ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

গির্জার বাইরে ঈশ্বর: এক মায়ের আস্থার গল্প

প্রকাশিত: ১২:২৭, ২৩ জুলাই ২০২৫

গির্জার বাইরে ঈশ্বর: এক মায়ের আস্থার গল্প

আমার ছেলে এখন ১৭ বছর বয়সী। তার বয়সীদের মতো সেও চারপাশের জগৎ নিয়ে প্রশ্ন করছে—তার ধর্মবিশ্বাস নিয়েও। অথচ গত কয়েক বছরে আমি নিজেই বিশ্বাস হারিয়েছি আমার ধর্মে—ক্যাথলিক ধর্মে। মাঝেমাঝে মনে হয়, আমার এই মনোভাব তার ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, তার মানসিক শক্তি ও আত্মিক পথচলায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আমার গির্জা থেকে দূরে সরে আসার শুরু তার যখন মাধ্যমিকে পড়া, তখন থেকে। আমি একজন ডিভোর্সপ্রাপ্ত মা। ক্যাথলিক গির্জার কঠোর বিবাহনীতি আর গর্ভপাত-বিরোধী অবস্থান সবসময়ই আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। তবে বিষয়টি প্রকট হয়, যখন আমি ছেলেকে কনফার্মেশন (একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা) করানোর সিদ্ধান্ত নিই।

কনফার্মেশনের নিয়ম অনুযায়ী, একজন ‘স্পনসর’ থাকতে হয়—যিনি তার আত্মিক যাত্রায় গাইড হবেন, এবং বিশ্বাসভিত্তিক জীবনের উদাহরণ হবেন। আমার ছেলের বাবা ও আমি তখন অনেক আগেই ডিভোর্সড, আর আমার বয়ফ্রেন্ড, যিনি নিজেও একজন ক্যাথলিক, তখন থেকেই আমাদের সঙ্গে থাকেন। সে আমার ছেলেকে বাইক চালানো শিখিয়েছে, তার নাটকে অংশ নিয়েছে, এবং ছোটবেলা থেকে তার বেড়ে ওঠার সঙ্গী হয়েছে।

তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা তাকে স্পনসর হিসেবে মনোনয়ন দিই। কিন্তু ফর্ম পূরণের সময় আমাকে বাধ্য হয়ে লিখতে হয়—আমি ডিভোর্সপ্রাপ্ত, পুনরায় বিবাহিত নই।

কিছুদিন পর গির্জার প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ফোন করে জানায়—আমার বয়ফ্রেন্ড স্পনসর হতে পারবে না। কারণ, আমরা নাকি ‘পাপের মধ্যে বসবাস করছি’। আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম, সে একজন নীতিবান, বিশ্বস্ত মানুষ এবং তার চেয়ে ভালো উদাহরণ আমাদের জানা নেই।

কিন্তু তাতে কিছুই হলো না। পরে আমরা মিলে বিকল্প খুঁজতে থাকি। শেষ পর্যন্ত এক দূর সম্পর্কের ১৬ বছর বয়সী আত্মীয়কে নামমাত্র স্পনসর হিসেবে রাজি করানো হয়। যদিও সে ছেলেটির জীবনে কখনও ছিল না, কিন্তু সে একটি ক্যাথলিক স্কুলের ছাত্র হওয়ায় তার গির্জার পাদ্রি খুশি হয়ে সই দেন। তবে সে যেহেতু অন্য রাজ্যে, তাই গির্জা আমার বয়ফ্রেন্ডকে ‘প্রক্সি স্পনসর’ হিসেবে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়।

তখনই চারদিকে গির্জার বিরুদ্ধে শিশু যৌন নিপীড়নের ভয়াবহ কেলেঙ্কারির খবর ছড়িয়ে পড়ে। শুধু ফ্রান্সেই ১৯৫০ সাল থেকে প্রায় ২ লাখ শিশুকে গির্জার কর্মীরা নির্যাতন করেছে—এমন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ২০২০ সালে ৪২০০-এর বেশি অভিযোগ ওঠে।

আমার মনে হলো, গির্জা যেন একদিকে আমাদের মতো পরিবারের উপর নৈতিকতার ভার চাপাচ্ছে, অথচ নিজের ভেতরের নৈতিক সঙ্কটকে অস্বীকার করছে।

ছেলের কনফার্মেশন ছিল আমার শেষ ‘মাস’। এরপর আর গির্জায় যাওয়া হয়নি। আমি ছেলেকে বলে দিয়েছি—আমার বিশ্বাস এখনও ঈশ্বরে, কিন্তু আমার বিশ্বাস গির্জার মধ্যে নয়। আমি নিজেকে এখনো ক্যাথলিক বলি, তবে আমি সম্পর্ক গড়ছি ঈশ্বরের সঙ্গে, গির্জার সঙ্গে নয়।

ছেলের পথ আলাদা, এবং তা হতে পারে আলাদা

সম্প্রতি সে যখন নতুন এলাকায় একটি গির্জার যুবদলে যোগ দিতে চাইল, আমি তাকে নিয়ে যেতে রাজি হলাম। কারণ আমি জানি—তার আত্মিক পথ আমার পথ নয়।

বিশ্বাস, ধর্ম নয়
মনোবিজ্ঞানী টানিয়া পারেদেস বলেন, “বিশ্বাস একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। ধর্ম শেখানো যায়, তবে বিশ্বাস গড়ে ওঠে আলাদা প্রক্রিয়ায়।”

যদি আপনি গির্জা থেকে দূরে থাকেন, তাহলে সন্তানকে বলুন—আপনি কীভাবে বিশ্বাস রাখেন জীবনে। নিয়ম মানা নয়, বিশ্বাস জাগ্রত করাই আসল।

আমি চাই, আমার ছেলে বুঝুক—তার নিজের পথ বেছে নেওয়ার অধিকার আছে। গির্জাকে ছেড়ে দিয়ে ঈশ্বরকে ভালোবাসা যায়। আবার সবকিছু জেনে-শুনেও কেউ গির্জায় থেকে যেতে পারে।

আমি চাই, সে যে পথ বেছে নিক—তা হোক অন্তরের পথ। তা আমার পথ থেকে আলাদা হলেও, আমি নিশ্চিত, ঈশ্বর তা মেনে নেবেন।


বিশ্বাস মানে নিয়ম মানা নয়, বরং সম্পর্ক গড়া। আপনি হয়তো গির্জা ছাড়লেন, কিন্তু ঈশ্বরকে নয়। আর আপনার সন্তান—সে যদি ভালোবাসা ও আলো খুঁজে পায় ঈশ্বরের পথে, আপনি কি তাকে আটকাতে চান?
নাহ, আপনি শুধু তার পাশে থাকুন। বাকিটা তার ও ঈশ্বরের ব্যাপার।

 

শেখ ফরিদ 

×