
ঢাকায় তখন সন্ধ্যার শেষ আলো।
আকাশে কুয়াশার মতো মেঘ, বাতাসে ঝুলে থাকা এক অজানা ঘনত্ব।
রায়হানের চোখে ঘুম নেই, হৃদয়ে শান্তি নেই।
সে জানে, সত্যের পেছনে ছুটতে গেলে নিজের মুখোমুখি হতে হয় আর সে সময় খুব কাছে।
ঘটনার পরদিন, সকাল ৯টা।
রায়হান নিজের অফিসে বসে ছিল।
কাজে মন নেই, মন পড়ে আছে তাসনিমের ছবি আর সেই ফ্রেমে লেখা বার্তায়।
অফিসের জানালার পাশে বসে থাকা সহকর্মী শাফি হঠাৎ বলল,
“তুই কাল রাতে কোথায় ছিলি? চোখ-মুখ তো একদম মৃত মানুষের মতো লাগছে।”
রায়হান হেসে বলল,
“ঘুম হয়নি। খারাপ স্বপ্ন দেখছিলাম।”
সে চুপ রাখল সেই কথা যে স্বপ্ন ছিল না, বরং এক সত্য যা তারই বাস্তবতার অংশ হয়ে গেছে।
তবে দুপুর ১টা বাজতেই ঘটল এমন কিছু, যা তার চিন্তার সীমাও ছাড়িয়ে গেল।
একটি লাল খাম, ঠিক আগেরটার মতো।
তবে এবার পোস্টে নয় কে যেন সরাসরি অফিসে দিয়ে গেছে।
তাতে লেখা ছিল শুধু:
“যদি তুই সত্য জানতে চাস, মুখোশ খুল।
তোর আশেপাশে যারা আছে, তাদের সবার একাধিক মুখ আছে।
তুই কি খুঁজে দেখবি?”
আর খামের ভেতরে একটি ছবি
অফিসেরই কারো ছবি।
শাফি।
ছবিতে শাফি দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার সেই দালানের সামনে।
তার পেছনে ছায়া, আর হাতে একটি মোটা নোটবই।
রায়হান স্তব্ধ।
সে ভাবল, “তাহলে শাফিও জানে কিছু? নাকি সে-ই...?”
সন্ধ্যা।
রায়হান আর দেরি করল না।
শাফির অফিস শেষ হতে ১০ মিনিট বাকি।
সে জানাল, “চল ঘুরতে যাই, মাথা ভীষণ ভার হয়ে আছে।”
শাফি প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল।
তবু রাজি হয়ে গেল।
তারা একসাথে পুরান ঢাকা ঘুরতে বের হল।
গাড়িতে বসে রায়হান হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
“শাফি, তুই কখনো ১৪ নম্বর গলির ডেভিল হাউজ চিনিস?”
শাফির মুখ শক্ত হয়ে গেল।
সে একটু থেমে বলল,
“না, শুনেছি মাত্র। ওইসব জায়গায় কেউ যায় না। তুই কেন এমন জায়গার নাম করছিস?”
রায়হান এবার জানে এই অস্বীকারে সত্য লুকানো আছে।
সে আর কিছু না বলে জায়গামতো গাড়ি থামাল।
“চল, তুই আজ দেখবি আমি কী ভয়ংকর জিনিসের মধ্যে ঢুকে পড়েছি।”
শাফি কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখনই রায়হান তার সামনে সেই ছবি তুলে ধরল।
শাফি স্তব্ধ।
তার মুখে কোন ভাব নেই।
কিন্তু চোখের পেছনে একটা কম্পন।
সে বলল, “তুই ভুল করছিস রায়হান। এসব তোর জানার কথা না।”
রায়হান ধমক দিয়ে বলল,
“তুই কি সত্যিই জানিস তাসনিমের কী হয়েছিল?
তুই কি এই খেলার অংশ?”
শাফি মাথা নিচু করে বলল,
“আমি শুধু একজন বহনকারী। আমি শুধু ‘তাদের’ বার্তা পৌঁছাই।
আমি কখনো জানি না কার পরের নামটা খামে থাকবে।”
রায়হান দৌড়ে যায় গাড়ির দিকে।
সে এবার নিশ্চিত শাফি শুধু জানে না, সে খেলোয়াড়ও।
তবে তাকে চালায় আরও কেউ।
আর সেই কেউ সায়রা?
না কি... অন্য কেউ?
রাত ১১টা।
রায়হান ফিরে এল বাসায়।
সে একা বসে আছে, হঠাৎ দরজায় করাঘাত।
সে দরজা খুলে দেখে, কেউ নেই।
শুধু নিচে পড়ে আছে একটি মুখোশ।
সাদা রঙের প্লাস্টিকের মুখোশ।
তাতে আঁকা লাল রঙের হাসি,
চোখের জায়গায় দুটি গভীর ছিদ্র ভেতর থেকে তাকিয়ে থাকা অন্ধকার।
আর মুখোশের পেছনে লেখা
“মুখোশ পড়ে যারা হাঁটে, তারা কখনো মুখ খোলে না।
তুই কি পারবি মুখ খুলতে?”
রায়হান সেই মুখোশ হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল।
সে জানে, সত্য যতই ভয়ঙ্কর হোক, তাকে দেখতে হবে।
সে জানে, তার চারপাশে অনেকেই আছে মুখোশ পরে।
আর হয়তো সে নিজেও... একদিন পরেছিল।
উপন্যাস: ফিরে আসা ছায়া
পর্ব ৪ - লেখক: মো আইয়ুব মন্ডল
Jahan