
ছবিঃ সংগৃহীত
ভারতের জনপ্রিয় ইনস্টাগ্রাম ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত “বেবিডল আর্চি”-র আকস্মিক উত্থান নজর কাড়ে সবার। একটি লাল শাড়িতে রোমানিয়ান গান ‘Dame Un Grr’-এ তার নাচ এবং মার্কিন প্রাপ্তবয়স্ক চলচ্চিত্র তারকা কেন্দ্রা লাস্টের সঙ্গে একটি ছবি ভাইরাল হওয়ার পরই তার অনুসারীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় ১৪ লাখে।
হঠাৎ করেই 'বেবিডল আর্চি' নামটি গুগলে ট্রেন্ডিং হয়ে যায়। তৈরি হয় অসংখ্য মিম ও ফ্যানপেজ। কিন্তু শিগগিরই সামনে আসে ভয়াবহ এক সত্য—এই জনপ্রিয় ইনস্টাগ্রাম আইডির পেছনে বাস্তবে কোনো নারীর অস্তিত্বই ছিল না।
এই ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টটি ছিল সম্পূর্ণ ভুয়া। অথচ এতে ব্যবহৃত চেহারাটি আশ্চর্যভাবে মিলে যায় ভারতের আসাম রাজ্যের ডিব্রুগড় শহরের এক গৃহবধূ—এই প্রতিবেদনে যাঁকে আমরা ‘সাঁচি’ নামে উল্লেখ করছি—এর সঙ্গে।
সাঁচির ভাইয়ের একটি পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়েরের পর ঘটনাটি সামনে আসে। গ্রেপ্তার করা হয় প্রাতিম বোরা নামে সাঁচির এক সাবেক প্রেমিককে।
তদন্তকারী সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা সিজাল আগরওয়াল বিবিসিকে জানান, প্রাতিম বোরা এই পুরো ডিপফেক প্রজেক্টটি তৈরি করেন “বিশুদ্ধ প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে”। একজন যান্ত্রিক প্রকৌশলী এবং স্বশিক্ষিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বিশারদ হিসেবে তিনি সাঁচির ব্যক্তিগত কিছু ছবি ব্যবহার করে তৈরি করেন এই ভুয়া প্রোফাইল।
২০২০ সালে ‘বেবিডল আর্চি’ আইডি তৈরি হয়, আর ২০২১ সালের মে মাসে প্রথম কিছু ছবি পোস্ট করা হয়। প্রথম দিকে সেগুলো ছিল সাঁচির প্রকৃত ছবি যা পরিবর্তন করা হয়েছিল। পরে, AI টুল যেমন ChatGPT এবং Dzine ব্যবহার করে সম্পূর্ণ কৃত্রিম চেহারায় রূপ দেন তিনি।
এই অ্যাকাউন্টটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে এটি ভাইরাল হতে থাকে।
সাঁচি নিজে কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন না। মূলধারার গণমাধ্যমে বেবিডল আর্চি-কে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার পর তিনি বিষয়টি জানতে পারেন। এমনকি গুজব ছড়ায় যে তিনি মার্কিন পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দিচ্ছেন—যা আসামের কোনো নারীর জন্য প্রথম ঘটনা হতে পারতো।
১১ জুলাই রাতে সাঁচির পরিবারের দেওয়া দুটি অনুচ্ছেদের সংক্ষিপ্ত অভিযোগে কিছু ছবি ও ভিডিওর প্রিন্ট আউট জমা দেওয়া হয়। তাতে কোনো নাম উল্লেখ ছিল না কারণ তারাও জানতেন না কে এই কাজটি করেছে।
ইনস্টাগ্রাম থেকে প্রোফাইলের তথ্য সংগ্রহ করে পুলিশ সাঁচিকে জিজ্ঞেস করে প্রাতিম বোরাকে তিনি চেনেন কি না। সাঁচির সম্মতির পরই টিনসুকিয়া জেলার একটি ঠিকানা ধরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ অভিযুক্তের ল্যাপটপ, মোবাইল, হার্ডড্রাইভ এবং ব্যাংক সংক্রান্ত নথিপত্র জব্দ করেছে। কারণ, এই অ্যাকাউন্টটি থেকে আয়ও করা হচ্ছিল। লিংকট্রিতে তার ৩,০০০ সাবস্ক্রিপশন ছিল এবং পাঁচ দিনের মধ্যে তিনি প্রায় ৩ লাখ রুপি আয় করেন। মোট আয় প্রায় ১০ লাখ রুপি।
সাঁচি বর্তমানে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও পরিবারসহ কাউন্সেলিং গ্রহণ করছেন এবং ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সিজাল আগরওয়াল।
“এই ধরনের ঘটনা ঠেকানো কঠিন। কিন্তু আমরা যদি আরও আগেই ব্যবস্থা নিতাম, হয়তো এতটা ছড়াতে পারতো না,” বলেন আগরওয়াল। “সাঁচি এবং তার পরিবার একদমই জানতেন না কারণ তাদেরকে ব্লক করা হয়েছিল।”
এই ঘটনায় মেটা (ইনস্টাগ্রামের মূল প্রতিষ্ঠান) এখনও বিবিসির কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। যদিও প্রতিষ্ঠানটি সাধারণত নগ্নতা বা যৌন কনটেন্ট নিষিদ্ধ করে এবং সম্প্রতি CBS জানিয়েছে তারা কিছু এআই-ভিত্তিক পর্ন কনটেন্ট তৈরির বিজ্ঞাপন সরিয়ে দিয়েছে।
আইনজীবী ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ মেঘনা বাল বলেন, “এই ঘটনা মর্মান্তিক হলেও প্রায় প্রতিরোধ করা অসম্ভব।” তিনি মনে করেন, সাঁচি আদালতের শরণাপন্ন হয়ে ‘ভুলে যাওয়ার অধিকার’ দাবি করতে পারেন এবং সংবাদ প্রতিবেদনগুলো অপসারণের আদেশ চাইতে পারেন। কিন্তু একবার ইন্টারনেটে কিছু ছড়িয়ে পড়লে সম্পূর্ণ মুছে ফেলা দুঃসাধ্য।
পুলিশ অভিযুক্ত প্রাতিম বোরার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, অশ্লীল কনটেন্ট ছড়ানো, মানহানি, জালিয়াতি, প্রতারণা ও সাইবার অপরাধের বিভিন্ন ধারায় মামলা করেছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তার সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে এবং অনেকেই কঠোর আইন দাবি করছেন। তবে মেঘনা বাল বলেন, আইন যথেষ্ট রয়েছে, তবে জেনারেটিভ এআই কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে নতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “ডিপফেক সবসময় খারাপ নয়। আইন করতে গিয়ে যেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা না পড়ে, সেটিও খেয়াল রাখতে হবে।”
সুত্রঃ বিবিসি
নোভা