
সুন্দর এই পৃথিবীতে জীবনে চলার পথে আমাদের এমন কিছু সুন্দর মানুষের সাথে পরিচয় হয় যারা শিখিয়ে যান শিখিয়ে যান কিভাবে মানুষ হওয়া যায়, কিভাবে দায়িত্ব নিতে হয়। শিখিয়ে যান অমরতা মানে আত্মত্যাগ। এমনই এক মানুষ ছিলেন রাজধানীর উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী (৪৬)। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে শিক্ষার্থীদের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে তিনি নিজে হারিয়ে গেছেন এই পৃথিবী থেকে।
গত সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় সাহসিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন মাহরীন। শিক্ষার্থীদের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে দগ্ধ হন তিনি। পরে তাকে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সোমবার রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এই মহীয়সী নারী।
আগুনের ভিতরেও শিক্ষার্থীদের জন্য লড়াই!
দুর্ঘটনার সময় মাইলস্টোন কলেজের ক্লাসরুমে থাকা শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে ছুটোছুটি করছিল। সেই মুহূর্তে উপস্থিত হয়ে একের পর এক শিক্ষার্থীকে ক্লাসরুম থেকে বের করে দেন মাহরীন চৌধুরী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শিক্ষার্থীরা যখন দিশেহারা, তখন মাহরীন ম্যাম চিল্লাইয়ে বলেন—“দৌড়াও, ভয় পেও না, আমি আছি।”
তবে সব শিক্ষার্থীকে নিরাপদে বের করে দেওয়ার পর নিজেই আর সময়মতো বের হতে পারেননি। আগুন তার শরীর গ্রাস করে নেয়। সেনাবাহিনীর এক উদ্ধারকর্মী বলেন, "উনি ভেতরে ঢুকে বাচ্চাগুলারে বের করে দিছেন, তারপর নিজে আর বের হতে পারেননি।"
"তুমি নিজের সন্তানের কথা ভাবলে না?"
শেষ সময়ে মাহরীনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান তার স্বামী মনসুর হেলাল। তিনি বলেন, “শেষ রাতে ও আমার হাত নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বলল, ‘আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না।’ আমি ওর হাত ধরতে গিয়েছিলাম, কিন্তু শরীরটা এমনভাবে পুড়ে গিয়েছিল যে, ধরতেও পারিনি।”
তিনি আরও বলেন, “আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তোমার দুই সন্তানের কথা ভাবলে না? ও বলেছিল—‘ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি?’”
২০টি প্রাণের মূল্য!
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং শিক্ষার্থীদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মাহরীনের দ্রুত সিদ্ধান্ত ও সাহসিকতায় অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থী প্রাণে বেঁচে গেছেন। চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছোঁয়া-র বাবা বলেন, “আমরা জানি, ম্যাডাম না থাকলে আমাদের মেয়ে বাঁচত না।”
এক শিক্ষার্থী নাইম জানায়, “ম্যাম একটুও ভয় পাননি। আগুনের ভেতর থেকেও বাচ্চাদের বের করে আনছিলেন। তার কারণেই আমরা এখন বেঁচে আছি।”
মাহরীন চৌধুরীর মরদেহ গতকাল মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে তার গ্রামের বাড়ি, নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ি চৌধুরীপাড়া গ্রামে পৌঁছায়। বিকেল ৪টার দিকে বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
একজন শিক্ষিকার দায়িত্ব কেবল পাঠদান নয়—একজন মা, একজন পথপ্রদর্শক হিসেবেও তিনি থাকেন শিক্ষার্থীদের পাশে। মাহরীন ছিলেন এমনই একজন। তার আত্মত্যাগ প্রমাণ করে, রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আত্মার বন্ধনেই গড়ে ওঠে একটি পরিবার।
আমরা একজন শিক্ষিকাকে হারিয়েছি, কিন্তু সমাজ পেয়েছে এক অনন্ত অনুপ্রেরণার নাম—মাহরীন চৌধুরী। তার গল্প নতুন প্রজন্মকে শিখাবে কিভাবে সাহসী হতে হয়, কিভাবে মানুষ, কিভাবে দায়িত্ব নিতে হতে হয়।
আমরা প্রার্থনা করি, মহান আল্লাহ ম্যামকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।
রাজু