
ছবিঃ সংগৃহীত
কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার কমল দাশগুপ্ত ১৯১২ সালের ২৮ জুলাই বাংলাদেশের নড়াইল (তৎকালীন যশোর) জেলার কালিয়া থানার বেন্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা তারা প্রসন্ন দাশগুপ্ত ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী।
কমল দাশ গুপ্তের শিক্ষাজীবন শুরু কলকাতায়। ১৯২৮ সালে তিনি ক্যালকাটা একাডেমি থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তী উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। দু'বছর পর পারিবারিক বিপর্যয়ের কারণে পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটে। পরবর্তী সময়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে তিনি বিকম পাস করেন। উত্তর ভারতে মীরার ভজনে সুরের প্রয়োগ বিষয়ে গবেষণা করে তিনি ১৯৪৩ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব মিউজিক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন খেয়াল, গজল, নাত, হামদ, আধুনিকসহ সব ধরনের সঙ্গীতে দক্ষতার অধিকারী।
কমল দাশ গুপ্তরা ছিলেন তিন ভাই আর তিন বোন। প্রত্যেকেই সঙ্গীতে দক্ষতা অর্জন করেন এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। উল্লেখ্য, তারা সবাই নজরুলের গান গেয়েই প্রসিদ্ধ লাভ করেছিলেন। তাদের মধ্যে বিমল দাশ গুপ্ত, সুবল দাশ গুপ্ত, সুধীরা সেন গুপ্তা, ইন্দিরা দাশ গুপ্তার নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। কমল দাশ গুপ্তের জেষ্ঠ্যভ্রাতা বিমল দাশ গুপ্তের কাছেই কমল দাশ গুপ্তের সঙ্গীতে হাতে খড়ি। পরে দিলীপ কুমার রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, রামকৃষ্ণ মিশ্র, ওস্তাদ জমির উদ্দিন খাঁর কাছে সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন। তার সর্বশেষ সঙ্গীত গুরু হিসেবে জমীর উদ্দিন খাঁ' এর নামই বিশেষভাবে জানা যায়।
১৯৩০ সালের কাছাকাছি সময়ে কমল দাশগুপ্ত সুরারোপিত প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়। গান দুটি ছিল 'গানের মালা গেঁথে গেঁথে' ও 'কতকাল আমি'। স্বকণ্ঠে কমল দাশ গুপ্তের প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
সুরের রাজ্যে কমল দাশগুপ্ত ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ দুই দশক ধরে যে সুর সষ্ট্রা সবাইকে ছাড়িয়ে বাংলা আধুনিক গান ও হিন্দি বা উর্দু গীতকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছাতে সমর্থ হয়েছিলেন কমল দাশ গুপ্ত। তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতে পাঠ নেন এইচ.এম.ভির অক্রেষ্টা পরিচালক নিউম্যানের কাছে আর প্রায় পাঁচশ' রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখেন, ব্রজেন গাঙ্গুলী ও অনাদি দস্তিদারের কাছে।
কমল দাশগুপ্ত সারা জীবনে প্রায় সাড়ে আটহাজার গানে সুরারোপ করে গেছেন। এর মধ্যে অধিকাংশ গানই জনপ্রিয়তার শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪'শ নজরুল সঙ্গীত রয়েছে। কমল দাশ গুপ্তের সুরের বৈচিত্র্য ছিল অবিশ্বাস্য। খেয়াল, রাগ প্রধান গান, ভজন, কীর্তন, কাওয়ালি, ইসলামী সঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত, আধুনিক বাংলা গান, উর্দু ও হিন্দিগীত, গজল, লোকসঙ্গীত, মার্চ সঙ্গীত ও সিনেমার গানের প্রতিটি শাখায় রয়েছে তার অবিস্মরণীয় সুরের ঝঙ্কার।
এইচ.এম.ভি প্রামোফোন কোম্পানিতে ঢুকে প্রায় ২৩ বছর বয়সে সঙ্গীত পরিচালনা ও গানের সুর করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। কমল দাশগুপ্ত খুব কম সময়ের মধ্যে তার নিরলস প্রতিভা ও নিষ্ঠার গুনে বাংলা গানের জগৎ ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন সর্ব ভারতীয় পর্যায়ে। তার সুরের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন বলেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কমল দাশ গুপ্তকেই দিয়েছিলেন অনুমোদন ছাড়াই তার গানের সুর করার অধিকার। তখন কাজী নজরুল ইসলাম রচিত গানের প্রশংসা সবার মুখে মুখে।
নজরুল আর কমল দাশগুপ্ত তারা দু'জন ছিলেন যেন মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। একই বৃন্তে দুটি ফুল। হিজ মাস্টার্স ভয়েসে কমল দাশগুপ্ত এক মাসে ৫৩টি গান রেকর্ড করে সে সময়ে উপমহাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন।
নজরুল ইসলাম ছিলেন গ্রামোফোন যুগে সফল গীতিকার। শুধু গীতিকারই নন, আধুনিক বাংলা গানের জনকও ছিলেন তিনি। সে যুগের সেরা কম্পোজার কমল দাশগুপ্তকে (১৯১২-১৯৭৪ খ্রি.) নিয়ে আসেন কাজী নজরুল ইসলাম গ্রামোফোন কোম্পানিতে (১৯৩২ খ্রি.) এবং তারই হাতেই সৃষ্টি হয় বাংলা গানের স্বর্ণ যুগ। কাজী নজরুলের স্নেহ ধন্য হয়ে ওঠা কমল দাশ গুপ্তের সঙ্গীত জীবনের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এতে তার সঙ্গীত জীবনের মোড় ঘুরে যায়। নজরুলের কথা ও কমল দাশ গুপ্তের অসাধারণ সুর আর গায়কীর গীতি সুধায় সেদিন যে আবহ সৃষ্টি হয়েছিল তার মূলেই ছিলেন কমল দাশগুপ্ত এবং পরোক্ষভাবে প্রণব রায়, মোহিনী চৌধুরী, যুথিকা রায় ও জগন্ময় মিত্র।
নজরুল পরবর্তী দশকে কমল দাশ গুপ্তের সুর আর প্রণব রায়ের কথাই ছিল বাংলা গানের প্রধান ধারা। বাংলা চলচ্চিত্রের সুরকার হিসেবেও কমল দাশগুপ্ত প্রভুত খ্যাতি অর্জন করেন। তার সুর দেওয়া ও গাওয়া 'তুফান মেল' 'শ্যামলের প্রেম' 'এই কিগো শেষ দান' চলচ্চিত্রের গানগুলো এক সময় বিপুল জনপ্রিয় ছিল। অনেক হিন্দি ছায়াছবিতেও তিনি দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। তিনি প্রায় ৮০টি ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
নজরুল ইসলামের গান তার ভিত গড়ে দিলেও প্রণব রায়, অজয় ভট্টাচার্য, মোহিনী চৌধুরী, শৈলেন রায়, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, অনিল ভট্টাচার্য রচিত গানে সুর সৃষ্টির মাধ্যমে কমল দাশগুপ্ত শুধু জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি, সৃষ্টি করেন বাংলা গানের একটি নতুন ধারা। তিনি বাংলা ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে চারবার ও হিন্দি ছবির জন্য একবার নয় মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেন। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তার শেষ ছবি 'বধূবরণ'। সমগ্র উপমহাদেশে সঙ্গীত জগতে তিনি ছিলেন অবিস্মরণীয় প্রতিভাধর সুরকার।
প্রথিত যশা কণ্ঠ শিল্পী ফিরোজা বেগম তৎকালীন পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাতে থাকতেন। সঙ্গীতের প্রয়োজনে কলকাতাতে প্রায়ই যাওয়া আসা ছিল তার। সে ধারাবাহিকতায় তিনি কমল দাশ গুপ্তের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তার কাছে গান শেখার সুযোগ লাভ করেন। ধীরে ধীরে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে এবং শিল্পী ফিরোজা বেগম মনে প্রাণে কমল দাশ গুপ্তকে ভালোবাসতেন এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৫ সালে উভয়েই বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন কমল দাশ গুপ্তের বয়স ছিল ৪৩ বছর। বিয়ের চার বছর পরে ৪৭ বছর বয়সে ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন এবং তার নাম হয় কাজি কামাল উদ্দিন। কলকাতায় তাদের তিন সন্তান তাহসীন, হামিন ও শাফিনের জন্ম হয়। ১৯৬৭ সালে কমল দাশগুপ্ত স্বপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন স্থায়ীভাবে।
জীবন সায়াহ্নে অল্প কিছুদিন বাংলাদেশ বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস এ কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এ সময় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাকে জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করেন।
কমল দাশগুপ্ত বাংলা সঙ্গীতের এক অবিস্মরণীয় নাম সঙ্গীতের মুকুটহীন সম্রাট। এই সঙ্গীত বোদ্ধা সঙ্গীতে রেখে গেছেন তার উত্তরসূরি হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদকে। দুজনই বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা।
কমল দাশগুপ্ত বিরল সুর স্রষ্টা হিসেবে বাংলাগানের জগতে রীতিমতো স্থায়ী আসন পেতে আছেন। তার সুরারোপিত বিখ্যাত বাংলা গানের কয়েকটি নমুনা তুলে ধরা হলো-
আমি ভোরের যুথিকা (যুথিকা রায়), সাঁঝের তারকা আমি (যুথিকা রায়), এমনি বরষা ছিল সেদিন (যুথিকা রায়), চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয় (যুথিকা রায়), আমারি সমাধি পরে (যুথিকা রায়), মেনেছি গো হার মেনেছি (জগন্ময় মিত্র), ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে তোমারে করেছে রানী (জগন্ময় মিত্র), তুমি কি এখন দেখিছো স্বপন (জগন্ময় মিত্র), তুমি মোর জীবনে আসিও ফিরে (জগন্ময় মিত্র), এই কিগো শেষ দান, বিরহ দিয়ে গেলে (জগন্ময় মিত্র), আমি ভুলে গেছি তব পরিচয় (জগন্ময় মিত্র), আমার দেশে ফুরিয়ে গেছে ফাগুন (জগন্ময় মিত্র), পৃথিবী আমারে চায় (সত্য চৌধুরী), যেথা গান থেমে যায় (সত্য চৌধুরী), আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়, তুমি যে বহ্নি শিখা (সত্য চৌধুরী), জেগে আছি একা, জেগে আছি কারাগারে (সত্য চৌধুরী), আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে, আমি বনফুল গো (কানন দেবী), যদি ভালো না' লাগে তবে দিয়ো না মন (কানন দেবী), চলে তুফান মেল (কানন দেবী), ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে এ মধু রাত নাহি বাকি (তালাত মাহমুদ), দুটি পাখি দুটি তীরে, মাঝে নদী বহে ধীরে (তালাত মাহমুদ), সেদিন নিশীথে বরিষণ শেষে চাঁদ উঠেছিল বনে (হেমন্ত), তোমার জীবন হতে (হেমন্ত)।
এছাড়া তার সুরারোপিত আরো শ্রেষ্ঠ বাংলা গানগুলো হলো- 'শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে, চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয়। নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়, তুমি হাতখানি যবে রাখো মোর হাতের পরে, আমার যাবার সময় হলো, ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে, কতদিন দেখিনি তোমায়, হার মেনেছি গো হার মেনেছি, মম যৌবন সাথী বুঝি এলো, বিফলে যামিনী যায়, কে আজি দিল দোলা তখন ভাঙেনি প্রেমের স্বপনখানি, যাদের জীবন ভরা শুধু আঁখি জল, ভেসেছে হাল ছিঁড়েছে পাল, জানি জানি গো মোর শূন্য হৃদয় দেবে ভরি, এমনি ভরসা ছিল সেদিন, একি অপরূপ রূপে মা' তোমায় হেরিনু পলস্নী জননী, ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি, ও আমার দেশের মাটি, বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে, যবে তুলসী তলায় প্রিয় সন্ধ্যা বেলায়, পথহারা পাখি কেঁদে মরে একা, আমি চাঁদ নহি অভিশাপ, গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়, আগুন জ্বালাতে আসিনি গো এসেছি দেয়ালি জ্বালাতে, এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি- খোদা তোমার মেহেরবানি' ইত্যাদি।
তিনি সুর সৃষ্টির পাশাপাশি বেশ কিছু গানও রচনা করেন। তার মধ্যে 'মম যৌবন সাথী বুঝি এলো', 'বিফলে যামিনী যায়', 'কে আজি দিল দোলা' উলেস্নখযোগ্য। গান তিনটি সুরারোপ করে তিনি ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে রেকর্ড করেন।
তৎকালীন সময়ে কমল দাশগুপ্ত গ্রামোফোন রেকর্ড, চলচ্চিত্রে নিজের একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। তালাত মাহমুদ, কানন দেবী, কুন্দলাল সায়গল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, আব্বাস উদ্দিন, সত্য চৌধুরী থেকে শুরু করে তৎকালীন প্রথিত যশা এমন কোনো শিল্পী ছিলেন না যিনি তার সুরে গান করেননি। আর যুথিকা রায়ের সঙ্গে তো তিনি রীতিমতো জুটিবদ্ধ হয়ে একের পর এক হিট গান উপহার দিয়ে গেছেন।
১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই একজন বরেণ্যকৃতি শিল্পীও সুরকার কমল দাশ গুপ্ত মৃত্যুবরণ করেন।
সুরের জাদুকর আজীবন বেঁচে থাকবেন হাজারো শ্রোতার হৃদয়ে, তার কর্মে, সুরে আর সঙ্গীত সৃষ্টিতে।
লেখক,
শরিফুল রোমান
ইমরান