
বাংলা পঞ্জিকার দ্বিতীয় ঋতু বর্ষা। হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক চর্চিত ঋতু বর্ষা। প্রণয় যুগলের বিরহ ও পিছুটানের বিশেষ ঋতু বর্ষা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের, কৃষিভিত্তিক বাঙালি সমাজের প্রণিধানযোগ্য ঋতু বর্ষা। বাংলা কবিতার প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের কবিদের প্রিয়তর ঋতু বর্ষা। বর্ষা মানে আষাঢ়ের অবিরাম বৃষ্টি। বর্ষা মানে শ্রাবণের শ্রান্তিহীন বর্ষণ। বর্ষা মানে ক্যালেন্ডারে দু’মাস (আষাঢ়, শ্রাবণ); বাস্তবে চার মাস [কালবৈশাখীর বৈশাখ, ঝড়ো হাওয়ার জ্যৈষ্ঠ এবং আষাঢ়, শ্রাবণ] আত্মীকারিণী এক ঋতু।
॥ দুই ॥
বর্ষা নিয়ে লিখেননি এমন কোনো কবি খুঁজে পাওয়া বোধহয় অসম্ভব বাংলা ভাষায়। অনেকেই আবার এই বর্ষাকে উপজীব্য করেই লিখে ফেলেছেন আস্ত একখানা বই। প্রাচীন যুগের মহাকবি কালিদাস [আনু. খৃ.পূর্ব ১ম শতক/ ৪র্থ খৃস্টাব্দ] যেমন রচনা করেছেন মহাকাব্য ‘মেঘদূত’! কালীদাসের পরে বৈষ্ণবপদাবলী সাহিত্যের প্রধান কবিগণ- চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাস আর বিহারীলাল প্রমুখের কবিতায়ও বর্ষা ঘুরে-ফিরে এসেছে স্ব-স্ব বিরহ ও প্রেরণা হয়ে। তবে বর্ষাকে বিরহকাল ভাবতে পারলেই যেনো কবিসমাজের সমস্ত সুখ! বর্ষা আসলে বিরহের, পিছুটানের, স্মৃতি ও স্মৃতিকাতরতার!
এবার প্রাচীন যুগের ‘প্রাচীন কথামালা’ একপাশে রেখে মধ্যযুগ থেকেই বর্ষাকেন্দ্রিক কবিতাবলীর কিছু উদ্ধৃতির পাঠ নিতে নিতে বর্ষার বর্ণালি চারিত্র্য ‘ব্যবচ্ছেদ’ করা যাক।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস [১৩৩৯-১৩৯৯ইং], যাঁর জীবনচরিত নিরূপণে সৃষ্টি হয় ‘বর্ণালি’ [বহুবর্ণ বা বহুরকম অর্থে] সমস্যা। সমালোচনা সাহিত্য যেটাকে চিহ্নিত করে ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’ নামে। যেহেতু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর এই স্রষ্টা কখনো বড়ু চণ্ডীদাস, কখনো দ্বিজ চণ্ডীদাস, কখনো দীন চণ্ডীদাস আবার কখনোবা হয়ে উঠেন শুধুই ‘চণ্ডীদাস’। যিনি তাঁর প্রেয়সী রাধাকে পাবার জন্যে আবার দীর্ঘ বারো বৎসর বড়শি বেয়ে হয়ে আছেন সাক্ষাত মিথ। সেই প্রেমিক কবি চণ্ডীদাস, বর্ষা রাতে তাঁর বধুয়াকে বৃষ্টিধারায় ভিজতে দেখে হাহুতাশ করে উঠেন এভাবে,
‘এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইল বাটে
আঙিনার মাঝে বধুয়া ভিজিছে
দেখিয়া পরান ফাটে!’
মধ্যযুগেরই আরেক প্রণিধানযোগ্য কবি বিদ্যাপতি [১৩৫২-১৪৪৮ইং]তাঁর প্রিয়ার বিরহে গেয়ে ওঠেন,
‘এ সখি হামারি দুখেরি নাহিওর
এ ভরা ভাদর মাহভাদর
শূন্য মন্দির মোর!’
আধুনিক যুগে এসে আমরা দেখি, এযুগের প্রধান কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত [১৮২৪-১৯৭৩] ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় বর্ষার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন,
‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর
উথলিল নদনদী ধরনীর উপর
রমণীর মন লয়ে সুখে কেলি করে
দানবাদি দেবযক্ষ সুখিত অন্দরে।’
মাইকেলের পরে বাংলা কবিতার সিংহাসন যাঁকে সসম্মানে অধিষ্ঠিত করেছে, তিনি আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮৬১-১৯৪১]। তাঁরও অসংখ্য কবিতায় বর্ষা এসেছে নানা রূপে, বিভিন্ন আঙ্গিকে। বর্ষা নিয়ে রচিত তাঁর বিখ্যাত ছড়াকবিতা ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর’ পড়েননি এমন কোনো বাঙালি আছেন বলে বিশ^াস করতে কষ্ট হয়! তিনি তাঁর অমর সৃষ্টি ‘সোনারতরী’ কবিতায় বর্ষাকে হাজির করেন এভাবে,
‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধানকাটা হলো সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা-
কাটিতে কাটিতে ধান এলো বরষা। ’
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম [১৮৯৯-১৯৭৬] যেনো বর্ষা এলেই, তাঁর স্বাতন্ত্র্য ‘বিদ্রোহী’ সত্তা থেকে বের হয়ে এসে হয়ে যান নিতান্ত বিরহী! নাহয় ‘চির উন্নত মম শির’ এর কবি কী করে লিখতে পারেন,
‘বাদল রাতের পাখি
কবে পোহায়েছে বাদলের রাতি, তবে কেনো থাকি থাকি
কাঁদিছ আজিও ‘বউ কথা কও’ শেফালি বনে একা
শাওনে যাহারে পেলে না তারে কি ভাদরে পাইবে দেখা?
তুমি কাঁদিয়াছ ‘বউ কথা কও’ সে কাঁদনে তব সাথে
ভাঙিয়া পড়েছে আকাশের মেঘ গহীন শাওন রাতে।’ [বাদল রাতের পাখি]
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ [১৮৯৯-১৯৫৪] বর্ষার ‘অর্ধাঙ্গ’ শ্রাবণকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তিনি তাঁর বীক্ষণশক্তিতে ‘শ্রাবণ-রাত’ কবিতায় লিখছেন,
‘শ্রাবণের গভীর অন্ধকার রাতে
ধীরে ধীরে ঘুম ভেঙে যায়
কোথায় দূর বঙ্গোপসাগরের শব্দ শুনে?
বর্ষণ অনেকক্ষণ হয়ে থেমে গেছে;
যতো দূর চোখ যায় কালো আকাশ
মাটির শেষ তরঙ্গকে কোলে করে চুপ করে রয়েছে যেনো;
নিস্তব্ধ হয়ে দূর উপসাগরের ধ্বনি শুনছে।
মনে হয়
কারা যেনো বড়ো বড়ো কপাট খুলছে
বন্ধ করে ফেলেছে আবার;
কোন দূর নীরব আকাশরেখার সীমানায়।’
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন [১৯০৩-১৯৭৬ইং] তাঁর ‘পল্লী-বর্ষা’ কবিতায় বলেন,
‘আজিকার রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাটে মেঘের আড়ে
কেয়া-বন-পথে স্বপন বুনিছে ছলছল জল-ধারে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝঝুম নিরালায়
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়। ’
রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ [১৯১৮-১৯৭৪] বর্ষাকে নিয়ে কবিতাই লিখেননি কেবল। তিনি যেনো বর্ষাকে নিয়ে গেয়ে উঠেছেন সুখদ এক গীতিকা। তাঁর ‘বৃষ্টির গান’ ছড়া-
‘বৃষ্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথা রে
লুকিয়ে গেলো বাঁশ বনে।
নদীতে নাই খেয়া যে
ডাকলো দূরে দেয়া যে
কোন সে বনের আড়ালে
ফুটলো আবার কেয়া যে।’
কবি আহসান হাবীব [১৯১৭-১৯৮৫ইং] বর্ষার ক্যানভাসে এঁকেছেন আমাদের সামাজিক বৈষম্য ও দারিদ্র্যবিরোধী এক ‘ভয়ংকরসুন্দর’ ছবি! ‘রেনকোট’ কবিতায় তিনি লিখেছেন,
‘পঁচিশটি বর্ষা তো পেরিয়ে এলাম
দেখে এলাম (এরপর ১১ পৃষ্ঠায়)
কত অন্ধকার অরণ্যশীর্ষ
কালো মেঘের অন্ধকারে ছাওয়া,
দেখলাম
কতো ঝরঝর বর্ষা
আর কতো নিঃসঙ্গ জানালার
ইতিহাস পড়লাম
আমার নির্বিকার জানালায়।’
বর্ষার বন্দনা করে কবি শামসুর রাহমান [১৯২৯-২০০৬] ‘অনাবৃষ্টি’ শীর্ষক কবিতায় লিখেন,
‘টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষীর মতো বড়ো
ব্যঘ্র হয়ে চেয়ে আছি খাতার পাতায়
যদি জড়ো হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুলবৃষ্টি
অলস পেন্সিল হাতে বকমার্কা। পাতাজুড়ে আকাশের নীল।’
এবং বিশ্বাসী কবি আলমাহমুদ [জন্ম: ১৯৩৬-২০১৯] তাঁর ‘আষাঢ়ের রাতে’ কবিতায় লিখেন,
‘কেন যে আবিল গন্ধে ভরে ওঠে আমার নিঃশ^াস
এই রাত, এই হাওয়া, নীলিমার নক্ষত্রনিচয় আর
আত্মীয় চাঁদের পিঠ, সবি যেন আচ্ছন্ন ধোঁয়ার,
যেন সবি প্রায়ান্ধ চোখের কাছে অস্পষ্ট সুদূর।’
॥ তিন ॥
প্রকৃতির অস্বাভাবিক আচরণে ইদানীং বর্ষা বেশ ‘বহুরূপী’ হয়ে উঠেছে। বর্ষার ‘বর্ণ’ আজ আসলেই অদ্ভুত! আষাঢ়ের অর্ধেক চলে গেছে, তবু বৃষ্টির দেখা নেই। অথবা আবার আষাঢ় শুরুর আগেই একটানা বৃষ্টি। শ্রাবণের সকালে বৃষ্টির বদলে কাঠফাটা রোদ্দুর! হঠাৎ আবার টানা একসপ্তাহ বিরতিহীন বরিষণ!
অথচ এই কয়েক বছর আগেও আমরা বর্ষা বলতে বুঝতাম, আষাঢ়ে আগমন শ্রাবণে বরিষণ! খাল-বিল, নদী-নালা কানায় কানায় পূর্ণ। পুকুর ও মৎস্য চাষের ঘের পাড়তক পানিতে টইটম্বুর। বিলে-ঝিলে বড়শিতে, নানান কিসিমের জালে মাছ ধরার ধুম। বৃষ্টির পানিতে কাগজের নৌকো ভাসানো। হাঁটুপানিতে সাঁতার কাটা। আষাঢ়স্য গল্পে, লুডু খেলায়, বৃষ্টিমাথায় ফুটবলে আনন্দ ভাগাভাগি! হ্যাঁ, আমাদের অভিব্যক্তি যেমনই হোক, ঋতু কিন্তু আসে তার নিজস্ব নিয়মে। এখনো আষাঢ় এসে আষাঢ়স্য গল্পের হালকা আভাস দিয়ে যায়। এখনো শ্রাবণ এসে নিশীথ ঝড়ের নাকাড়া বাজিয়ে যায়!
॥ চার ॥
মেঘের অবস্থান বিচারে যেমন বর্ষার বর্ষণমাত্রা কমবেশি হয়ে থাকে তেমনি গ্রাম আর শহরের বর্ষায়ও রয়েছে বিবিধ ব্যবধান। বিশেষত বর্ষণপরবর্তী বর্ষার প্রভাব-প্রকৃতি শহর আর গ্রামে অনেকটাই আলাদা।
এসময়কার শহরের বর্ষাকাল মানেই ওয়াসা ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ঘণ্টাখানের বৃষ্টিপাতেই ফ্লাইওভারশোভিত মহানগরীর প্রধান সড়কসমূহের নদীতে রূপান্তর। বুড়িগঙ্গা হয়ে ওঠে পুরো ঢাকা শহর। চাটগাঁ হয়ে যায় কর্ণফুলির নগরসংস্করণ! পথঘাট সব পানির তলে ডুব মারায় পাঁচ টাকার পথে পঞ্চাশ টাকা গচ্ছা দিয়েও যেতে না পারা। আচমকা সবধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়া। তিন-চার গুণ বেশি ভাড়া গুনে রিকশায় উঠে, গন্তব্যে পৌঁছার আগেই পানির নিচের খানাখন্দের খপ্পরে পড়ে আছাড়ের ‘আচার’ খাওয়া। বহুতল ভবনের নিচতলায় বসবাসের খেসারত স্বরূপ কয়েকদিনের জন্যে পানিবন্দী হয়ে পড়া। চলার পথে, গলি-ঘুঁজিতে হাঁটু-কোমর এমনকি ঘাড় অবধি পানিতে ভাসতে থাকা মল-মূত্রের গা ঘেঁষে-ঘেঁষে সন্তরণ স্টাইলে হাঁটাহাঁটি! দমকা হাওয়ার আভাস পেতে না পেতেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া... এভাবে বলতে গেলে বলা যায় অনেক কিছুই। এইক্ষণে, এই ডিজিটাল যুগের শ্রাবণে বর্ষার ওপর যথেষ্ট ভরসা রাখতে না পারায় আর বলছি নে!
বর্ণিত বর্ষাকালীন ভোগান্তি ও অসঙ্গতিরাশির কারণে এখনকার শহুরে মানুষদের কাছে বর্ষা যেনো এক ভীষণ অস্বস্তিকর ঋতু! অবশ্য, আমার এই কথা এদেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত বস্তিবাসীদের ক্ষেত্রেই যথার্থ। শহরের এলিট কিংবা উচ্চবিত্ত শ্রেণির কথা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের বিলাসবহুল আবাসনের অবস্থান যেহেতু তুলনামূলক নিরাপদ ও উঁচু জায়গায়। তাছাড়া ওসব অভিজাত এলাকায় বর্ষার অতিবর্ষণে আচমকা ‘জলজট’ দেখা দিয়ে ফেললে, খুব দ্রুততার সঙ্গে তাদেরকে ‘জটমুক্ত’ করার উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে, তাদের আবাস বর্ষার বেরসিক জলজট থেকে মোটামুটি মুক্ত থাকতে পারলেও তাদের দামি-দামি গাড়ির কিন্তু রাস্তায় বেরোবার তেমন একটা জো থাকে না। শহরের প্রায়সব রাস্তাঘাট যেহেতু কৃত্রিম নদীর অংশ হয়ে যায়!
প্যানেল