
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বর্ষাকাল বিদায় নিলেও বিদায় নেয়নি বৃষ্টি। সোমবার বৃষ্টি না হলেও ছিল মুখ ভার করা আকাশ। করোনার ভয় কাটিয়ে এর মধ্যেই পঞ্চমীর বোধন আর ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে শুরু হলো বাঙালী হিন্দুদের প্রধান ও প্রাণের উৎসব দুর্গাপূজা। দুর্গতিনাশিনী দেবীর বোধন ছাড়াও অধিষ্ঠান, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে পাঁচদিনের দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা। ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনি, আর ভক্তকুলের আবাহনের মন্ত্রোচ্চারণে দেবী দুর্গার স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আগমন ঘটেছে।
পূজার মন্ত্রোচ্চারণ, মন্দিরে মন্দিরে ধূপধুনো আর ঢাক-ঢোল, কাঁসর-মন্দিরার আওয়াজে মণ্ডপগুলো মুখরিত। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে দুর্গতিনাশিনীর আগমনে বিশ্বের কোটি হিন্দু সম্প্রদায় আনন্দে বিহ্বল থাকলেও এবারও বৈশ্বিক মহামারীর কারণে দুর্গোৎসবের পরিবর্তে শুধু আনুষ্ঠানিক সাত্তি¡ক পূজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছেন তাঁরা। কিন্তু করোনার ভয় কাটিয়ে বেশিরভাগ মণ্ডপে সাড়ম্বরেই শুরু হয়েছে দুর্গোৎসব। আজ মঙ্গলবার মহাসপ্তমী। পৃথিবীর মানুষকে করোনা মহামারী থেকে রক্ষা এবং প্রাণঘাতী এই ভাইরাসমুক্ত সুন্দর পৃথিবীর প্রত্যাশায় আজ মন্দির-মণ্ডপে বিশেষ প্রার্থনা করা হবে।
গত ৬ অক্টোবর দেবী দুর্গার আবাহন বা মহালয়ার মধ্য দিয়ে সূচিত হয় দেবীপক্ষের। দেবীপক্ষ শুরুর সাতদিন পর পাঁচদিনের দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে থাকে। তবে এবার পঞ্চমীর বোধন ও ষষ্ঠী তিথি একই দিনে পড়ায় দুর্গা পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরুর দিনক্ষণও একদিন এগিয়ে এসেছিল। ফলে সোমবারই সায়ংকালে তথা সন্ধ্যায় বোধনের মাধ্যমে দক্ষিণায়নের নিদ্রিত দেবী দুর্গার নিদ্রা ভাঙ্গার জন্য বন্দনা পূজা করা হয়েছে।
এর আগে ষষ্ঠীতিথিতে সকাল ৭টা ৩১ মিনিটের মধ্যে দেবী দুর্গার ষষ্ঠাদি কল্পরারম্ভ ও ষষ্ঠীবিহিত পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বেলতলা কিংবা বেলগাছের নিচে দেয়া হয় ষষ্ঠীপূজা। মণ্ডপে মণ্ডপে হয় দেবীর অধিষ্ঠান। পরে সন্ধ্যায় বোধন শেষে দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল দুর্গোৎসব। সব মণ্ডপে সীমিত পরিসরে পুষ্পাঞ্জলি, ভোগ আরতি ও প্রসাদ বিতরণের আয়োজনও করা হয়।
উৎসবের ™ি^তীয় দিনে আজ মঙ্গলবার মহাসপ্তমী। সকালে ত্রিনয়নী দেবীদুর্গার চক্ষুদান করা হবে। এরপর সকাল ৭টা ৩২ মিনিটের মধ্যে দেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন, সপ্তমাদি কল্পরারম্ভ ও সপ্তমীবিহীত পূজা অনুষ্ঠিত হবে। এভাবে উৎসব চলবে আগামী শুক্রবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত।
দুর্গতিনাশিনী দুর্গা এসেছেন বিশ্ব শান্তির জন্য তথা সবার মঙ্গলের তরে। কিন্তু অসুরবিনাশিনী জগজ্জননী দেবী দুর্গা বাঙালীগৃহে আসেন অন্যভাবে। কৈলাশ ছেড়ে প্রতিবছর তিনি আসেন বাবারবাড়িতে কন্যারূপে। দেবী দুর্গার সঙ্গে প্রতি শরতে মর্ত্যে আসেন ল²ী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। এই চালচিত্রে দেবাদিদেব শিবও বাদ যান না। ল²ী সমৃদ্ধি ও সরস্বতী জ্ঞানের প্রতীক। কার্তিক হচ্ছেন দেবসেনাপতি, শত্রæনাশকারী। আর গণেশ হচ্ছেন সর্বসিদ্ধিদাতা অর্থাৎ মানুষের কামনা পূরণকারী। বাঙালী হিন্দুরা যে কোন শুভ কাজে ইষ্টনাম হিসেবে দেবী দুর্গাকে স্মরণ করে থাকেন।
ঢাকা মহানগরীর ২শ’ ৩৭টিসহ সারাদেশের ৩২ হাজার ১১২টি পূজামণ্ডপে সোমবার দুর্গাপূজা শুরু হয়। হিন্দুদের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মানুষও যোগ দেয়ায় দুর্গাপূজা সার্বজনীন রূপ নিয়েছে। সারাদেশের মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনির শব্দ দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের জানান দিচ্ছে।
কেন্দ্রীয় পূজা উৎসব বলে পরিচিত ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনের মণ্ডপের সামনে প্যান্ডেল ছাড়াও মন্দিরকে সাজানো হয়েছে নতুন রঙ ও সাজে। তবে করোনার কারণে আলোকসজ্জার বাহারি রূপ অনুপস্থিত ছিল। এখানে পুলিশের বিশেষ কন্ট্রোল রুমের পাশাপাশি পূজা উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করেছে। বসানো হয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। ভক্তা-দর্শনার্থীদের মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে উপভোগ করতে হয়েছে পূজার আনন্দ। সকাল ও সন্ধ্যায় পঞ্চমীর বোধন ও ষষ্ঠীপূজার নানা আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি পূজা শেষে অঞ্জলি ও ভোগ আরতি ছিল উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ।
রাজধানীর গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ, রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম, রাজারবাগের বরোদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির ও শ্মশান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, কাওরান বাজারে মিডিয়াপল্লীর পূজা এবং বনানীতে গুলশান-বনানী সার্বজনীন পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। এছাড়া মিরপুর কেন্দ্রীয় মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, শাঁখারীবাজারের পূজামণ্ডপ, পানিটোলা, জয়কালী রোডের রামসীতা মন্দির, অভয়নগর দাস লেনের ভোলানন্দগিরি আশ্রম, রাধিকা বসাক লেন, নবেন্দ্র বসাক লেন, ঢাকেশ^রীবাড়ী, টিকাটুলীর প্রণব মঠ, ঠাঁটারীবাজার পঞ্চানন শিব মন্দির, সূত্রাপূরের ঋষিপাড়া গৌতম মন্দির, বনগ্রাম তরুণ সংসদ, উত্তর মুশুন্দী, ফরাশগঞ্জ জমিদারবাড়ি এবং বিহারীলাল জিও মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দির ও মণ্ডপে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে ।
অন্যদিকে, দুর্গাপূজাকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল সারাদেশে। প্রতিটি মণ্ডপে পুলিশ, আনসার-ভিডিপির পাশাপাশি কোথাও কোথাও নিযুক্ত করা হয় র্যাব সদস্যদের। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যদের ছিল সতর্ক প্রহরা। অনেক মণ্ডপে আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টরে কড়া তল্লাশির মধ্যদিয়ে মÐপে প্রবেশ করতে হয়েছে দর্শনার্থীদের। প্রতিটি মণ্ডপে মাস্ক ছাড়া ভক্তরা যেন মন্দিরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য স্বেচ্ছাসেবকদের তৎপরতাও ছিল উল্লেখ করার মতো।