডবল ফুলের দুটি ভ্যারাইটি আছে। ড্যান্সিফ্লোরা প্রজাতির ফুল বড় হয়। প্রায় ৭ সেমি লম্বা। মুখ ৩ সেমি চওড়া। ম্যালাবারিকা প্রজাতির পাতা, ফুল, ফুলের থোকা ছোট। কিন্তু অজস্র। এসব তথ্য ফুলটিকে আরও চিনতে সহায়তা করবে নিশ্চয়ই।